স্বাস্থ্য ও পরিবেশ

মাছরাঙার মাছ ধরা

Share
Share

প্রধানত এশিয়া, আফ্রিকা, ও অস্ট্রালেশিয়ার ক্রান্তীয় অঞ্চল এবং গ্রেট ব্রিটেনে একশোরও অধিক মাছরাঙা পাখির প্রজাতি পাওয়া যায়। “মাছরাঙা” নামে “মাছ” শব্দটা থাকলেও সকল প্রজাতির মাছরাঙা পাখি মাছ খায় না ! এশিয়া, আফ্রিকা, ও অস্ট্রালেশিয়ার ক্রান্তীয় অঞ্চলের নব্বই শতাংশ মাছরাঙা পাখি মাছের বদলে অরণ্যে ও বনভূমিতে সাপ, ইঁদুর, ও অন্যান্য প্রজাতির পাখিদের বাচ্চা শিকার করে খায়। সেখানকার মাত্র দশ শতাংশ মাছরাঙা পাখি এবং গ্রেট ব্রিটেনের স্থানীয় মাছরাঙা পাখিদের মধ্যেই ছোটো ছোটো মাছ শিকার করে খাওয়ার অভ্যাস দেখা যায়। একটি মাছরাঙা প্রতিদিন নিজের ওজনের প্রায় সম পরিমাণ ছোটো মাছ খায় যার সংখ্যা গ্রীষ্মকালে শীতকাল অপেক্ষা কিছু বেশী – প্রায় পাঁচ হাজার ! সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে যে, একটি মাছরাঙাকে নিজের পেট ভরাতে প্রতিদিন কতটা পরিশ্রম করতে হয় !

যে জলাশয়ে মাছরাঙা মাছ শিকার করবে বলে ঠিক করে, সেই জলাশয়ের কাছাকাছি কোনো গাছের ডালে কিছুক্ষণ বসে থেকে জলে সাঁতার কেটে চলা কোন্ মাছটিকে সে ধরবে তা দেখে ঠিক করে নেয়, এবং নিজের ধড়কে স্থির রেখে কিন্তু মাথাটিকে কয়েকবার এগিয়ে-পিছিয়ে মাছটি জলাশয়ের ঠিক কত গভীরতায় সাঁতার কাটছে তা বুঝে নেয়। মাছরাঙার চোখের বিশেষত্ব হলো যে তার চোখের রেটিনা অংশে দুটি অঞ্চল আছে যেখানে আলোক সংবেদী কোষ খুব বেশী ঘনত্বে উপস্থিত থাকে – একটি হলো কেন্দ্রীয় ফোভিয়া অঞ্চল ও অপরটি হলো সহায়ক ফোভিয়া অঞ্চল। গাছের ডালে বসে জলাশয়ের মাছকে পর্যবেক্ষণ করার সময়ে মাছরাঙা তার চোখের কেন্দ্রীয় ফোভিয়া অঞ্চলটিকে কাজে লাগায়। এরপর মাছরাঙা তার মাথাটিকে তার ধড়ের অগ্রভাগে রেখে গাছের ডাল থেকে সেই জলাশয়ের উদ্দেশ্যে ঝাঁপ দেয় এবং ঝাঁপ দেওয়ার পরে বাতাসে থাকার সময়েই কয়েকবার ডানা ঝাপটে নিয়ে নিজের গতিবেগ বাড়িয়ে নেয়।

বাতাস থেকে জলাশয়ের জলে প্রবেশ করার সময়ে মাছরাঙা তার ডানাদুটিকে দেহের দুপাশে শক্ত করে গুটিয়ে রাখে এবং সর্বাধিক ঘন্টায় পঁচিশ মাইল গতিবেগে জলে প্রবেশ করে। চঞ্চু ও মাথা সমেত মাছরাঙা পাখির ধড়টিকে প্রকৃতি এক বিশেষ আকৃতি দিয়েছে যাকে বলা হয় “এয়ারোডায়নামিক আকৃতি” (মিসাইল বা ক্ষেপণাস্ত্র যেমন হয়) যে কারণে জলে প্রবেশ করার সময়ে জলকণা সমূহ মাছরাঙাকে তার গতির বিরূদ্ধে খুব একটা বাধা দেয় না, ফলস্বরূপ মাছরাঙা বাতাস থেকে জলে প্রবেশ করার সময়ে জলরাশি বিশেষ ছলকে ওঠে না, আর জলরাশিতে খুব কম আন্দোলন হওয়ায় মাছটি সতর্ক হতে পারে না ! মাছরাঙার চোখে তিনটি পাতা থাকে যেগুলির মধ্যে তৃতীয় পাতাটি স্বচ্ছ ও “নিকটিটেটিঙ পর্দা” নামে খ্যাত। সাঁতারুরা জলে সাঁতার কাটার সময়ে যেমন বিশেষ স্বচ্ছ চশমা ব্যবহার করেন, তেমনই জলে প্রবেশ করার পর মাছরাঙার চোখের নিকটিটেটিঙ পর্দা তার চোখকে ঢেকে রেখে তাকে চোখ খুলে রাখতে সাহায্য করে, কারণ মাছটির গতিবিধিতে নজর রাখার জন্য জলের মধ্যে প্রবেশ করার পরেও মাছরাঙার চোখ খুলে রাখা জরুরি। জলের মধ্যে দৃষ্টি সাধারণত ঝাপসা হয়ে যায়, তাই জলের মধ্যেও সূক্ষ্ম দৃষ্টি বজায় রাখার জন্য মাছরাঙা তার চোখের কেন্দ্রীয় ফোভিয়া অঞ্চলটির বদলে সহায়ক ফোভিয়া অঞ্চলটিকে ব্যবহার করে। অনেকেরই ধারণা যে মাছরাঙা তার ধারালো ছোরার মত চঞ্চুর সাহায্যে জলের মাছটিকে বিদ্ধ করে, কিন্তু না, মাছরাঙা মাছকে বিদ্ধ করে না, বরং সে তার ঊর্ধ্ব চঞ্চু ও নিম্ন চঞ্চুর সাহায্যে মাছটিকে পাকড়াও করে ও চোখের পলকে মাছটিকে জল থেকে গাছের ডালে তুলে আনে। জল থেকে মাছটিকে তুলে আনার সময়ে মাছরাঙা মাছ সমেত তার চঞ্চুকে আগে এবং তার মাথা ও ধড়কে পরে জল থেকে বার করে আনে যাতে চঞ্চুতে ধরে রাখা মাছটির জলে পালিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কম হয় ! এত কান্ডের পরে একটি ছোটো মাছ মাছরাঙার পেটে যায় ! বুঝতেই পারছেন যে এইভাবে মাছরাঙা একটি একটি করে প্রায় পাঁচ হাজার ছোটো মাছ প্রতিদিন শিকার করে!

Share
Written by
Diganta Paul -

জন্ম: ১৯৮৯ সালে ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হাওড়া জেলায়। শিক্ষা: প্রাথমিক, মাধ্যমিক, ও উচ্চ-মাধ্যমিক শিক্ষা হাওড়া জিলা স্কুলে। এরপর কলকাতার "সেইন্ট থমাস্ কলেজ অফ এঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনলজি" কলেজ থেকে বৈদ্যুতিক কারিগরিবিদ্যা নিয়ে প্রযুক্তিতে স্নাতক (B.Tech. in Electrical Engineering)। পেশা: তথ্যপ্রযুক্তি পেশাদার (IT Professional)। নেশা: বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা নিয়ে পড়াশোনা ও চিন্তাভাবনা। এছাড়াও বিভিন্ন পত্রিকায় বিজ্ঞান প্রবন্ধ, বিজ্ঞান নিবন্ধ, কল্পবিজ্ঞান ভিত্তিক গল্প, কল্পবিজ্ঞান কবিতা, গাণিতিক কল্পকাহিনী, বিজ্ঞান নাটক, ও বিজ্ঞান কবিতা লেখা। প্রসার ভারতীর একজন বিজ্ঞান-কথিকা লেখক ও শিল্পী। উল্লেখযোগ্য পুরস্কার: বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ কর্তৃক প্রদত্ত অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি রৌপ্য পদক। প্রকাশিত বই: উদ্দীপনার খেলাঘর। যোগাযোগ: [email protected]

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

Related Articles
চিকিৎসা বিদ্যাস্বাস্থ্য ও পরিবেশ

আবহাওয়া বদল আর মাইগ্রেন: মাথাব্যথার সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক কী?

হঠাৎ আবহাওয়ার পরিবর্তন - যেমন তাপমাত্রার পরিবর্তন, ব্যারোমেট্রিক চাপের হ্রাস, বা দূষণ...

চিকিৎসা বিদ্যাস্বাস্থ্য ও পরিবেশ

বয়স ধীর বা দ্রুত বাড়ে কেন? রাজনীতি ও বৈষম্যের অদৃশ্য প্রভাব

বিভিন্ন দেশে বার্ধক্যের গতি কীভাবে ভিন্ন হয় এবং রাজনীতি, বৈষম্য এবং সামাজিক...

চিকিৎসা বিদ্যাস্বাস্থ্য ও পরিবেশ

ডিজিটাল সেতুবন্ধন: গ্রাম থেকে বিশ্বমানের স্বাস্থ্যসেবায় বাংলাদেশের যাত্রা

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, টেলিমেডিসিন এবং উইকিমেডিক্সের মতো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে বাংলাদেশ কীভাবে গ্রামীণ...

পরিবেশ ও পৃথিবীস্বাস্থ্য ও পরিবেশ

বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য ও নীল অর্থনীতি।

বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য এবং নীল অর্থনীতি অন্বেষণ করুন — সুন্দরবন এবং সামুদ্রিক সম্পদ...

চিকিৎসা বিদ্যাস্বাস্থ্য ও পরিবেশ

গাঁজনের জাদু: ফার্মান্টেড খাবারের গুণাগুণ ও গুরত্ব

দই, কিমচি এবং রুটির মতো গাঁজানো খাবারের স্বাস্থ্য উপকারিতা, প্রস্তুতি প্রক্রিয়া এবং...

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact:

biggani.org@জিমেইল.com

সম্পাদক: ড. মশিউর রহমান

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

Copyright 2024 biggani.org