সকালটা ছিল বেশ সাধারণ। রাজধানী ঢাকার বনানীতে বাস করেন ফাহিম রহমান। অন্যান্য দিনের মতোই চা হাতে ফেসবুক খুলতেই দেখলেন ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর কাছ থেকে জরুরি সাহায্যের বার্তা। “আমার একাউন্টে সমস্যা, দ্রুত এই লিংকে ক্লিক করে সাহায্য করো!” বন্ধু ঘনিষ্ঠ, তাই কিছু না ভেবেই লিংকে ক্লিক করলেন ফাহিম। মুহূর্তের মধ্যেই তাঁর ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে খোয়া গেল ৫০ হাজার টাকা। পরে জানা গেল, বন্ধু নয়—এটা ছিল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) মাধ্যমে তৈরি করা ফিশিং হামলা।
ফাহিম রহমান একা নন; বিশ্বজুড়ে এমন লাখো মানুষ এখন এই ধরনের AI-নির্ভর প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। সম্প্রতি ইউরোপের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ইউরোপোল এক উদ্বেগজনক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রগুলো প্রতারণা, ফিশিং এবং ডিপফেইক তৈরি করে অপরাধমূলক কার্যক্রমকে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত করছে।
ইউরোপোলের মতে, অপরাধীরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে অপরাধ সংগঠনের খরচ কমাচ্ছে এবং অল্প সময়ের মধ্যে আরও নিখুঁতভাবে মানুষের বিশ্বাস অর্জন করে প্রতারণা চালাচ্ছে। এআই-নির্ভর ডিপফেইক ভিডিও, অডিও বা ছবি এতটাই বাস্তবসম্মত যে সাধারণ মানুষ সহজেই বিভ্রান্ত হচ্ছেন। ইউরোপোলের প্রতিবেদনে বলা হয়, “ক্রিমিনাল ওয়ার্কফ্লো এখন সম্পূর্ণ অনলাইনে রূপ নিচ্ছে। নিয়োগ থেকে অর্থপ্রদানের প্রক্রিয়া পর্যন্ত সব কিছুই AI-এর মাধ্যমে দ্রুত, আরও নিখুঁত এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নজরের বাইরে করা সম্ভব হচ্ছে।”
এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে উদ্বেগজনক ভবিষ্যদ্বাণী হলো, অদূর ভবিষ্যতে এমন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবস্থা তৈরি হবে, যা নিজে থেকেই অপরাধের পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়ন করবে—মানুষের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই। দুর্বল আইনি কাঠামো এবং দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রযুক্তির কারণে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো শীঘ্রই সম্পূর্ণ অ্যালগরিদম-নিয়ন্ত্রিত অপরাধী চক্রের মুখোমুখি হতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. সাজ্জাদ হোসেন বলেন, “প্রযুক্তি যত উন্নত হচ্ছে, ততই তার অপব্যবহার বাড়ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এখনই AI-ভিত্তিক অপরাধ মোকাবিলায় প্রস্তুত হতে হবে। না হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।”
তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিশেষজ্ঞ ড. তাসনিম জামান বলেন, “AI-এর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে আন্তর্জাতিক সমন্বয় ও শক্তিশালী আইনি কাঠামো জরুরি। প্রযুক্তি খারাপ নয়, সমস্যা হচ্ছে এর অপব্যবহারে।”
নাগরিকরা উদ্বেগ প্রকাশ করছেন এই নতুন হুমকি নিয়ে। ব্যবসায়ী মাহফুজ আহমেদ বলেন, “এখন আর বুঝতেই পারছি না, কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যা। প্রযুক্তির উন্নয়ন আমাদের জীবন সহজ করার কথা ছিল, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে উল্টো আমাদের জন্য নতুন ঝুঁকি তৈরি করছে।” বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী তানজিনা রহমান বলেন, “সোশ্যাল মিডিয়ায় যেভাবে ডিপফেইক ভিডিও ছড়াচ্ছে, তা দেখে আসলে সত্য-মিথ্যার পার্থক্য করাই কঠিন হয়ে পড়েছে।” অন্যদিকে তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী আরিফুল ইসলাম বলেন, “আমাদের মতো প্রযুক্তি কর্মীদের জন্যও এই সমস্যা মোকাবিলা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিন নতুন নতুন কৌশল আসছে।”
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সচেতনতা এবং শক্তিশালী আইনই হতে পারে মূল হাতিয়ার। ইউরোপোলের এই সতর্কতা বৈশ্বিকভাবে নতুন নীতি নির্ধারকদের জন্য এক স্পষ্ট বার্তা: অপরাধীদের থেকে এক ধাপ এগিয়ে থাকতে হলে AI-এর ব্যবহার বিষয়ে এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে।
Leave a comment