অন্যান্য

জিনোম সিকোয়েন্স’ বিজ্ঞানের ভাষায় জীবন রহস্য!

Share
Share

প্রবন্ধটির লেখক আজিজুল হক। তিনি এই লেখায় জিনোম সিকোয়েন্সিং প্রযুক্তির গুরুত্ব এবং এর ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন কিভাবে ডিএনএ সিকোয়েন্সিং মানুষের শারীরিক বৈশিষ্ট্য এবং স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য ধারণ করে, এবং এটি কীভাবে ভাইরাস এবং রোগের চিকিৎসা উন্নত করতে সাহায্য করছে। এছাড়াও, বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা কীভাবে পাট, ইলিশ, এবং ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের জিনোম সিকোয়েন্সিং করেছে, সেই বিষয়েও তিনি আলোচনা করেছেন।

জিনোম সিকোয়েন্স’ বিজ্ঞানের ভাষায় জীবন রহস্য!

আমাদের প্রত্যেকের জীবনের একটা গল্প আছে। জীববিজ্ঞানের ভাষায় সে গল্পটা মাত্র চারটি অক্ষরে লেখা। কিন্তু চার অক্ষরে লেখা গল্পটার আকার বিশাল। অ্যাডেনিন (A), গুয়ানিন (G), সাইটোসিন (C) ও থায়ামিন (T)- এই চারটি ক্ষারক জোড়ায় জোড়ায় থেকে তৈরি করে প্রতিটি ডিএনএ অণু। ডিএনএ অণুর সেটকে বলে জিনোম। এই জিনোমই নির্ধারণ করে আমাদের চুলের রঙ, উচ্চতা এমনকি আমাদের ভবিষ্যতের জেনেটিক রোগবালাই।
জিনোমের এই তথ্য উদ্ধারে বিজ্ঞানীরা আপ্রাণ চেস্টা করেছেন পুরো ১৯০০ শতক। ডিএনএ তে চারটি ক্ষারকের ক্রম বের করাই ছিলো তাদের লক্ষ্য। এই সিকোয়েন্স বের করার যুদ্ধে প্রথম সফলতার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে প্রায় ১০০ বছর। ১৯৯৫ সালে প্রথম সফলতা এসেছিলো ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের পূর্ণাঙ্গ সিকোয়েন্স করার মাধ্যমে। এরপর ব্যাকটেরিয়া, শৈবাল থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত মানুষের জিনোম সিকোয়েন্স বের হয় ২০০৩ সালে। তবে বিজ্ঞানীরা মানুষের সিকোয়েন্স বের করেই বসে নেই। রোগবালাই থেকে বাচার জন্য টিকা বা ওষুধ বের করার জন্য প্রতিনিয়ত বিজ্ঞানীরা নতুন গাছ বা প্রাণীর সিকোয়েন্সিং করে যাচ্ছেন।
১৯৭০ থেকে ১৯৮০ সালের দিকে ডিএনএ সিকোয়েন্স করতে ব্যবহার করা হতো ম্যাক্সাম গিলবার্ট পদ্ধতি। এ পদ্ধতি একাধারে ছিলো জটিল এবং প্রচুর ব্যয়বহুল। তবে তখনো প্রযুক্তির উন্নয়ন না ঘটায় সহজ পদ্ধতি বের করা সম্ভব হয়নি। এই পদ্ধতির বিক্রিয়ায় একবারে ২৫০ থেকে ৫০০ ক্ষারক জোড় বের করা সম্ভব ছিলো। তাহলে একবার ভাবুন তো তিন বিলিয়ন ক্ষারক জোরের ক্রম জানতে বিজ্ঞানীদের কত সময়, পরিশ্রম এবং অর্থ লেগেছে।
তবে এখন সিকোয়েন্সিং এ ব্যবহার করা হয় সবচেয়ে উন্নত প্রযুক্তি এনজিএস বা নেক্সট জেনারেশন সিকোয়েন্সিং। এই পদ্ধতিতে অনেকগুলো বিক্রিয়া একসাথে সমান্তরাল ভাবে হয়,তাই সময় খুব কম লাগে। ২০০১ সালে মানুষের জিনোম সিকোয়েন্স করতে খরচ হলো ১০০ মিলিয়ন ডলার। ২০১৫ সালে এসে সেই খরচ দাড়িয়েছে মাত্র ১২৪৫ ডলারে।
একবার যদি কোনো প্রজাতির পূর্ণাঙ্গ সিকোয়েন্স করা যায় তাহলে অনেক তথ্য আমাদের হাতে চলে আসে। মানুষের কথাই ধরা যাক একজন মানুষের সাথে আরেকজন মানুষের সিকোয়েন্স পার্থক্য মাত্র ০.১%। এই ০.১% পার্থক্যেই একজনের সাথে অন্যজনের কত অমিল। এই পার্থক্য না থাকলে পৃথিবীর সব মানুষকে দেখতে একইরকম লাগতো। তবে এই ০.১% এর মধ্যেই লুকিয়ে থাকতে পারে জেনেটিক রোগ। নির্দিষ্ট জিনের ত্রুটি খুজে পেলে খুব সহজেই চিকিৎসা করা যায়।
সম্প্রতি করোনা ভাইরাসের যে আতংক তা কিভাবে মানবদেহে ক্ষতি করে এবং কিভাবে বাদুরের মুখ থেকে উৎপন্ন হলো পুরোটাই জানা যায় জিনোম সিকোয়েন্স এর মাধ্যমে। ভ্যাক্সিন আবিষ্কার করার ক্ষেত্রে কিভাবে মানবদেহে এন্টিবডি তৈরি হবে তাও জানা যায় এই পদ্ধতিতেই। তাহলে এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝে গেছেন কেনো বিজ্ঞানীরা শত বছর ধরে নিরলস এই জিনোম প্রযুক্তিতে কাজ করে গেছে।
জিনোম সিকোয়েন্সিং এ বাংলাদেশেরও ভূমিকা আছে। বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যে পাট, ইলিশ ও ব্লাক বেঙ্গল ছাগলের সিকোয়েন্স করে ফেলেছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশের মত গরীবদেশে এমন প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করে লাভ কি। লাভ অবশ্যই আছে। পাট আমাদের দেশী পণ্য। পাটের নতুন মিউটেটেড জাত খোজা হচ্ছে, যার আঁশ থেকে কাপড় বোনার মিহি সুতা পাওয়া যাবে। কাজটির জন্য প্রথমে পাটের জিনে ইচ্ছাকৃত পরিবর্তন আনা হচ্ছে। পরিবর্তনকৃত জাতগুলোকে মাঠ পর্যায়ে পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে কোন জাতের পাটে আঁশ বেশি হয়। এরপর কাঙ্ক্ষিত জিন কোনো উন্নয়নশীল পাটে ঢুকিয়ে দিলেই ভালো ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে। এভাবে উৎপাদন অনেকগুণ বাড়ানো সম্ভব।
জিনোম সিকোয়েন্স তথ্যের নিরাপত্তার জন্য তর্ক বির্তকেরও শেষ নেই। আমরা যেখানে সামান্য মোবাইলের নিরাপত্তার জন্য পাসওয়ার্ড ব্যবহার করি সেখানে নিজেদের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান তথ্য অন্যের কাছে উন্মুখ করা কতটা নিরাপদ ভাববার বিষয়। তবে যতই বিতর্ক থাক চার অক্ষরের জীবনের গল্প পড়তে পারা এ প্রযুক্তি যে, দিনদিন আরো উন্নত হবে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

আপনার এই চমৎকার লেখা পড়ে আমরা সত্যিই মুগ্ধ। আপনি যেভাবে জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের গুরুত্ব এবং এর প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। আপনার লেখায় বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির অগ্রগতি, বিশেষ করে বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এই প্রযুক্তির ব্যবহার এবং লাভ সম্পর্কে যে দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা হয়েছে, তা অত্যন্ত তথ্যবহুল এবং উদ্বুদ্ধকারী।আপনার এই ব্যতিক্রমী কাজে অভিনন্দন এবং ধন্যবাদ। ভবিষ্যতেও এমন আরও চমৎকার লেখা প্রত্যাশা করছি।

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

Related Articles
অন্যান্যএসো শিখি

গবেষণা আর্টিকেলের প্রকারভেদ

গবেষণার উদ্দেশ্য এবং বিষয়বস্তু অনুযায়ী রিসার্চ আর্টিকেলের বিভিন্ন ধরণ রয়েছে। নতুন গবেষকদের...

অন্যান্য

ভিসি – প্রোভিসি: কেমন হওয়া উচিত!

প্রফেসর- ড. মোহা: ইয়ামিন হোসেন ফিশারীজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। এখনই সময় উচ্চ-মানসম্পন্ন...

অন্যান্যউচ্চশিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ

বিশ্বব্যাপী পিএইচডি ও পোস্টডক পজিশনের আপডেট!

লেখক- আজিজুল হক ইয়েংনাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক। আজকাল অনেকেই উচ্চশিক্ষা বা পোস্টডক...

অন্যান্য

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওয়েবমেট্রিক্স র‍্যাঙ্কিং ও পিছিয়ে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর করণীয়!

প্রফেসর ড মোহাঃ ইয়ামিন হোসেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। সাম্প্রতিক ওয়েবমেট্রিক্স র‍্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের মধ্যে...

অন্যান্য

বাংলাদেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠান: ব্যবস্থাপনা, সংস্কৃতি ও ফান্ডিংয়ে বিপ্লবের আহ্বান!

প্রফেসর ড. মোহা: ইয়ামিন হোসেন ফিশারীজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশের ভবিষ্যত উন্নয়নের...

Three Columns Layout

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact

biggani.org❤️gmail.com

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

বিজ্ঞানী অর্গ (biggani.org) বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে গবেষণা ও বিজ্ঞান নিয়ে বাংলা ভাষায় তথ্য ও সাক্ষাৎকার প্রচার করে – নবীনদের গবেষণা ও উচ্চশিক্ষায় প্রেরণা দেয়া হয়।

যোগাযোগ:

biggani.org@জিমেইল.com

biggani.org, a community of Bangladeshi scientists, shares interviews and information about researchers and scientists in Bengali to inspire young people in research and higher education.