ছয় বছরের লি ওয়েই ক্লাসরুমের সামনে দাঁড়িয়ে কিছুটা কৌতূহল আর কিছুটা উৎকণ্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “স্যার, চ্যাটবট কি আমাদের মতো হাসতে পারে বা মন খারাপ করতে পারে?” ক্লাসের শিক্ষক চেন মিং হাসিমুখে উত্তর দিলেন, “আমরা এখন সেটাই শিখতে যাচ্ছি, লি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের জীবনকে কীভাবে সহজ করবে, আজ আমরা সেটাই জানব।”
এই দৃশ্য এখন আর শুধুমাত্র কল্পনার নয়, বরং চীনের রাজধানী বেইজিংয়ের প্রাথমিক স্কুলগুলোতে একটি বাস্তব অভিজ্ঞতা। চলতি বছরের শরৎকাল থেকেই বেইজিংয়ের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শুরু হয়েছে এআই শিক্ষার আনুষ্ঠানিক যাত্রা। সরকার চায়, প্রযুক্তিবান্ধব একটি নতুন প্রজন্ম গড়ে তুলতে, যা ভবিষ্যতের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় এগিয়ে রাখবে দেশটিকে।
শিক্ষার্থীরা কেবল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) মৌলিক ধারণা নয়, বরং চ্যাটবটের ব্যবহার, এর প্রযুক্তিগত প্রয়োগ ও নৈতিক দিক নিয়েও গভীর আলোচনা করছে। শিক্ষার্থীরা ক্লাসের বাইরে থেকেও বিভিন্ন প্রকল্পে অংশগ্রহণ করছে, যা তাদের সৃজনশীলতা ও সমস্যা সমাধানের ক্ষমতাকে বিকশিত করছে। স্কুলগুলোতে এই ক্লাসগুলো বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির অন্তর্ভুক্ত হতে পারে, অথবা স্বতন্ত্র কোর্স হিসেবে অফার করার সুযোগ রয়েছে।
চীন সরকারের এই উদ্যোগ শুধু বিচ্ছিন্ন পদক্ষেপ নয়; বরং এটি তাদের দীর্ঘমেয়াদী কৌশলের অংশ। গত ডিসেম্বর মাসে দেশটির শিক্ষা মন্ত্রণালয় দেশব্যাপী ১৮৪টি স্কুলকে বেছে নিয়েছে এআই শিক্ষার পাইলট প্রকল্পের জন্য। চীনের শিক্ষামন্ত্রী হুয়াই জিনপেং এই প্রসঙ্গে বলেছেন, “কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাই হচ্ছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ভবিষ্যতের সোনালি চাবি। আগামী দিনে বিশ্বে নেতৃত্ব দিতে হলে আমাদের তরুণ প্রজন্মকে অবশ্যই এ প্রযুক্তিতে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে।”
বিশ্বের অন্যান্য দেশ কী করছে? চীনের এই পদক্ষেপটি আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টি করেছে। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, অন্যান্য দেশগুলোর উচিত দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া, ইতালি এবং কানাডার মতো কিছু দেশ ইতোমধ্যে শিক্ষাব্যবস্থায় এআই-কে যুক্ত করেছে। তবে চীনের মতো এত ব্যাপক, সুসংহত এবং পরিকল্পিত উদ্যোগ অন্য কোনো দেশে এখনও দেখা যায়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাফর ইকবাল মন্তব্য করেন, “কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিষয়ে শিক্ষা এখন আর বিলাসিতা নয়, বরং এটি একটি মৌলিক প্রয়োজন। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোকেও এই বাস্তবতা দ্রুত উপলব্ধি করতে হবে এবং এআই শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।”
শিক্ষার্থীরা কী ভাবছে? বেইজিংয়ের দশ বছরের শিক্ষার্থী ঝাং লিং উচ্ছ্বসিতভাবে বলে, “আমি যখন দেখি কীভাবে চ্যাটবট আমাদের স্কুলের বিভিন্ন কাজ সহজ করে দেয়, তখন আমার খুব ভালো লাগে। আমি বড় হয়ে একজন বিজ্ঞানী হবো এবং আরও উন্নত এআই প্রযুক্তি উদ্ভাবন করব।”
অন্যদিকে, নয় বছর বয়সী লিউ ইয়াও বলল, “আমি এআই দিয়ে খেলনা তৈরি করতে চাই, যা আমার মতো বাচ্চাদের সাহায্য করবে পড়াশোনায়।”
চীনের এই নতুন প্রজন্মের হাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রযুক্তি ব্যবহারের দক্ষতা ও আগ্রহ দেখে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আগামী দিনে প্রযুক্তি বিপ্লবে নেতৃত্ব দেবে এই শিশুরাই। তবে প্রশ্ন থেকে যায়, বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলো কি এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে পারবে?
Leave a comment