রহিম একজন সাধারণ চাকরিজীবী। স্বাস্থ্য নিয়ে তার দুশ্চিন্তা নতুন কিছু নয়, তবে সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত বিভিন্ন খাদ্যসংক্রান্ত তথ্য তাকে আরও বিভ্রান্ত করছে।
“অর্গানিক খাবারই নাকি সবচেয়ে ভালো, সুপারফুড না খেলে শরীরের ক্ষতি হবে, আর নিয়মিত ডিটক্স না করলে শরীরে বিষ জমবে!” – এই সব কথা শুনে রহিম সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি আর বাজারের সাধারণ খাবার খাবেন না। তিনি খুঁজতে থাকলেন ‘অর্গানিক’ তকমা লাগানো সবজি, ‘সুপারফুড’ নামে বিক্রি হওয়া খাবার, আর সপ্তাহে অন্তত একবার ‘ডিটক্স ডায়েট’ অনুসরণ করবেন।
কিন্তু কিছুদিন পরই রহিম বুঝতে পারলেন, এই বিশেষ খাবারগুলো কেনার জন্য তার খরচ বেড়ে যাচ্ছে কয়েক গুণ। তবুও তিনি মনে করলেন, স্বাস্থ্যই যদি না থাকে, তাহলে টাকা দিয়ে কী হবে? কিন্তু কয়েক মাস পরেও তার শারীরিক অবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন দেখা গেল না। বরং তিনি টের পেলেন, অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ের কারণে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খাতে ব্যয় কমাতে হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত, তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন—সময় এসেছে বিজ্ঞাপনের মোহ কাটিয়ে প্রকৃত বিজ্ঞান ও বাস্তবতার আলোকে চিন্তা করার। রহিমের মতো আরও অনেকেই এখন এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন।
অর্গানিক খাবার: সত্য নাকি বিভ্রান্তি?
‘অর্গানিক’ শব্দটি শুনলেই আমাদের মনে হয়, এটি রাসায়নিক মুক্ত, সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক এবং অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর। তবে বিজ্ঞান কী বলে?
পুষ্টিবিদ ও গবেষক ড. আবদুল কাদের বলেন,
“অর্গানিক খাবার মানেই যে তা বেশি পুষ্টিকর বা স্বাস্থ্যকর, এর সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। হ্যাঁ, এতে কিছু ক্ষেত্রে রাসায়নিক কম থাকতে পারে, তবে এর পুষ্টিগুণ সাধারণ কৃষিপদ্ধতিতে উৎপাদিত খাবারের চেয়ে খুব একটা আলাদা নয়।”
গবেষণা বলছে, অর্গানিক ও সাধারণ কৃষির মধ্যে পুষ্টিগুণের পার্থক্য খুবই সামান্য। আমেরিকার স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় দেখা গেছে, অর্গানিক খাবারের পুষ্টিগুণ সাধারণ খাবারের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি নয়। তাছাড়া, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) মতে, অর্গানিক খাদ্য উৎপাদন করতে যে পরিমাণ জমি ও পানি প্রয়োজন, তা প্রচলিত কৃষির তুলনায় বেশি, যা খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটি চ্যালেঞ্জ।
তবে কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে অর্গানিক খাবার বেছে নেওয়ার যৌক্তিকতা থাকতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, রাসায়নিক কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে কিছু খাবার দূষিত হতে পারে। কিন্তু শুধুমাত্র ‘অর্গানিক’ তকমা দেখে দ্বিগুণ দাম দিয়ে খাবার কেনার আগে বিজ্ঞানসম্মত যুক্তি জানা জরুরি।
সুপারফুড: বিজ্ঞানের চেয়ে বেশি মার্কেটিং?
বেশ কয়েক বছর ধরে ‘সুপারফুড’ শব্দটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ব্লুবেরি, অ্যাভোকাডো, কুইনোয়া, চিয়া সিড – এই সব খাবারকে ‘সুপারফুড’ বলে দাবি করা হয়। কিন্তু বিজ্ঞান কি বলে?
যুক্তরাজ্যের খাদ্য বিজ্ঞানী ড. রবার্ট লস্টিগ বলেন,
“সুপারফুড বলতে কিছু নেই। এটি একটি মার্কেটিং টার্ম। হ্যাঁ, কিছু খাবারে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট বেশি থাকতে পারে, কিন্তু এর মানে এই নয় যে, এগুলো অন্যসব খাবারের তুলনায় অসাধারণ বা অতিপ্রয়োজনীয়।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুপারফুড হিসেবে প্রচারিত অনেক খাবারের পুষ্টিগুণ ভালো, কিন্তু তেমনি সাধারণ খাবারেও পর্যাপ্ত পুষ্টিগুণ রয়েছে। যেমন, ব্লুবেরির পরিবর্তে কালোজাম বা পেয়ারা খাওয়া যায়, যা সস্তায় পুষ্টি সরবরাহ করতে পারে। বাংলাদেশের খাদ্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্থানীয় ফলমূল, যেমন আম, কাঁঠাল, কলা, পেয়ারা—এসব খাবারেও প্রচুর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও ভিটামিন রয়েছে, যা সুপারফুডের বিকল্প হতে পারে।
ডিটক্স ডায়েট: শরীর কি আসলেই বিষমুক্ত করতে হয়?
‘ডিটক্স’ – শব্দটি শুনলেই মনে হয়, আমাদের শরীরে যেন প্রচুর বিষ জমেছে এবং সেটি বের করা জরুরি। কিন্তু আসলেই কি আমাদের শরীর বিষে ভরে যায়?
হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের ড. মাইকেল হ্যালপার্ন বলেন,
“আমাদের লিভার ও কিডনি শরীরের স্বাভাবিক ডিটক্সিফিকেশন করে। আলাদা করে ডিটক্স ডায়েট বা জুস ডায়েট অনুসরণ করা বিজ্ঞানের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় নয়।”
অর্থাৎ, নিয়মিত স্বাস্থ্যকর খাবার ও পানি পান করলেই আমাদের শরীর স্বাভাবিকভাবে ক্ষতিকর পদার্থ বের করে দিতে সক্ষম। বাংলাদেশের পুষ্টি বিশেষজ্ঞ ড. ফারহানা রহমান বলেন,
“ডিটক্স ডায়েটের নামে অনেক সময় পানির মাত্রা এতটাই কমিয়ে দেওয়া হয় যে, এটি শরীরের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তাই ভারসাম্যপূর্ণ খাদ্যাভ্যাসই সবচেয়ে নিরাপদ।”
খাদ্য বিজ্ঞানের আসল সত্য
খাদ্য নিয়ে বিজ্ঞাপন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত তথ্য যাচাই করা জরুরি। ব্যবসার স্বার্থে অনেকে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে দেন।
বিশ্বখ্যাত পুষ্টিবিদ ড. মারিয়ান নেস্টলে বলেন,
“সুষম খাদ্য গ্রহণই সবচেয়ে কার্যকর। একদিক থেকে শুধু সুপারফুড বা ডিটক্স ডায়েটের পেছনে ছুটলে তা স্বাস্থ্যের জন্য লাভজনক নাও হতে পারে।”
রহিম এখন বুঝতে পেরেছেন, বিজ্ঞাপনের চাপে পড়ে বেশি দামি ‘অর্গানিক’, ‘সুপারফুড’, বা ‘ডিটক্স’ ডায়েট অনুসরণ করার দরকার নেই। বরং সঠিক পুষ্টিবিজ্ঞান জেনে সাধারণ স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া এবং সুস্থ জীবনধারা অনুসরণ করাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
আপনিও কি সুপারফুড বা ডিটক্স ডায়েট অনুসরণ করেন? নাকি সাধারণ খাবারকেই বেশি কার্যকর মনে করেন? মতামত জানাতে ভুলবেন না!
References:
https://bangla.bdnews24.com/world/article440419.bdnews
Leave a comment