(এই প্রবন্ধটি লিখেছেন মার্টিন এ. শোয়ার্জ এর লিখিত। মার্টিন এ. শোয়ার্টজ একজন প্রখ্যাত মার্কিন কোষ জীববিজ্ঞানী এবং গবেষক। তিনি কোষের আঠারোপনা (cell adhesion) ও যান্ত্রিক উদ্দীপনা রূপান্তর (mechanotransduction) নিয়ে কাজের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। তার গবেষণা ক্যান্সার, হৃদরোগ ও অন্যান্য রোগের চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানিক গবেষণার জার্নাল সেল এ প্রকাশতি এই লেখাটি বাংলাতে অনুবাদ করা হল বিজ্ঞানী অর্গ এর পাঠকদের জন্য )
আমি সম্প্রতি বহু বছর পর একজন পুরনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা করলাম। আমরা একই সময়ে পিএইচডি শিক্ষার্থী ছিলাম, যদিও আমাদের গবেষণার ক্ষেত্র ভিন্ন ছিল। তিনি পরে গবেষণা ছেড়ে হার্ভার্ড ল স্কুলে ভর্তি হন এবং বর্তমানে একজন শীর্ষ পরিবেশবাদী আইনজীবী। কথোপকথনের এক পর্যায়ে তিনি বললেন, গবেষণা ছেড়ে দেওয়ার প্রধান কারণ ছিল প্রতিদিন নিজেকে বোকা মনে হওয়া। কয়েক বছর ধরে এই অনুভূতির পর, তিনি অন্য কিছু করার সিদ্ধান্ত নেন।
আমি বরাবরই তাকে অত্যন্ত মেধাবী মনে করতাম এবং তার পরবর্তী ক্যারিয়ারও তা প্রমাণ করে। কিন্তু তার এই কথা আমাকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। আমি ভাবতে থাকলাম এবং হঠাৎ উপলব্ধি করলাম—বিজ্ঞান আমাকে বোকা অনুভব করায়। তবে আমি এটির সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আসলে, আমি নতুন কিছু জানার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে এমন পরিবেশ তৈরি করি যেখানে আমি বোকা অনুভব করি। এটি আমার কাছে গবেষণার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বলে মনে হয়।
বিজ্ঞান এবং ‘বোকা’ অনুভূতির সম্পর্ক
বেশিরভাগ শিক্ষার্থী স্কুল বা কলেজে বিজ্ঞান ভালোবাসার কারণ হলো তারা এতে ভালো ফলাফল করতে পারে। সঠিক উত্তর জানা মানেই ভালো গ্রেড পাওয়া এবং এতে তারা নিজেদের বুদ্ধিমান বলে ভাবতে পারে। কিন্তু পিএইচডি গবেষণা সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। এখানে কোনো প্রস্তুতকৃত উত্তর নেই। গবেষণার প্রকৃতি এমন যে এটি অজানার মুখোমুখি হতে বাধ্য করে।
আমি যখন পিএইচডি করছিলাম, গবেষণা প্রশ্ন তৈরি করা এবং পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ করা আমাকে হতবাক করত। আমি আমার বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের কাছে সাহায্যের জন্য যেতাম। একবার নোবেল বিজয়ী হেনরি টাউবে আমাকে বললেন, তিনি আমার সমস্যার সমাধান জানেন না। আমি তখন বুঝলাম—এটাই গবেষণার আসল সৌন্দর্য। যখন কোনো প্রশ্নের উত্তর কেউ জানে না, তখন সেটাই প্রকৃত গবেষণার ক্ষেত্র হয়ে ওঠে।
এখানেই গবেষণার মূল আকর্ষণ। এটি আমাদের শেখায় কীভাবে অজানার মধ্যে পথ খুঁজতে হয় এবং নিজেরাই সমাধান বের করতে হয়। এই উপলব্ধি আমাকে গবেষণার প্রতি আরও বেশি আগ্রহী করে তোলে।
‘উৎপাদনশীল বোকামি’ কী?
আমি মনে করি, আমাদের পিএইচডি প্রোগ্রামগুলো শিক্ষার্থীদের দুটি বড় দিক থেকে সাহায্য করতে ব্যর্থ হচ্ছে:
১. গবেষণা কতটা কঠিন তা তাদের যথেষ্ট ভালোভাবে বোঝানো হয় না। আমরা কখনোই নিশ্চিত হতে পারি না যে আমরা সঠিক প্রশ্ন করছি বা সঠিক পরীক্ষা পরিচালনা করছি কিনা। গবেষণা মানে অজানার মধ্যে কাজ করা, এবং এটি সহজ নয়। গবেষণা মানে একটি জটিল ধাঁধার সমাধান খোঁজা যেখানে পূর্ববর্তী কোনো নির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা নেই।
২. আমরা শিক্ষার্থীদের ‘উৎপাদনশীল বোকা’ হওয়ার গুরুত্ব শেখাই না। প্রকৃত গবেষণা করতে হলে নিজেকে বারবার বোকা অনুভব করা স্বাভাবিক। কারণ নতুন কিছু জানার জন্য অজানার মুখোমুখি হওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। এটি একটি মানসিক অবস্থা যেখানে গবেষকরা নিজেদের সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়ে আরও গভীরে অনুসন্ধান চালিয়ে যান।
এই ‘উৎপাদনশীল বোকামি’ মানে সচেতনভাবে নিজের অজ্ঞতা স্বীকার করা এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে লেগে থাকা। বিজ্ঞান আমাদের ভুল করতে, শেখার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে, এবং প্রতিবার নতুন কিছু আবিষ্কার করতে দেয়। এটি গবেষকদের আত্মবিশ্বাসী করে তোলে যে, ব্যর্থতাই নতুন জ্ঞানের সূত্রপাত।
উপসংহার
যারা গবেষণায় আসেন, তারা সাধারণত স্কুল বা কলেজে বিজ্ঞান বিষয়ে খুবই ভালো ছিলেন। কিন্তু গবেষণার ক্ষেত্রে সঠিক উত্তর না জানা এবং অজানার মাঝে কাজ করার ক্ষমতা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যদি আমাদের ‘বোকামি’কে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করি, তাহলে আমরা আরও গভীরভাবে নতুন কিছু আবিষ্কার করতে পারব। গবেষণার প্রকৃত সৌন্দর্য এখানেই—অজানার মাঝে পথ খুঁজে নেওয়া এবং নতুন কিছু শেখা।
গবেষকদের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ করণীয়:
- অজানাকে ভয় না পেয়ে বরং সেটিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করুন।
- নতুন সমস্যার সমাধান খুঁজতে লেগে থাকুন, ধৈর্য ধরে অনুসন্ধান চালিয়ে যান।
- ব্যর্থতাকে শিক্ষা হিসেবে গ্রহণ করুন এবং প্রতিটি ভুল থেকে নতুন কিছু শিখুন।
- সহযোগিতার মাধ্যমে গবেষণার জটিলতাগুলো সহজ করুন।
এই নিবন্ধটি গবেষণা শিক্ষার্থীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা বহন করে। গবেষণার পথ সহজ নয়, তবে অজানা থেকে নতুন কিছু আবিষ্কারের মধ্যেই এর প্রকৃত আনন্দ লুকিয়ে আছে।
Leave a comment