অপারেশন থিয়েটারে বাতি জ্বলছে। চিকিৎসকদের প্রতিটি মুহূর্ত কাটছে তীব্র উৎকণ্ঠায়। রোগীর মস্তিষ্কে গভীরে অবস্থিত হিপোক্যাম্পাসের ক্ষতস্থানে পৌঁছাতে হলে সামনের অংশের সুস্থ টেম্পোরাল কর্টেক্সের একটি ছোট্ট টুকরো সরাতে হবে। ওই ছোট্ট টুকরোতেই লুকিয়ে রয়েছে বিজ্ঞানের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রহস্য উন্মোচনের চাবিকাঠি।
মানুষের মস্তিষ্কের এই ক্ষুদ্র অংশটি সাধারণত অস্ত্রোপচারের পর বাতিল করা হয়। কিন্তু এবার, যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা এ ধরনের একটি বাতিল টিস্যুকেই রূপান্তর করেছেন বিপুল সম্ভাবনার গবেষণায়। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী জেফ ডব্লিউ লিকটম্যান এবং তাঁর সহকর্মীরা অত্যাধুনিক ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপির সাহায্যে এক কিউবিক মিলিমিটার মানব মস্তিষ্কের বিশদ ত্রিমাত্রিক চিত্র তৈরি করেছেন, যার আয়তন ১.৪ পেটাবাইট। এই বিশাল পরিমাণ তথ্যের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো মানুষের টেম্পোরাল কর্টেক্সের অভ্যন্তরীণ গঠন জানা সম্ভব হলো।
“এ ধরনের গবেষণা এর আগে কখনোই সম্ভব হয়নি,” বলেছেন গবেষণার নেতৃত্বদানকারী বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার শ্যাপসন-কো। “আমরা এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছি, যেখানে প্রতিটি স্নায়ু-কোষ এবং তাদের কোটি কোটি সংযোগ চাক্ষুষভাবে বিশ্লেষণ করা সম্ভব।”
গবেষণার এই বিপুল তথ্যের মধ্যে রয়েছে প্রায় ৫৭ হাজার স্নায়ু-কোষ, ২৩ সেন্টিমিটার দীর্ঘ রক্তনালী এবং প্রায় ১৫ কোটি সিন্যাপটিক সংযোগ। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, এ গবেষণায় আগে অজানা এক ধরনের দিকনির্দেশক নিউরন এবং বিরল কিন্তু অত্যন্ত শক্তিশালী বহুসংযোগী (মাল্টিসিন্যাপটিক) স্নায়ু সংযোগের অস্তিত্বও চিহ্নিত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত নিউরোবিজ্ঞানী ড. ক্যারোলিন রিড বলেন, “এই গবেষণাটি মস্তিষ্কের গোপন রহস্য জানার ক্ষেত্রে এক নতুন যুগের সূচনা করল।”
বিজ্ঞানীরা শুধু তথ্য সংগ্রহের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননি; তারা তৈরি করেছেন একটি উন্মুক্ত অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, যেখানে বিশ্বের যে কেউ এই ডেটা বিশ্লেষণ করতে পারবেন। এর মাধ্যমে স্নায়ু-বিজ্ঞান গবেষণায় নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র সাব্বির রহমান এই গবেষণা সম্পর্কে বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা মস্তিষ্ক নিয়ে যতটা জানি, এই ধরনের গবেষণা তার চেয়েও গভীরতর ও বাস্তবমুখী জ্ঞান দেবে। এটি বাংলাদেশের মতো দেশের গবেষকদের জন্যও নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেবে।”
গবেষকরা মনে করছেন, এই উচ্চ-রেজোলিউশন বিশ্লেষণের মাধ্যমে ভবিষ্যতে আলঝেইমার, পারকিনসন কিংবা এপিলেপসির মতো স্নায়বিক রোগের চিকিৎসায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আসতে পারে। “আমাদের গবেষণার মূল লক্ষ্য হলো মস্তিষ্কের রোগগুলো কীভাবে তৈরি হয়, তা বোঝা,” বললেন জেফ ডব্লিউ লিকটম্যান। “যত বেশি মানুষ এই তথ্য ব্যবহার করবেন, তত দ্রুত আমরা সেই লক্ষ্য অর্জন করতে সক্ষম হবো।”
সত্যিই, মানুষের মস্তিষ্কের এই নতুন মানচিত্র শুধু বিজ্ঞানের নয়, সমগ্র মানবজাতির জন্যও হয়ে উঠতে পারে আশার এক নতুন আলো।
Reference:
https://www.science.org/doi/10.1126/science.adk4858
Leave a comment