এক গ্রীষ্মের সন্ধ্যায়, গোটা মহাকাশপ্রেমী বিশ্বের নজর ছিল ব্রিটেনের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে, যখন ড. নিক্কু মাধুসূদন ঘোষণা দিলেন এক যুগান্তকারী তথ্য: “মানব ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আমরা একটি বাসযোগ্য গ্রহে প্রাণের সম্ভাব্য চিহ্ন দেখেছি।” মুহূর্তেই এই সংবাদ বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করল—তবে, এই তথ্য সত্যিই কতটা নির্ভরযোগ্য?
ড. মাধুসূদন ও তাঁর গবেষকদলের দাবি, ১২৪ আলোকবর্ষ দূরের একটি গ্রহ K2-12b, যা ইতিপূর্বে একটি মহাসাগর-সমৃদ্ধ জগৎ হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল, সেখানে ডাইমিথাইল সালফাইড (Dimethyl Sulfide) নামের একটি জৈব অণু শনাক্ত হয়েছে। পৃথিবীতে এই অণুটি মূলত সামুদ্রিক শৈবাল ও অন্যান্য অণুজীবের পচনের ফলে তৈরি হয়, যা জীবনের উপস্থিতির শক্তিশালী ইঙ্গিত।
কিন্তু প্রশ্ন হলো—এটি সত্যিই কি জীবনের নিশ্চিত প্রমাণ?
ডাইমিথাইল সালফাইড: জীবনের নিশ্চিত চিহ্ন নাকি মহাজাগতিক প্রতারণা?
পৃথিবীতে ডাইমিথাইল সালফাইড জীবনের নিঃসৃত যৌগ হলেও, বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন—এটি প্রাণহীন প্রক্রিয়াতেও সৃষ্টি হতে পারে। যেমন:
- ২০২৪ সালের গবেষণায় দেখা গেছে, এই অণু ইন্টারস্টেলার মিডিয়াম (তারাদের মধ্যবর্তী গ্যাস ও ধূলিকণার মেঘে) পাওয়া গেছে।
- ২০২৩ সালে গবেষণাগারে আল্ট্রাভায়োলেট (UV) আলো দিয়ে একটি ডাইমিথাইল সালফাইড সদৃশ অণু তৈরি করা সম্ভব হয়েছে।
- এমনকি নির্জীব ধূমকেতুতেও এই অণুটি শনাক্ত হয়েছে।
এসব ঘটনা থেকে স্পষ্ট, কেবলমাত্র এই অণুর উপস্থিতি প্রাণের প্রমাণ হিসেবে দেখানো ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
গ্রহ K2-12b: একটি সম্ভাব্য নতুন পৃথিবী?
গ্রহ K2-12b পৃথিবীর পাঁচ গুণ ভরের এবং নেপচুনের চেয়ে ছোট, যা অবস্থান করছে তার তারা’র ‘গোল্ডিলক জোনে’—যেখানে তরল পানির অস্তিত্ব থাকা সম্ভব। ড. মাধুসূদনের গবেষণায় দেখা গেছে, K2-12b-এর বায়ুমণ্ডলে ডাইমিথাইল সালফাইডের পরিমাণ পৃথিবীর তুলনায় হাজার গুণ বেশি। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এখনো একে অনিশ্চিত আবিষ্কার হিসেবেই দেখছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতামত: বৈপ্লবিক কিন্তু সতর্ক হওয়া জরুরি
- ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাস্ট্রোবায়োলজিস্ট এডওয়ার্ড শ্বিইটারম্যান বলেন, “এটি একটি চমকপ্রদ সম্ভাবনা, কিন্তু আমরা এখনও যথেষ্ট প্রমাণ পাইনি।”
- ম্যাক্স প্লাঙ্ক ইনস্টিটিউটের গবেষক লরা ক্রেইডবার্গ বলেন, “যতক্ষণ না অসাধারণ দাবির জন্য অসাধারণ প্রমাণ মিলছে, ততক্ষণ নিশ্চিত হওয়া যাবে না যে, আমরা সত্যিই প্রাণ খুঁজে পেয়েছি।”
এমনকি NASA-ও এবারের গবেষণার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি, যদিও তারা পূর্বে K2-12b-তে মিথেন ও কার্বনের উপস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত বিবৃতি দিয়েছিল।
পরিসংখ্যান ও প্রেক্ষাপট
- বর্তমানে ৫,৫০০টিরও বেশি এক্সোপ্ল্যানেট শনাক্ত হয়েছে। তার মধ্যে মাত্র কয়েকটি গ্রহকে বাসযোগ্য বলে বিবেচনা করা হয়।
- James Webb Space Telescope (JWST) উৎক্ষেপিত হয় ২০২১ সালে, যার মাধ্যমে বর্তমানে প্রায় ৫০টিরও বেশি এক্সোপ্ল্যানেটের বায়ুমণ্ডল বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয়েছে। এদের মধ্যে K2-12b অন্যতম সম্ভাবনাময় গ্রহ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
শেষ কথা: বিজ্ঞানের পথে এগোতে হবে সতর্কতার সঙ্গে
বিজ্ঞান আবিষ্কার, সংশয় ও প্রমাণের পথে এগিয়ে চলে। প্রাণের সন্ধানের এমন সম্ভাবনা নিঃসন্দেহে যুগান্তকারী, কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হলে আরও যাচাই-বাছাই ও গভীর গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।
তাই শেষ প্রশ্ন থেকেই যায়—আমরা কি সত্যিই আর একা নই, নাকি আমাদের টেলিস্কোপ শুধুই একটি ভুল বার্তা পাঠাচ্ছে?
Leave a comment