নিউজ ডেস্ক, বিজ্ঞানী অর্গ
১৯৪৯ সালের নভেম্বরে, যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পিউপিন হলের নিচে ছোট্ট একটি গবেষণাগারে চীনা বংশোদ্ভূত পদার্থবিদ চিয়েন-শিয়ুং উ এবং তাঁর ছাত্র আরভিং শাকনভ একটি যুগান্তকারী পরীক্ষা চালিয়েছিলেন। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল অ্যান্টিম্যাটার তৈরি করা এবং তার মাধ্যমে পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম রহস্যময় তত্ত্ব ‘পেয়ার থিওরি’ বা দ্বৈত কণা তত্ত্ব যাচাই করা।
উ ও শাকনভ যে সাইক্লোট্রন নামক যন্ত্রটি ব্যবহার করেছিলেন, তার ওজন এত বেশি ছিল যে, দশ বছর আগেও বিশ্ববিদ্যালয় ভবনের দেয়াল ভেঙে ফুটবল দলের সহায়তায় সেটিকে ভেতরে প্রবেশ করানো হয়। এই যন্ত্রের চৌম্বক ক্ষেত্রের মাধ্যমে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে কণাকে ত্বরান্বিত করে কপার প্লেটকে ডিউটেরন দিয়ে আঘাত করলে কপার-৬৪ নামে একটি অস্থায়ী আইসোটোপ তৈরি হয়, যা অ্যান্টিম্যাটার পজিট্রনের উৎস হিসেবে কাজ করেছিল।
পদার্থবিজ্ঞানী জন হুইলার পূর্বেই বলেছিলেন, অ্যান্টিম্যাটার এবং ম্যাটারের সংঘর্ষ থেকে নির্গত ফোটনগুলো পরস্পরের সাথে সমকোণে পোলারাইজড হবে। উ এবং শাকনভ এই ধারণার পরীক্ষামূলক প্রমাণ খুঁজছিলেন। পূর্ববর্তী গবেষণাগুলোর ফলাফল অস্পষ্ট ছিল, কিন্তু উয়ের পরীক্ষার নির্ভুলতা ছিল অতুলনীয়। অবশেষে তাঁরা দেখতে পান, সংঘর্ষের ফলে সৃষ্ট ফোটনগুলো ঠিকই পরস্পরের সাথে সমকোণে পোলারাইজড থাকে, এমনকি দীর্ঘ দূরত্বেও এই সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ থাকে। এটি ছিল কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গেলমেন্টের প্রথম পরীক্ষামূলক প্রমাণ।
এই রহস্যময় ঘটনা সম্পর্কে আলবার্ট আইনস্টাইন নিজেই ছিলেন সন্দিহান। তিনি এটিকে বলেছিলেন “স্পুকি অ্যাকশন অ্যাট আ ডিস্ট্যান্স” বা “দূরত্বের অদ্ভুত কার্যকারিতা”। কিন্তু উ ও শাকনভের এই পরীক্ষা কোয়ান্টাম জগতের বিস্ময়কর সত্যকে বাস্তবে তুলে ধরে। যদিও ১৯৫০ সালের জানুয়ারিতে গবেষণাটি প্রকাশিত হয়, তবে তারা ‘এনট্যাঙ্গেলমেন্ট’ শব্দটি উল্লেখ করেননি। কারণ সে সময় কোয়ান্টাম তত্ত্ব নিয়ে কাজ করাকে অনেকেই গ্রহণযোগ্য মনে করতেন না।
২০২২ সালে কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গেলমেন্টের পরীক্ষামূলক প্রমাণের জন্য পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান জন ক্লাউজার, অ্যালাইন অ্যাসপেক্ট এবং অ্যান্টন জাইলিঙ্গার। যদিও তাঁরা ধারাবাহিকভাবে পরীক্ষাগুলো চালিয়ে এনট্যাঙ্গেলমেন্টের বিকল্প ব্যাখ্যাগুলো বাতিল করেছেন, তবে ঐতিহাসিকভাবে প্রথম পরীক্ষাটি করেছিলেন চিয়েন-শিয়ুং উ। দুঃখজনকভাবে নোবেল পুরস্কারের ঘোষণায় তাঁর নাম উল্লেখিত হয়নি, যা বিজ্ঞানের ইতিহাসে তাঁর প্রতি অবিচারের একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে রয়ে গেছে।
চিয়েন-শিয়ুং উ ১৯১২ সালে চীনে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ঝং-ই উ ছিলেন বিপ্লবী, শিক্ষানুরাগী এবং নারীবাদী। চিয়েন-শিয়ুং নামটির অর্থ “শক্তিশালী বীর”। বাবার উৎসাহে তিনি পদার্থবিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা নিতে যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলিতে পড়াশোনা করেন। সেখানে তিনি ইমিলিও সেগ্রে, আর্নেস্ট লরেন্স এবং জে. রবার্ট ওপেনহাইমারের মতো বিজ্ঞানীদের সান্নিধ্য পান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তাঁর গবেষণাগুলো সেনাবাহিনীর হাতে চলে যায়।
মহান এই বিজ্ঞানী জীবনের নানা বাঁকে নানা ধরনের বৈষম্যের সম্মুখীন হন। নারী এবং এশিয়ান হিসেবে কর্মক্ষেত্রে তাঁকে তীব্র বৈষম্যের মুখে পড়তে হয়। কিন্তু সকল বাধা পেরিয়ে তিনি পদার্থবিজ্ঞানে একের পর এক অসাধারণ সাফল্য এনে দেন। এনরিকো ফার্মির বিটা ক্ষয়ের তত্ত্ব প্রমাণের পাশাপাশি তিনি “প্যারিটি ভঙ্গ” নামক একটি মৌলিক নীতিও প্রমাণ করেন, যা পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম প্রধান আবিষ্কার হিসেবে স্বীকৃত। তবুও ১৯৫৭ সালের নোবেল পুরস্কার তাঁর পরিবর্তে দুই পুরুষ সহকর্মীকে দেওয়া হয়।
বিজ্ঞানের ইতিহাসে চিয়েন-শিয়ুং উয়ের গল্প অনেকাংশে বিস্মৃত, তবে তাঁর কাজ আজও আধুনিক কোয়ান্টাম তত্ত্ব এবং কণা পদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তি। সম্প্রতি গবেষক ও ইতিহাসবিদরা উয়ের এই অবদানের মূল্যায়ন করতে শুরু করেছেন। তাঁর নামে আজ গ্রহাণুর নামকরণ হয়েছে, স্ট্যাম্প প্রকাশিত হয়েছে, এবং তাঁকে স্মরণ করে বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননা প্রদান করা হচ্ছে।
চিয়েন-শিয়ুং উয়ের এই গল্প বিজ্ঞান ও সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি বার্তা দেয়—বিজ্ঞানের অগ্রগতি নির্ভর করে সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং সমান স্বীকৃতির উপর। বিস্মৃত ইতিহাসের এই মহান বিজ্ঞানীর গল্পকে মনে রাখা আমাদের সকলের দায়িত্ব।
Leave a comment