নবীন প্রজন্মদের সাক্ষাৎকার সিরিজে এবার আমরা সাক্ষাৎকার নিয়েছি বিজ্ঞানী ড. অজয় কান্তি মন্ডল এর। তিনি বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) এ ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পদে কর্মরত আছেন । তার সাক্ষাৎকারটি পড়ুন:
প্রথমেই আপনার সম্বন্ধে আমরা জানতে চাই
বিজ্ঞানী ডট অর্গ কে অসংখ্য ধন্যবাদ আমাকে আমন্ত্রন জানানোর জন্য। সেই সাথে বিজ্ঞানী ডট অর্গ এর সকল দর্শক শ্রোতাদের জানাই আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা। আমি ড. অজয় কান্তি মন্ডল, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) এ ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পদে কর্মরত আছি।
ড. অজয় কান্তি মন্ডল এর কিছু অর্জনঃ ড. অজয় কান্তি মন্ডল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন শাস্ত্রে প্রথম শ্রেণিতে স্নাতক এবং ভৌত রসায়ন বিভাগ হতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। স্নাতকোত্তর শেষ করে তিনি কিছুদিন একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। এরপর ২০১৩ সালে বিসিএসআইআর এ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পদে যোগদান করেন। চীনের ফুজিয়ান অ্যাগ্রিকাচার এন্ড ফরেস্ট্রি ইউনিভার্সিটি থেকে ২০২২ সালে ম্যাটেরিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং এ ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। গবেষণায় অসাধারণ সাফল্যের জন্য ২০২০ সালে তিনি চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক ‘আউটস্ট্যান্ডিং ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টস অ্যাওয়ার্ড-২০২০’ অর্জন করেন। পাশাপাশি বহু ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করে পিএইচডি গবেষণার অংশ উপস্থাপন করে ড. মন্ডল পেয়েছেন এক্সিলেন্ট প্রেজেন্টেশন অ্যাওয়ার্ড। গবেষণার পাশাপাশি ড. মন্ডলের প্রিয় সখ লেখালেখি। সমাজে বিদ্যমান নানান অসঙ্গতি নিয়ে বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় (দৈনিক ইনকিলাব, প্রথম আলো, দ্যা ডেইলি স্টার সহ অন্যান্য পত্রিকায়) সম্পাদকীয় অংশে নিয়মিত তিনি লিখে থাকেন। লেখালেখিতে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি ‘বাংলাদেশ চায়না ইয়ুথ স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন’ কর্তৃক ‘আউটস্ট্যান্ডিং রাইটার অ্যাওয়ার্ড-২০২১’ অর্জন করেন। বর্তমানে তিনি একটি কন্যা সন্তান (নামঃ অয়ন্তিকা মন্ডল অন্তু) এর জনক।
আপনার গবেষনার বিষয় কি?
আমি মূলত মাল্টিফাংশনাল হাইড্রোজেল বা কম্পোজিট ম্যাটেরিয়াল সিন্থেসিস এর কাজ করে থাকি। এই হাইড্রোজেল সিন্থেসিসে রিনিউবেল ম্যাটেরিয়াল ও শিল্প কারখানার বর্জ্য বিশেষ করে লিগনিন (পেপার মিলের বর্জ্য) বা পরিত্যক্ত বিভিন্ন পদার্থ থেকে আহরিত লিগনোসেলুলোজিক (লিগনিন, সেলুলোজ এবং হেমিসেলুলোজ) ম্যাটেরিয়াল, কোলাজেন (ট্যানারি বর্জ্য) ইত্যাদি আহরণ করে সেগুলোকে হাইড্রোজেল তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে থাকি। এসকল হাইড্রোজেল মূলত ফ্লেক্সিজেবল ইলেক্ট্রনিক্স, এনার্জি স্টোরেজ ডিভাইস, পাওয়ার জেনারেটর, এন্টিব্যাক্টেরিয়াল, ড্রাগ ডেলিভারি, দূষিত পানি বিশুদ্ধকরন সহ বিভিন্ন ধরণের অ্যাডভান্সড এপ্লিকেশনে ব্যবহার করা যায়।
আপনার গবেষনার কাজগুলি কিভাবে আমাদের উপকৃত করছে কিংবা করবে?
আমি মূলত বর্জ্য পদার্থ কিংবা পরিত্যক্ত বিভিন্ন উপাদান থেকে হাইড্রজেল তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করি। যেটা মূলত ‘ওয়েস্ট টু ওয়েলথ’ কিংবা ‘গ্রিন এপ্রোচ’ বলা যেতে পারে। অর্থাৎ বর্জ্য কে ভ্যালুআবল প্রোডাক্টে রূপান্তরিত করা। আমাদের উদ্ভাবিত হাইড্রোজেল পরিবেশ দূষণকে অনেকাংশে কমিয়ে আনার পাশাপাশি বেশ কিছু এনার্জি রিলেটেড ডিভাইস তৈরি, মেডিকেল সেক্টর, সফট রোবটিক্স, সেন্সর, এন্টিব্যাক্টিরিয়াল সহ ডাই অ্যাডসরপশন-এ এই হাইড্রোজেলের ব্যবহার করা যাবে। বর্তমান বিশ্বে এখন এনার্জি ক্রাইসেস চলছে। এবং বর্তমান বিশ্ব রিনিউবেল এনার্জির দিকে এগুচ্ছে। আর এই রিনিউবেল এনার্জির ক্ষেত্রে আমার গবেষণা বড় একটা ভূমিকা রাখতে পারে।
এখানে দুই একটা পরিসংখ্যান উল্লেখ করা যেতে পারে। পেপার মিলে কাগজ উৎপাদনের সময় লিগনিন বাই-প্রোডাক্ট হিসেবে উৎপাদিত হয়। পরিসংখ্যান বলছে সারা বিশ্বে প্রতিবছর ৫০ মিলিয়ন মেট্রিক টন লিগনিন বাই-প্রডাক্ট হিসেবে উৎপন্ন হয়। যার বেশিরভাগই ঐ মিলে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কোথাও কোথাও আবার ইন্ডাস্ট্রি থেকে সরাসরি নদীতে ফেলা হয়। যেটা আদৌ পরিবেশ বান্ধব নয়।
ট্যানারি শিল্পে চামড়ার প্রক্রিয়াকরণের পূর্বে বিভিন্ন অংশ (কান, লেজ, পায়ের অংশ) কেটে বাদ দেওয়া হয়। এই বাদ দেওয়া অংশকে বলা হয় ‘raw trimming’ যেটা মূলত সরাসরি বর্জ্য হিসেবে কারখানায় ডাম্পিং করা হয়। যেটা পরিবেশ দূষণে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখে। এই ‘raw trimming’ এ ২০% কোলাজেন থাকে। পরিসংখ্যান বলছে ‘raw trimming’ থেকে প্রতি বছর ৬৫,০০০ টন কোলাজেন আহরণ করা সম্ভব।
আমাদের গবেষণায় এসব কারখানার বর্জ্য থেকে হাইড্রোজেল তৈরির প্রধান কাঁচামাল আহরণ করা হয়েছে। যেটা দূষণ কমানোর পাশাপাশি বিভিন্ন সেক্টরে আধুনিক প্রয়োগে বড় ভূমিকা রাখবে।
গবেষনা কাজের বিশেষ কোন অভিজ্ঞতা কি আমাদের সাথে শেয়ার করবেন?
মূলত গবেষক হিসেবে আমার ক্ষুদ্র আত্মপ্রকাশ হতে থাকে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে যাওয়ার পর থেকে। চীনাদের গবেষণার সার্বিক ব্যবস্থাপনা, বিশেষ করে গবেষণা পরিবেশ, অধ্যবসায়, ফান্ডিং ইত্যাদি আমাকে খুবই বিমোহিত করেছিল। এককথায় চীনাদের রিসার্চ কালচার এবং নিজের অধ্যবসায় আমার জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছে বলতে পারি।
একজন বিজ্ঞানীর কি কি গুণ থাকা প্রয়োজন বলে মনে করেন?
আমি মনে করি, গবেষণাধর্মী কাজগুলো একটু জটিল ধরনের হয় এবং মাঝেমধ্যে বেশ প্রতিকূল সময় যায়। এই প্রতিকূলতা পাড়ি দেওয়ার জন্য একজন গবেষককে ধৈর্য ধারণ করতে হবে। এজন্য একজন গবেষকের মধ্যে সবার আগে কঠোর অধ্যবসায় থাকতে হবে। কোন কাজ পরবর্তী সময়ের জন্য ফেলে রাখলে সেটার সফলতা আসেনা। সময়ের কাজ সর্বদা সময়ের ভিতরেই করার মানসিকতা থাকতে হবে।
নিজের গবেষণার ক্ষেত্র অনুযায়ী নিত্য নতুন প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধ পড়ার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। নিত্যনতুন উদ্ভাবনের প্রতি নিজেকে সর্বদা কৌতূহল করে তুলতে হবে। সৃজনশীল মনোভাব একজন গবেষককে অনেক বেশি সফলতা এনে দিতে পারে। একজন গবেষকের নিত্য নতুন গবেষণার ক্ষেত্র তৈরি করতে সদ্য প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধ পড়ার পাশাপাশি নিজের সৃজনশীল চিন্তাশক্তি দ্বারা নিজের উদ্ভাবনী ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে গবেষণার ক্ষেত্র তথা রূপরেখা সৃজন করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
বাংলাদেশের তরুণ শিক্ষার্থী যারা বিজ্ঞানে কাজ করতে চায় – তাদের জন্য আপনার কোন ম্যাসেজ কিংবা বার্তা কি?
প্রথমে আমি বলতে চাই, একজন তরুণ শিক্ষার্থী’র মধ্যে সবার আগে জানার তীব্র আকাঙ্ক্ষা থাকতে হবে। সেই আকাঙ্ক্ষাই তাকে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষে পৌঁছে দিতে পারবে। সাম্প্রতিক বিশ্বের সঙ্গে তাল রেখে একমাত্র ক্রিয়েটিভ থিঙ্কিং এ ক্ষেত্রে ভালো ফল দেবে। এক্ষেত্রে তাকে অবশ্যই একজন ভালো ‘মেন্টর’ এর তত্ত্বাবধায়নে থাকতে হবে। যিনি ঐ তরুণ শিক্ষার্থীর জানার আকাঙ্ক্ষা পূরণের পাশাপাশি তাকে তার সঠিক লক্ষে পৌঁছাতে সাহায্য করবেন।
বিজ্ঞানি ডট অর্গ এর নিয়মিত দর্শক শ্রোতাদের ধন্যবাদ জানাই। যে যার অবস্থানে থেকে সুস্থ থাকবেন এটাই প্রত্যাশা।
আপনার ইমেইল ঠিকানা: [email protected]
আপনার ওয়েবসাইট : https://scholar.google.com/citations?user=ChISMesAAAAJ&hl=en
আমরা বিজ্ঞানী অর্গের পক্ষ থেকে ড. অজয় কান্তি মন্ডল এর উত্তোরত্তর সাফল্য কামনা করি। তিনি আমাদের নবীন গবেষকদের জন্য এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
Leave a comment