কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাবিজ্ঞান বিষয়ক খবর

মানুষের চিন্তার গতি: মস্তিষ্কের রহস্য উন্মোচন

Share
Share

এক ঝলকে মনে পড়ল কলেজ জীবনের সেই বিকেলটার কথা। বন্ধুদের সঙ্গে চায়ের আড্ডা, হঠাৎ এক বন্ধু প্রশ্ন করল—“তুই একসাথে কতটা জিনিস ভাবতে পারিস?” সবাই হেসে উঠেছিল, কেউ বলেছিল পাঁচটা, কেউ তিনটা, আর কেউবা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেছিল, “আমার মাথা কম্পিউটার!” কিন্তু আজকের বিজ্ঞান বলছে—তাদের কেউই সঠিক ছিল না।

সম্প্রতি ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির (Caltech) এক যুগান্তকারী গবেষণায়, যা Neuron জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে, বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো নির্ধারণ করেছেন মানুষের চিন্তার গতি—মাত্র ১০ বিট প্রতি সেকেন্ডে
এই হিসাব মানব মস্তিষ্কের তথ্য প্রক্রিয়াকরণের ক্ষমতার একটি নির্দিষ্ট সীমা দেখিয়ে দিয়েছে, যা একদিকে যেমন আমাদের চেতনার রহস্য উন্মোচন করছে, অন্যদিকে তেমনি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তির স্বপ্নগুলোকে।

অনুভূতির জলোচ্ছ্বাস, কিন্তু চিন্তার সরু পথ

আমাদের শরীর প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১ বিলিয়ন বিট পরিমাণ তথ্য সংগ্রহ করে—চোখের দৃষ্টি, কানের শব্দ, গায়ের ছোঁয়া, নাকের গন্ধ—সব মিলিয়ে এক বিশাল তথ্যভাণ্ডার প্রবেশ করে মস্তিষ্কে। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হলো, এই বিশাল তথ্যের মাত্র দশটি বিট আমরা সচেতনভাবে প্রক্রিয়া করতে পারি।

এই ফারাক নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোসায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. সামিরা হক বলেন,
“আমরা ভাবি যে আমরা অনেক কিছু একসাথে ভাবতে পারি, কিন্তু আসলে আমরা কেবল একটি চিন্তার পথে হাঁটি—এবং বাকি পথগুলো শুধু পাশ দিয়ে চলে যায়।”

বিবর্তনের পথে গড়ে ওঠা মনোযোগের সীমা

গবেষকরা মনে করেন এই সীমাবদ্ধতা আসলে বিবর্তনের একটি ফল। আদিম প্রাণীদের স্নায়ুতন্ত্র মূলত গঠিত হয়েছিল চলাফেরা এবং বেঁচে থাকার জন্য—খাদ্য খোঁজা, শত্রু এড়ানো ইত্যাদি। ফলে তারা একসাথে বহু তথ্য প্রক্রিয়া না করে, একটি বিষয়েই মনোযোগ দিত।
এই ‘সিঙ্গল-ট্র্যাক’ প্রসেসিং পদ্ধতি মানব মস্তিষ্কেও রয়ে গেছে, যদিও আমাদের চারপাশে আজ তথ্যের ঢল।

প্রযুক্তি উদ্যোক্তা এলোন মাস্ক একবার বলেছিলেন, “মেশিনের সঙ্গে মানুষের সংযোগ তৈরি করলেই আমরা সুপারহিউম্যান হবো।” কিন্তু এই নতুন গবেষণা আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে—মানব মস্তিষ্কের ভিতরেই এক অদৃশ্য সীমা আছে, যেটা প্রযুক্তির মাধ্যমে অতিক্রম করা সহজ নাও হতে পারে।

মাল্টিটাস্কিং: মিথ না বাস্তবতা?

আজকের ডিজিটাল যুগে আমাদের প্রায়ই একসাথে একাধিক কাজ করতে হয়—মোবাইলে কথা বলা, মেসেজ পড়া, ইমেইল লেখা, আবার পাশাপাশি চিন্তাভাবনা করা।
কিন্তু বিজ্ঞান বলছে, মস্তিষ্ক একই সময়ে একাধিক কঠিন কাজ সত্যিকার অর্থে করতে পারে না। সে কেবল দ্রুত এক চিন্তা থেকে আরেকটিতে লাফিয়ে যায়।
এই প্রসঙ্গে এক অভিজ্ঞ পাঠক, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আনিসা রহমান বলেন,
“আমার মনে হতো আমি মাল্টিটাস্কার, কিন্তু পরীক্ষার সময় বুঝি যে একসাথে দুই বিষয় নিয়ে ভাবলে আসলে দুটোই গুলিয়ে যায়।”

ভবিষ্যতের প্রযুক্তির চ্যালেঞ্জ

ব্রেইন-মেশিন ইন্টারফেস বা মস্তিষ্কের সঙ্গে সরাসরি যন্ত্র সংযুক্ত করার যে ধারণা আজকের দিনে কল্পনা থেকে বাস্তবে আসতে শুরু করেছে, সেখানে এ গবেষণা বড় প্রশ্ন তুলেছে। যদি আমাদের চিন্তার গতি একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থাকে, তবে এমন প্রযুক্তির সাফল্য কি শুধুই কল্পনার ওপর নির্ভর করবে?

বিশিষ্ট নিউরোসায়েন্টিস্ট ড. কেনেথ ব্রাউন, যিনি হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির নিউরোসায়েন্স বিভাগের গবেষক, বলেন, “আমরা যন্ত্রের গতি বাড়াতে পারি, কিন্তু মানুষের চিন্তার স্বাভাবিক গতি যদি সীমিত থাকে, তবে সেই ব্যবধান আমাদের বুঝতে হবে এবং মেনে চলতে হবে।”

শেষ কথা

চায়ের টেবিলের সেই আড্ডার প্রশ্নটা আজও প্রাসঙ্গিক—“মানুষ একসাথে কতটা ভাবতে পারে?”
বিজ্ঞান এখন বলছে—বেশি নয়। কিন্তু এই সীমিত গতি দিয়েই আমরা আবিষ্কার করেছি রকেট, চিকিৎসা, সাহিত্য, গণিত এবং আরও অগণিত বিস্ময়।
তাই চিন্তার গতি কম হলেও, গভীরতা ও দিকনির্দেশনার দিক দিয়ে মানব মস্তিষ্ক আজও অতুলনীয়।

এটাই তো মানুষ হওয়ার সত্যিকারের সৌন্দর্য—বাঁধা দিয়ে শুরু, কিন্তু সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টায় অদম্য।

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

Related Articles
গবেষণায় হাতে খড়িবিজ্ঞান বিষয়ক খবর

AI টুলের মাধ্যমে গবেষণাপত্রের গুণগত মান বৃদ্ধি

একাডেমিক লেখায় ব্যাকরণ, স্পষ্টতা এবং শৈলী উন্নত করতে সাহায্য করে এমন শীর্ষ...

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাতথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক খবর

শুধু প্রযুক্তি নয়, এখন অপরাধেও AI: ইউরোপোলের সতর্কবার্তা

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখন সাইবার অপরাধীদের জন্য একটি হাতিয়ার। ইউরোপোল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-চালিত স্ক্যাম,...

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাপরিবেশ ও পৃথিবী

এআই ডিজাইন করা এনজাইম: প্লাস্টিক ধ্বংসের নতুন বিপ্লব!

আবিষ্কার করুন কিভাবে একটি বিপ্লবী AI-পরিকল্পিত এনজাইম প্লাস্টিককে ২৫ গুণ দ্রুত ভেঙে...

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাতথ্যপ্রযুক্তি

গুগল নয়, এবার ব্র্যান্ডগুলো লড়ছে চ্যাটজিপিটির মন জয় করতে

বাংলাদেশের ব্র্যান্ডগুলি কীভাবে ChatGPT-এর মতো AI টুলের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য তাদের...

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাচিকিৎসা বিদ্যা

ক্যান্সার চিকিৎসায় বিপ্লব আনতে পারে Ataraxis AI

আবিষ্কার করুন কিভাবে Ataraxis AI যুগান্তকারী AI প্রযুক্তির সাহায্যে স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসায়...

Three Columns Layout

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact

biggani.org❤️gmail.com

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

বিজ্ঞানী অর্গ (biggani.org) বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে গবেষণা ও বিজ্ঞান নিয়ে বাংলা ভাষায় তথ্য ও সাক্ষাৎকার প্রচার করে – নবীনদের গবেষণা ও উচ্চশিক্ষায় প্রেরণা দেয়া হয়।

যোগাযোগ:

biggani.org@জিমেইল.com

biggani.org, a community of Bangladeshi scientists, shares interviews and information about researchers and scientists in Bengali to inspire young people in research and higher education.