ইতিহাসের এই দিনেবিজ্ঞানীদের জীবনী

আল বিরুনি: ইতিহাসের ধুলো ঝেড়ে জেগে উঠা এক জ্ঞানযাত্রার নক্ষত্র

Share
Share

এক শান্ত বিকেলে রাজধানীর পুরনো বইপাড়ায় হঠাৎ করেই চোখ আটকে গেল এক পুরাতন গ্রন্থের ওপর। মলিন আর হলুদ হয়ে যাওয়া প্রচ্ছদে তবু স্পষ্ট বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা— “আল বিরুনি।” আশপাশের কোলাহল থেকে আলগোছে সরে গিয়ে বইটির পাতায় আঙুল বোলাতেই ভেসে এল এক বিস্ময়কর জগতের রূপরেখা—যেখানে জ্ঞান, অনুসন্ধিৎসা আর মানবকল্যাণের আশ্চর্য সমাহার ঘটেছিল এক অনন্য বিজ্ঞানমনস্ক মনীষীর হাতে। এভাবেই যেন ঝলমল করে উঠল শতাব্দী পেরোনো ইতিহাসের পাতা, যেখানে অমর হয়ে আছেন মুসলিম বিজ্ঞানী ও দার্শনিক আল বিরুনি।

প্রথম অধ্যায়: গল্পের শুরু

মধ্যযুগের জ্ঞানচর্চার প্রাঙ্গণে যখন গ্রিক, ভারতীয় ও ফারসি জ্ঞান ধীরে ধীরে মিশে যাচ্ছে, ঠিক তখনই আবির্ভূত হন আবু রাইহান আল বিরুনি—একজন প্রতিভাধর বহুমুখী পণ্ডিত। নবম শতাব্দীর অন্তিমভাগে জন্ম নিয়ে তিনি বেড়ে ওঠেন এক নতুন যুগের স্রোতে। প্রকৃতি, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, ভৌগোল—সবকিছুতেই তাঁর অসীম কৌতূহল ছিল। ইতিহাস বলছে, কিশোর বয়স থেকেই তিনি ছিলেন গণিতের প্রতি প্রবলভাবে আকৃষ্ট। সেই কৌতূহলই তাঁকে নিয়ে যায় পৃথিবীর নানা প্রান্তের জ্ঞানস্রোতে: গ্রিক দর্শন থেকে ভারতীয় গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান থেকে ভূগোল—সকল বিষয়ে সমান বিচরণ ছিল তাঁর।

কেবল নিজের গবেষণার গণ্ডিতেই আটকে থাকেননি আল বিরুনি; বরং বিশ্বকে জানার প্রবল আকাঙ্ক্ষা তাঁকে চালিত করেছে আলোকিত এক পথের দিকে। বলা হয়ে থাকে, তিনি ছিলেন জ্ঞান অনুসন্ধানের সত্যিকারের অভিযাত্রী—যার ঋদ্ধ ফলস্বরূপ আমরা লাভ করেছি অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা, তত্ত্ব আর গ্রন্থ।

দ্বিতীয় অধ্যায়: তথ্য ও বিশ্লেষণ

আল বিরুনির অন্যতম কৃতিত্ব হলো তাঁর অসামান্য ভূগোল ও জ্যোতির্বিদ্যার গবেষণা। তিনি পৃথিবীর পরিধি পরিমাপের উদ্যোগ নিয়েছিলেন, যে উদ্যোগ মধ্যযুগের বিজ্ঞানের পথে দৃঢ় ভিত্তি স্থাপন করে। এ ছাড়া ভারতীয় গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে রচিত তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ “তাহকিক মা লিল-হিন্দ” বা “ভারতের গবেষণা” আজও ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন বিজ্ঞানচর্চা জানার গুরুত্বপূর্ণ উৎস।

অনেক ঐতিহাসিকই আল বিরুনিকে সভ্যতার সেতুবন্ধন হিসেবে দেখেন। তিনি মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সাংস্কৃতিক ও জ্ঞান-বিনিময়কে ত্বরান্বিত করেছিলেন। গণিতবিদ হিসেবে তাঁর কাজ ভারতীয় গণনা পদ্ধতি ও ‘শূন্য’ ধারণাকে পাশ্চাত্য ও মধ্যপ্রাচ্যে জনপ্রিয় করতে ভূমিকা রেখেছে বলে মত দেন গবেষকরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান বলেন, “আল বিরুনি শুধুই একজন বিজ্ঞানী ছিলেন না, তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার মূর্ত প্রতীক। গণিত, নক্ষত্রবিদ্যা, ভূগোল থেকে শুরু করে ধর্মতত্ত্ব—প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি নিজস্ব অবদান রেখেছেন। এই অবদান মধ্যযুগীয় বিজ্ঞানচর্চাকে প্রচণ্ডভাবে ত্বরান্বিত করেছে।”

এদিকে সাধারণ পাঠক সুমন মাহমুদের মতে, “ইতিহাসের পাতা খুললেই দেখি পশ্চিমা বিজ্ঞানীরা পুরোভাগে। কিন্তু যখন জানতে পারি আল বিরুনির মতো মুসলিম মনীষীরা মধ্যযুগে বিজ্ঞান ও জ্ঞানচর্চায় এত বিশাল ভূমিকা রেখেছেন, তখন সত্যিই বিস্মিত হই। তাঁর নাম ও কাজ আরও বেশি প্রচার হওয়া উচিত।”

তৃতীয় অধ্যায়: পাঠ ও প্রভাব

আল বিরুনির গবেষণায় ধর্মের সঙ্গে বিজ্ঞানের সামঞ্জস্যপূর্ণ বোঝাপড়ার ব্যাপারটিও স্পষ্ট। তাঁর রচনায় দেখা যায়, বিজ্ঞানের প্রতি তাঁর অনুসন্ধিৎসা এবং সব ধরনের সংস্কৃতি ও বিশ্বাসকে শ্রদ্ধা করার মানসিকতা। এই বহুমুখী দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে পৃথিবীর বিভিন্ন মানুষের কাছে আদর্শরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

জ্ঞান-বিজ্ঞানের আন্তর্জাতিক মঞ্চে আজও আল বিরুনির কাজ চর্চা করা হয়। তাঁর “আল-আথার আল-বাকিয়া” গ্রন্থে খ্রিস্টীয় ও ইসলামিক বর্ষপঞ্জি থেকে শুরু করে পারস্য, ভারত ও অন্য অঞ্চলের সময়গণনা পদ্ধতি আলোচনা করেছেন। গ্যালিলিও-নিউটনের আগে তিনি ঘূর্ণন, পরিমাপ ও জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে নানা ভাবে গবেষণা করে গেছেন, যা পরবর্তী শতাব্দীর বিজ্ঞানীদের জন্য ভিত্তি রচনা করেছে।

বিশিষ্ট মধ্যযুগীয় ইতিহাসবিদ ড. আজহারুল ইসলাম মন্তব্য করেন, “আল বিরুনির ‘চিন্তা ও প্রশ্নের পরিধি’ ছিল অদ্ভুত ব্যাপ্তি। জ্ঞানতত্ত্বে তাঁর এই অভিনব দৃষ্টিভঙ্গি আজকের আধুনিক গবেষণাতেও প্রাসঙ্গিক। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রশ্ন জাগলেই তার উত্তর খোঁজা উচিত—ধর্ম, সংস্কৃতি বা কোনো ‘সীমারেখা’ সেই অনুসন্ধানে বাধা নয়।”

চতুর্থ অধ্যায়: উত্তরাধিকার ও ভবিষ্যৎ

আধুনিক যুগে মহাকাশ গবেষণা থেকে শুরু করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা—আমরা বিজ্ঞানের অভাবনীয় উন্নতি প্রত্যক্ষ করছি। কিন্তু এসব উন্নতির পেছনে যে ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে, তার একটি বড় অংশ তৈরিতে ভূমিকা রেখেছেন আল বিরুনির মতো পথিকৃৎ ব্যক্তিত্বরা।

তথ্যপ্রযুক্তির যুগে এসে আল বিরুনির মতো মনীষীদের কাজ আমাদের দেখিয়ে দেয়, সত্যিকারের বিজ্ঞানমনস্ক চেতনার কোনো সীমানা নেই। আজও যদি আমরা তাঁর গবেষণা-পদ্ধতি, অনুসন্ধিৎসু মানসিকতা আর উদার দৃষ্টিভঙ্গিকে লালন করি, তাহলে আগামী দিনের বিশ্ব আরও সমৃদ্ধ ও মানবকল্যাণমুখী হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করছেন বিশেষজ্ঞরা।

ঢাকা শহরের বইপ্রেমী তরুণ-তরুণীদের একাংশ এখন আল বিরুনির গ্রন্থ অনুসন্ধানে ব্যস্ত। পুরনো বইয়ের দোকানগুলোতে এই মহান বিজ্ঞানীর লেখা কিংবা তাঁকে নিয়ে লেখা গবেষণাধর্মী গ্রন্থের চাহিদা বাড়ছে। সাংবাদিকদের সামনে অনেকে বলছেন, “আল বিরুনি নতুনভাবে আবিষ্কারের সময় এসেছে। নতুন প্রজন্মের বিজ্ঞানচর্চার শিকড় খুঁজতে হলে ইতিহাসের এই নক্ষত্রকে পাশ কাটানো যাবে না।”

উপসংহার

আল বিরুনির জীবন আর কর্ম বরাবরই আমাদের মনে করিয়ে দেয়—মানুষের স্বভাবজাত অনুসন্ধিৎসা আর জ্ঞানপিপাসাই সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। এই মুসলিম বিজ্ঞানী ও দার্শনিক চিরকালীন এক অনুপ্রেরণার নাম, যার গবেষণা-প্রতিভা এবং দৃষ্টিভঙ্গি মানুষকে প্রথাগত সীমানা ছাড়িয়ে এক আন্তর্জাতিক জ্ঞানচর্চার প্রাঙ্গণে নিয়ে গেছে।

যদিও সময় সবকিছুকেই ইতিহাসের আড়ালে ঠেলে দেয়, তবে আল বিরুনির নাম ইতিহাসের স্মৃতি থেকে কখনো মুছে যাওয়ার নয়। আজকের তারুণ্য যখন আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দুনিয়ায় পা বাড়ায়, তখন আল বিরুনির দেখা পথ ও চেতনা তাদের আগামীর অভিযাত্রায় আলোকবর্তিকা হয়ে উঠুক—এটুকুই প্রত্যাশা।

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

Related Articles
অর্থনীতিইতিহাসের এই দিনে

ইতিহাসের জ্যোতির্ময় পথিক: ইবনে খালদুন ও সভ্যতার তাত্ত্বিক ভাস্কর্য

সমাজবিজ্ঞান এবং ইতিহাস রচনার জনক ইবনে খালদুনের অসাধারণ যাত্রা আবিষ্কার করুন। সভ্যতা,...

ইতিহাসের এই দিনেবিজ্ঞানীদের জীবনী

আব্বাস ফারনাস: আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্নে ঋদ্ধ এক মুসলিম কিংবদন্তি

নবম শতাব্দীর মুসলিম বহুবিদ্বান আব্বাস ইবনে ফিরনাসের অনুপ্রেরণামূলক গল্পটি আবিষ্কার করুন -...

ইতিহাসের এই দিনেকলাম

কলাম: আল তুসো: ইতিহাসের গভীর থেকে আধুনিক আলোচনার অগ্রভাগে

ঐতিহ্যের সাথে আধুনিক শৈল্পিকতার মিশ্রণে উদ্ভাবনী মোমের ভাস্কর্যের মাধ্যমে "আল তুসো" কীভাবে...

বই আলোচনাবিজ্ঞানীদের জীবনী

ওমর খৈয়াম: সাহিত্যের আকাশে এক চিরকালীন নক্ষত্র

ওমর খৈয়ামের কালজয়ী জ্ঞান অন্বেষণ করুন — একজন কিংবদন্তি পারস্য কবি, গণিতবিদ...

চিকিৎসা বিদ্যাবিজ্ঞানীদের জীবনী

আল–রাজি: মধ্যযুগের চিকিৎসাবিদ্যার আলোকবর্তিকা

আল-রাজির অনুপ্রেরণামূলক গল্পটি আবিষ্কার করুন, একজন কিংবদন্তি পারস্যের চিকিৎসক যার যুগান্তকারী অবদান...

Three Columns Layout

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact

biggani.org❤️gmail.com

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

বিজ্ঞানী অর্গ (biggani.org) বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে গবেষণা ও বিজ্ঞান নিয়ে বাংলা ভাষায় তথ্য ও সাক্ষাৎকার প্রচার করে – নবীনদের গবেষণা ও উচ্চশিক্ষায় প্রেরণা দেয়া হয়।

যোগাযোগ:

biggani.org@জিমেইল.com

biggani.org, a community of Bangladeshi scientists, shares interviews and information about researchers and scientists in Bengali to inspire young people in research and higher education.