কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানতুন প্রযুক্তি

ডেমিস হাসাবিসের নতুন অভিযান: এআই-এর হাত ধরে রোগমুক্তির স্বপ্ন

Share
Share

লন্ডনের এক ছিমছাম সকালে, যখন শহরের ওপর হালকা কুয়াশা ঝুলে থাকে, তখন এক কিশোর ছেলেকে দেখা যেত তার ডেস্কে গভীর মনোযোগে বসে থাকতে। তার সামনে দাবার বোর্ড, পাশে কম্পিউটার, আর মাথার ভেতর এক অদৃশ্য বিশ্ব—যেখানে চিন্তা আর সম্ভাবনার কোন সীমানা নেই। তার নাম ডেমিস হাসাবিস। আজকের আমাদের গল্পের নায়কই এই হাসাবিস। বাংলাতে নামটি একটু অদ্ভুত শোনালেও এটিই তার নাম।  

শৈশব থেকেই হাসাবিস ছিলেন অনেক প্রতিভাধর। ১৩ বছর বয়সে তিনি হয়ে যান দাবা মাস্টার। কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের দুনিয়াতেও সমান পারদর্শী। ছোট ছোট গেম তৈরি করে নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন। তার মনে সবসময় ঘুরে বেড়াত এক প্রশ্ন— মানুষের মস্তিষ্কের মতো চিন্তা করতে পারে এমন একটি যন্ত্র তৈরি করা সম্ভব কি না?

সময় এগিয়ে চলল। পড়াশোনার পর্ব শেষ করে তিনি গেম ডিজাইন, নিউরোসায়েন্স বা স্নায়বিজ্ঞান এবং এআই-এর দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন। তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল একটি মাইলফলক মুহূর্ত, আলফাগো (AlphaGo)।

২০১৬ সাল। সারা পৃথিবীর চোখ আটকে ছিল এক অদ্ভুত ম্যাচে। গো নামে একটি খেলার আয়োজন করেছিল এই প্রতিষ্ঠানটি। জাপানে “ইয়ি গো”, চীনে “ওয়ে চি” নামে পরিচিত) হলো বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন বোর্ড গেম। বাংলাদেশের ষোলগুঠি এর সাথে কিছুটা মিল থাকলেও এই খেলাটি অনেক জটিল। সেই অনুষ্ঠানে একদিকে গো খেলার কিংবদন্তি লি সেডোল, আরেকদিকে AlphaGo—হাসাবিসের বানানো একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সিস্টেম।

প্রতিযোগীতার মাঝপথে AlphaGo এমন একটি চাল দিল, যা গো-র শতবর্ষের ইতিহাসে কেউ কখনো দেখেনি। সবাই হতবাক! লি সেডোল পর্যন্ত মুহূর্তের জন্য থমকে গিয়েছিলেন। দর্শকরা চুপচাপ। এটা ছিল কোনো মানুষ নয়, বরং একটি মেশিনের সৃষ্ট চাল। ডেমিস হাসাবিস বুঝলেন—এটা কেবল একটি খেলা নয়। এটা এক নতুন যুগের শুরু। সেই খেলায় এই ঝানু খেলোয়ার হার মানলো আলফাগো এর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কাছে। 

এআই কেবল মানুষের মতো ভাবতে পারে না, বরং মানুষের চিন্তাকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। আর এই উপলব্ধি তাকে নিয়ে গেল আরও বড় এক স্বপ্নের পথে—মানুষের জীবন বাঁচানোর পথ।

আলফাগো-এর ঐতিহাসিক সাফল্যের পর, হাসাবিস চুপচাপ থেকে যাননি। তিনি বুঝেছিলেন, খেলায় জয়ী হওয়া বড় কথা নয়; আসল জয় হবে যদি মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু—রোগ—এর বিরুদ্ধে এই প্রযুক্তিকে কাজে লাগানো যায়। এভাবেই জন্ম নেয় হাসাবিস এর তৈরি করা প্রতিষ্ঠান Isomorphic Labs

DeepMind থেকে বেরিয়ে এসে এই নতুন প্রতিষ্ঠানে হাসাবিস এখন এআই ব্যবহার করছেন ওষুধ আবিষ্কারের জন্য। বিশেষ করে ক্যান্সার ও অটোইমিউন রোগের মতো কঠিন চ্যালেঞ্জগুলির বিরুদ্ধে। তার মিশনে সঙ্গী হয়েছেন ওষুধ দানব Eli Lilly এবং Novartis-এর মতো বড় বড় ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো।

তাদের লক্ষ্য একটাই: যেখানে ওষুধ আবিষ্কারে একেকটা নতুন চিকিৎসা আনতে ১০-১৫ বছর এবং বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার লাগে, সেখানে এআই-এর শক্তি ব্যবহার করে এই প্রক্রিয়াকে বছর দুয়েক বা তারও কম সময়ে শেষ করা।

সম্প্রতি ৬০ মিনিটস অনুষ্ঠানে ডেমিস হাসাবিস এক সাহসী ঘোষণা দেন:

আমি বিশ্বাস করি, আগামী ১০ বছরের মধ্যে এআই আমাদের সব বড় বড় রোগ নির্মূল করতে পারবে।

অনুষ্ঠানের সঞ্চালক চোখ বড় করে তাকান। দর্শকরাও নিঃশ্বাস আটকে শুনতে থাকেন। হাসাবিস নির্লিপ্ত গলায় বলেন,

যখন ভবিষ্যতে কেউ ক্যান্সার বা অটোইমিউন রোগের কথা বলবে, তখন তা আর ভয়ের বিষয় হবে না। এটি হবে ঠিক যেমন আমরা এখন অ্যান্টিবায়োটিক খাই জ্বর বা ইনফেকশনের সময়। খুব সাধারণ একটা ব্যাপার।

এই আশার ভিত রয়েছে তাদের নিজেদেরই বানানো একটি অসাধারণ টুলের সাফল্যের উপর—AlphaFold। মাত্র এক বছরে AlphaFold এমন এক কাজ করে দেখিয়েছে, যা মানুষের পক্ষে করতে শত শত বছর লাগত— ২০ কোটি প্রোটিনের গঠন ম্যাপ করে ফেলা। এই সাফল্য প্রমাণ করে, হাসাবিসের স্বপ্ন কোনো গাঁজাখুরি কল্পনা নয়।

ডেমিস হাসাবিসের চোখে আজ এক নতুন পৃথিবীর ছবি ভেসে ওঠে— এক পৃথিবী যেখানে শিশুরা আর ক্যান্সারে কাঁদবে না, বয়স্করা আর অটোইমিউন রোগের যন্ত্রণায় ভুগবে না, আর ওষুধ খাওয়া হবে একদম সহজ, যেমন আজ আমরা একটা সর্দি-কাশির ওষুধ খাই।

তিনি জানেন, পথটা সহজ নয়। কিন্তু যাত্রা শুরু হয়ে গেছে। এআই আর মানুষের যৌথ স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে— একটি নতুন মানব সভ্যতা জন্ম নিচ্ছে।

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

Related Articles
উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার সুযোগকৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা

গবেষণায় ChatGPT: সম্ভাবনার দুয়ার নাকি নৈতিকতার প্রশ্ন?

ChatGPT কীভাবে দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি নৈতিক উদ্বেগ উত্থাপন করে গবেষণাকে রূপান্তরিত করছে...

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাতথ্যপ্রযুক্তি

চীনের ক্লাসরুমে এআই বিপ্লব: শিশুরা এখন চ্যাটবটের সঙ্গেই বড় হচ্ছে

ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত একটি প্রযুক্তি-বুদ্ধিমান প্রজন্ম গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কৃত্রিম...

কলামকৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা

কলাম: এআইকে “ধন্যবাদ” বলার খরচ: ভদ্রতায় বাড়ছে বিদ্যুৎ বিল!

AI-কে "দয়া করে" বা "ধন্যবাদ" বলা ভদ্রতা বোধ করে—কিন্তু আপনি কি জানেন...

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাপ্রযুক্তি বিষয়ক খবর

ছয় বছর বয়সেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শিক্ষা: চীনের যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত

ছয় বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য চীন কীভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শিক্ষা চালু...

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাবিজ্ঞান বিষয়ক খবর

মানুষের চিন্তার গতি: মস্তিষ্কের রহস্য উন্মোচন

মানুষের চিন্তার লুকানো গতি আবিষ্কার করুন—প্রতি সেকেন্ডে মাত্র ১০ বিট! মস্তিষ্কের প্রক্রিয়াকরণ...

Three Columns Layout

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact

biggani.org❤️gmail.com

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

বিজ্ঞানী অর্গ (biggani.org) বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে গবেষণা ও বিজ্ঞান নিয়ে বাংলা ভাষায় তথ্য ও সাক্ষাৎকার প্রচার করে – নবীনদের গবেষণা ও উচ্চশিক্ষায় প্রেরণা দেয়া হয়।

যোগাযোগ:

biggani.org@জিমেইল.com

biggani.org, a community of Bangladeshi scientists, shares interviews and information about researchers and scientists in Bengali to inspire young people in research and higher education.