একজন রোগীর শরীরে ক্যান্সার বাসা বেঁধেছে। আগে চিকিৎসা বলতে বোঝাত—কেমোথেরাপি বা রেডিয়েশন, যা ক্যান্সার কোষের পাশাপাশি শরীরের ভালো কোষও ধ্বংস করে দেয়। এখন চিকিৎসকরা চাইছেন, শরীর নিজেই যেন যুদ্ধ করে ক্যান্সারকে হারাতে পারে।
এই নতুন কৌশলের নাম ইমিউনোথেরাপি—একটি “স্মার্ট” চিকিৎসা পদ্ধতি।
ইমিউনোথেরাপি মানে কী?
আমাদের শরীরে একটি স্বাভাবিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা আছে—ইমিউন সিস্টেম। যেমন ঠান্ডা বা ভাইরাসের বিরুদ্ধে শরীর যে প্রতিক্রিয়া দেখায়, সেটাই ইমিউন সিস্টেমের কাজ। এই ইমিউন সিস্টেম সাধারণত ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা অন্যান্য ক্ষতিকর জিনিসের বিরুদ্ধে লড়াই করে। কিন্তু ক্যান্সার কোষ খুব চালাক—এরা শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারে।
ইমিউনোথেরাপির কাজ হলো শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে এমনভাবে “ট্রেইনিং” দেওয়া, যাতে সে ক্যান্সার কোষকে চিনতে পারে এবং আক্রমণ করে নষ্ট করতে পারে।
তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ইমিউনোথেরাপি পদ্ধতি (সহজ ভাষায়)
১. ইমিউন চেকপয়েন্ট ইনহিবিটর (ICI):
ভাবুন, আপনার শরীরের সৈনিক (T-cell) ক্যান্সার কোষকে মারতে চাইছে, কিন্তু ক্যান্সার এমন এক “স্টপ সাইনাল” পাঠায় যাতে সৈনিক থেমে যায়।
ICI থেরাপি এই “স্টপ সাইনাল” ব্লক করে দেয়। যেমন, PD-1 বা CTLA-4 হলো এমন প্রোটিন যেগুলো T-cell-এর কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়। এই থেরাপি এসব প্রোটিনের কার্যকারিতা বন্ধ করে দিয়ে T-cell-কে আবার সক্রিয় করে তোলে। ফলে, T-cell আবার সক্রিয় হয়ে ক্যান্সার কোষ আক্রমণ করতে পারে।
২. ক্যান্সার ভ্যাকসিন:
যেমন করে আমরা করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন নিই, ঠিক তেমনি কিছু ভ্যাকসিন তৈরি করা হচ্ছে যা ক্যান্সার কোষের নমুনা শরীরকে দেখায়। এতে করে শরীর ভবিষ্যতে ক্যান্সার কোষ দেখলেই চিনে ফেলতে পারে এবং সঙ্গে সঙ্গে আক্রমণ করতে পারে।
উদাহরণ: এখন এমন mRNA ভ্যাকসিন তৈরি হচ্ছে যা একজন রোগীর ক্যান্সারের বিশেষ জিন দেখে তৈরি হয়—একদম ব্যক্তিগতভাবে। এটা ক্যান্সার প্রতিরোধে এক নতুন যুগের সূচনা।
৩. CAR-T সেল থেরাপি:
এই পদ্ধতিতে, রোগীর শরীর থেকে রক্তের T-cell নামক কোষ সংগ্রহ করা হয়। এরপর ল্যাবরেটরিতে তাদের জেনেটিকভাবে এমনভাবে বদলানো হয় যাতে তারা ক্যান্সার কোষ চিনতে পারে এবং আক্রমণ করে।
এই বদলানো কোষ আবার রোগীর শরীরে ফিরিয়ে দেওয়া হয়—এরা একেকজন সুপারহিরো সৈনিকের মতো কাজ করে। CAR-T-এর পূর্ণরূপ হলো Chimeric Antigen Receptor T-cell। এটি এমন একটি প্রযুক্তি, যেখানে রোগীর T-cell-এর গায়ে বিশেষ ধরনের রিসেপটর বসানো হয়, যা ক্যান্সার কোষের নির্দিষ্ট চিহ্ন শনাক্ত করে তাকে ধ্বংস করে দিতে পারে।
এই প্রযুক্তিগুলোর চ্যালেঞ্জ কী কী?
- সব রোগীর শরীরে কাজ করে না। কারণ ক্যান্সার খুব রকমারি হয় এবং কিছু ক্যান্সার কোষ নিজেকে খুব ভালোভাবে লুকাতে পারে।
- খুব ব্যয়বহুল। যেমন CAR-T থেরাপির জন্য কোষ সংগ্রহ, পরিবর্তন এবং শরীরে ফিরিয়ে দেওয়ার পুরো প্রক্রিয়াই সময়সাপেক্ষ ও খরচসাপেক্ষ।
- দেহে জটিল প্রতিক্রিয়া হতে পারে। কারণ পুরো ইমিউন সিস্টেম খুব বেশি উত্তেজিত হয়ে গেলে শরীরের সুস্থ কোষও আক্রান্ত হতে পারে।
ভবিষ্যতে কী সম্ভাবনা আছে?
- এখন গবেষকরা নতুন ধরনের ভ্যাকসিন তৈরি করছেন যা mRNA বা ভাইরাস দিয়ে ক্যান্সার কোষকে চিহ্নিত করতে সাহায্য করবে।
- AI এবং মেশিন লার্নিং ব্যবহার করে রোগীর জিনগত তথ্য, ক্যান্সার কোষের ধরন ও প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করে বুঝতে চেষ্টা করা হচ্ছে কোন রোগীর জন্য কোন চিকিৎসা পদ্ধতি সবচেয়ে ভালো কাজ করবে।
- CAR প্রযুক্তি এখন শুধু T-cell নয়, NK cell বা macrophage-এর মতো অন্যান্য ইমিউন কোষেও ব্যবহার হচ্ছে, যেগুলো প্রস্তুত করে সরাসরি রোগীকে দেওয়া যায় (off-the-shelf therapy)।
উপসংহার:
ইমিউনোথেরাপি এমন এক চিকিৎসা যা ক্যান্সারকে বাইরে থেকে আক্রমণ না করে, শরীরের ভেতর থেকেই শক্তি জোগায়। এখনই হয়তো এটি সব রোগীর জন্য নয়, কিন্তু যেভাবে গবেষণা এগোচ্ছে, ভবিষ্যতে এটি ক্যান্সার চিকিৎসার মূল পদ্ধতিগুলোর একটি হয়ে উঠবে।
আমাদের সমাজে এই ধরনের নতুন চিকিৎসার কথা জানানো এবং সাধারণভাবে বোঝানো জরুরি, যাতে রোগী এবং পরিবারের সদস্যরা চিকিৎসা সম্পর্কে সচেতন ও প্রস্তুত থাকতে পারেন।
Leave a comment