উত্সর্গঃ আবিস্কারক স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু – যার স্পর্শে পৃথিবী ধন্য!
প্রথম আলো থেকে সংগ্রীহিত
কৃষি
বাংলাদেশের কৃষক বিজ্ঞানী
শাইখ সিরাজ | তারিখ: ১৩-১১-২০১০
সম্প্রতি ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার সাধুপাড়া গ্রামের কৃষকদের এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলাম। ওই অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্য দেন কৃষক আবুল কাশেম রিজভী। তাঁর বয়স ৭০-এর নিচে নয়। প্রতিনিয়তই কৃষকের মাঠে গিয়ে কৃষকের দক্ষতা, বিজ্ঞানমনস্কতা ও কথায় মুগ্ধ হই। গর্বে বুক ভরে ওঠে।
আমার সঙ্গে দেশের বিভিন্ন এলাকার কৃষকদেরই প্রতিদিন মুঠোফোনে আলাপ হয়। চার বছর ধরে যে একজন কৃষকের সঙ্গে আমার প্রায় প্রতিদিন কথা হয়, তিনি হচ্ছেন ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার সাধুপাড়া গ্রামের হুমায়ুন কবীর। চল্লিশের কোটায় বয়স। কৃষকের যেকোনো দুঃখ-দুর্দশার চিত্র দেখামাত্রই তিনি আমাকে ফোন করেন। আঞ্চলিক ভাষায় কৃষকের ভালোমন্দ জানান। আমি শত ব্যস্ততায় হুমায়ুন কবীরের মুখের কথা শুনে মুগ্ধ হয়ে যাই। কীভাবে একজন কৃষক নিজের চাষাবাদ সামলে হাজারো কৃষকের সমস্যাগুলোকে এত চুলচেরা বিচার করেন? টেলিভিশন কিংবা পত্রিকায় কখন কৃষি নিয়ে কোন সংবাদ আসছে, কোন সংবাদটি অতিরঞ্জিত, কোন সংবাদটিতে গভীরভাবে নজর দেওয়া দরকার, সে বিষয়গুলোতেও মনোযোগী। ময়মনসিংহ-নেত্রকোনায় যাওয়া-আসার পথে বহুবারই হুমায়ুন কবীরের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। সামনাসামনি হওয়ার পর হুমায়ুন নিজেকে আড়ালই করতে চেয়েছেন। মুঠোফোনে কথা বলতেই যেন বেশি স্বাচ্ছন্দ্য তাঁর। হুমায়ুন বেশ কিছুদিন ধরেই আমাকে নতুন এক সাফল্যের চিত্র দেখার জন্য ফুলপুরে যাওয়ার অনুরোধ করছেন। কৃষকেরা দেশি জাতের বীজ সংরক্ষণ ও বিনিময় করছেন। একটি কৃষকদের সংগঠনও গড়ে তুলেছেন তাঁরা। নাম দিয়েছেন সাধুপাড়া কৃষক ঐক্য। সদস্য ৪২ জন কৃষক। কিছুদিন আগেই সাতক্ষীরার শ্যামনগরে গিয়ে কৃষক সিরাজুল ইসলামসহ তাঁদের কৃষক সংগঠন হায়বাতপুর আইপিএম সেচ ও বাতাবরণ সংঘের সদস্য কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে এসেছি। তাঁদের নিয়ে অনুষ্ঠানও করেছি। তাঁরা দেশি বিলুপ্ত বহু জাত নিজেরা সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বীজ বর্ধন করে এলাকায় সাড়া ফেলে দিয়েছেন। বিশেষ করে, ধানের ১৪টি স্থানীয় প্রাচীন লবণসহিষ্ণু জাতকে তাঁরা নিজেদের সংগ্রহে এনেছেন, যে জাতগুলো বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত জাতগুলোর চেয়েও বেশি লবণসহিষ্ণু। তাঁদের চিন্তাভাবনা ও বীজ সংগ্রহের কায়দাকানুন দেখে সত্যিই অভিভূত হই। এবার কৃষক হুমায়ুনের টানাটানিতে গেলাম ফুলপুরে। কৃষকের খেতের পাশে কালো রঙের একটি সাইনবোর্ড। তাতে কাঁপা কাঁপা হাতে লেখা, ‘কৃষকনিয়ন্ত্রিত জাত গবেষণা, জাত ২৫টি, মৌসুম-আমন’, ‘সাধুপাড়া কৃষক ঐক্য, ময়মনসিংহ।’ কৃষক কি প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণার সারিতেই এখন নিজেদের দাঁড় করানোর সাধ্য অর্জন করেছেন? সত্যিই তা-ই। মাঠের মধ্যে একে একে কৃষকদের ডেকে কথা বললাম। আবদুল হেকিম, আবদুল জব্বার, মো. শহিদুল্লাহ, আবদুল ওয়াদুদ খান ও হুমায়ুন কবীরের মুখের কথা শুনে, তাঁদের বিজ্ঞানচেতনা দেখে আবারও বিস্মিত হলাম। কৃষকের চিন্তার গভীরতা কোথায় পৌঁছেছে? বিজ্ঞান যেন প্রয়োজনের তাগিদেই তাঁদের হাতে এসে ধরা দিয়েছে। মাঠে প্লট ভাগ করে তাঁরা ২৫টি দেশীয় বিলুপ্তপ্রায় জাতের আবাদ করেছেন এই আমন মৌসুমে। এর মধ্যে আছে চিনিশাইল, তুলসীমালা, কালাজিরা, বিন্নি, আবদুল হাই, ঢেঁকিমালা, বাঁশফুলসহ নানা নামের ধান। ধানগুলোর সব কটি নাম কৃষকেরই ঠোঁটের আগায়। গবেষণা প্লটে তাঁরা ধানের চারা রোপণের পর থেকে প্রতিটি বিষয় পর্যবেক্ষণ করছেন। তিনটি গোছা রোপণের পর ধানগাছটির কয়টি শীষ হচ্ছে, উচ্চতা কত হচ্ছে, ঠিক কোন সময়ে কাইচথোড় আসছে, কত দিনে থোড়ে দুধ আসছে, কত দিনে ধান কতটুকু পরিণত হচ্ছে, একটি ছড়ায় কয়টি ধান হচ্ছে—বিষয়গুলো তাঁরা শুধু পর্যবেক্ষণই করছেন না, উচ্চফলনশীল জাতগুলোর সঙ্গে দেশীয় জাতগুলোর তুলনামূলক চিত্রও কাগজে লিপিবদ্ধ করছেন। এই গবেষণার মধ্য দিয়েই তাঁরা উচ্চফলনশীল জাতগুলোর পাশাপাশি আমাদের দেশি জাতগুলো আবাদে দারুণ পক্ষপাতী হয়ে উঠেছেন। তাঁদের যুক্তি হচ্ছে, উচ্চফলনশীল জাতের ধান আবাদে সার, কীটনাশকসহ যে পরিমাণ উপকরণ ব্যয় হচ্ছে, তাতে উৎপাদন খরচ যা আসে, দেশি জাতের ধানে ফলন কম হলেও উৎপাদন খরচ অনেক কম হওয়ায় সার্বিকভাবে লাভ হচ্ছে। আছে মাটির স্বাস্থ্য ফিরিয়ে দেওয়ার তাগিদ। যেদিন থেকে উচ্চফলনশীল ধান কৃষকসহ দেশের মানুষের খাদ্যনিরাপত্তায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে, সেদিন থেকেই মাটি গ্রহণ করছে প্রচুর পরিমাণ রাসায়নিক সার ও কীটনাশক। এ যেন কিছু নিলে কিছু দিতে হয়, এমন একটা ব্যাপার। কিন্তু একই মাত্রাতিরিক্ত সার ও কীটনাশক দিতে দিতে মাটির শক্তি আমরাই নিঃশেষ করে দিয়েছি। এসব কৃষকের কাছে এই অঙ্কও খুব পরিষ্কার। তাঁরা উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনতে চান, পাশাপাশি ফিরিয়ে আনতে চান মাটির শক্তি।ভাবছিলাম, আয়োজনের শেষ এখানেই। কিন্তু পরে কৃষক আবদুল হেকিমের ঘরের দাওয়ায় দেখলাম মাটির টবের ভেতরে পৃথক তিনটি ধানের গাছ, তার সঙ্গে একটি সুউচ্চ লাঠি বাঁধা এবং ধানের ছড়াগুলো প্লাস্টিকের প্যাকেট দিয়ে ঢাকা। বুঝতে বাকি রইল না সেটি ব্রিডিংয়ের প্রয়াস। যে কাজটি বিজ্ঞানীদের। যা মূলত, আধুনিক ও বিকশিত বিজ্ঞানের অনেক উঁচু ধাপের কাজ। মনে পড়ল ফিলিপাইনের লস ব্যানোসে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ পৃথিবীর যেসব ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে গিয়েছি সেখানকার প্রাতিষ্ঠানিক ধান গবেষণার দৃশ্যগুলো। কৃষকেরাও একই প্রক্রিয়া মেনে ধানের নতুন জাত উদ্ভাবনের ভারী উদ্যোগ নিয়েছেন। উচ্চফলনশীল জাতের সঙ্গে স্থানীয় জাতের সংকরায়ণ করার কাজে ইতিমধ্যে তাঁরা অর্জন করেছেন একধরনের সফলতা। আমনে বিআর ১১, বিআর ৩২ ও বিআর ৪১ জাতের সঙ্গে তাঁরা স্থানীয় জাতের ক্রস করেছেন। কৃষক আবদুল হেকিমের প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া খুব বেশি নয়, কিন্তু ধানের নতুন জাত উদ্ভাবনের এফ-১, এফ-২ থেকে এফ-৭ পর্যন্ত যে ধাপগুলো রয়েছে, তার কর্মকাণ্ড একেবারে মুখস্থ। ধানবিজ্ঞানীদের মতোই তাঁরাও বিষয়গুলো বুঝিয়ে দিলেন ঠিকঠাক। তাঁদের কাছে জিন প্রতিস্থাপন, জিনের শক্তিমত্তা ও সহনক্ষমতা পরীক্ষা এবং জাতের গুণাগুণ নির্বাচনের সবকিছুই এখন পানির মতো পরিষ্কার। ইতিমধ্যে কয়েকটি জাত উদ্ভাবনের কাজে তাঁরা এগিয়েছেন অনেক দূর। কৃষক হেকিম আলীকে জিজ্ঞাসা করলাম, কোথায় শিখেছেন এসব? তিনি বললেন, সাঈদ আহমেদ খান বাচ্চু নামের আরেক কৃষকের নাম। বাড়ি তাঁর নেত্রকোনার আটপাড়ায়। তিনিও সেখানে ছিলেন। কৃষক বাচ্চুর প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া ক্লাস সেভেন-এইট পর্যন্ত। কিন্তু তাঁর জানাশোনা অবাক করার মতো। বেসরকারি সংস্থা কারিতাসের মাধ্যমে একবার তিনি ফিলিপাইনে গিয়েছিলেন। ইরির বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কৃষকদের সঙ্গে তাঁদেরই শিখিয়ে দিয়েছেন ধানের জাত নির্বাচন ও উদ্ভাবনের মোদ্দা নিয়মগুলো। এখন কৃষকের কাছে একেবারেই পানির মতো সহজ। তাঁরা বিজ্ঞানকে গ্রহণ করেছেন একটি সহজ মাধ্যম হিসেবে, জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় এক কৌশল হিসেবে, যা তাঁরা সহজেই ব্যবহার করতে পারছেন। কৃষক বাচ্চুর কাছ থেকে আবদুল হেকিমের মতো অনেকেই শিখেছেন ধানের কৃত্রিম সংকরায়ণ, বীজের অভ্যন্তরীণ উপকরণগুলোর কাজ সম্পর্কে। যেগুলো দীর্ঘদিন বিজ্ঞান পড়েও রপ্ত করা যায় না, তা এখন কৃষকদের একেবারে হাতের জিনিস। তিনি আরও বললেন, ইতিমধ্যেই তাঁরা নতুন জাত উদ্ভাবনের জন্য এফ-১ ও এফ-২ লাইনের কাজ সম্পন্ন করেছেন। এই গতিতে আগামী দুই থেকে আড়াই বছরের মধ্যে ধানের নতুন জাত উদ্ভাবনের গবেষণায় জাগাতে পারবেন অভূতপূর্ব সাফল্য। তিনি আরও বললেন, ধানের ব্রিডিংয়ের কাজগুলো ঘরের নারীরা আরও সূক্ষ্মভাবে করতে পারেন। ইতিমধ্যে নেত্রকোনার আটপাড়ার বহুসংখ্যক নারী নিয়োজিত হয়েছেন ধানের উচ্চফলনশীল জাতের সঙ্গে দেশি জাতের জিন প্রতিস্থাপন করে নতুন জাত উদ্ভাবনের কাজে।
বিজ্ঞানকে ধন্যবাদ জানানোর ভাষা নেই, কিন্তু সব অভিবাদন ওই বিজ্ঞানীদের প্রতি, যাঁরা মাটির জ্ঞানে জ্ঞানী বলেই প্রাতিষ্ঠানিক বিজ্ঞানের অনেক দূর রপ্ত করতে পেরেছেন। তাঁদেরকে তাঁদের মতোই কাজ করে যাওয়ার সুযোগ দিলে ভবিষ্যতে যে বড় সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
শাইখ সিরাজ: কৃষি উন্নয়ন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব; পরিচালক ও বার্তাপ্রধান, চ্যানেল আই।
[email protected]
প্রথম আলো থেকে সংগ্রীহিত
2010 November 13. Added from Canada :: 2010 November 13.
You may also enjoy BBC's featured interview link:
কৃষি নিয়ে ব্যতিক্রমী অনুষ্ঠানের পথিকৃৎ
Courtesy of BBC Bangla :: 2010 October 27.
Added from Canada :: 2010 November 16.
শফিউল ইসলাম
Thanks a lot to add this article.
Necessity knows no law proves once again.
সত্যি অপূর্ব অগ্রযাত্রা ….
যে মাটির-মানুষেরা ধান গবেষণায় লেগে পড়েছেন, তাঁরাই আসল কর্মী, তাঁরা নিজহাতে ধান ফলান তাই গবেষণা তাঁদের নিত্যদিনের ব্যাপার কথায় বলে শিক্ষিত চাষী বেশি ফসল ফলান কথাটি ঠিক যাঁরা নিজহাতে ধান চাষ করে ক্ষেতে মাঠে দিন কাটান, তাঁরা যদি একটু লেখাপড়া ও উন্নত কাজের সুযোগ পান তবে তাঁরা অনেক অভাবিত কাণ্ড করে ফেলতে পারেন এই চাষীরা তারই উদাহরণ দেশে শিক্ষা বিস্তারে কী সুফল লাভ হয় এতো তারই জ্বলন্ত প্রমাণ চাষীরাই বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রধান অংশ তাই সকল চাষীকে শিক্ষিত করে তুলতে হবে শুধু তাই নয়, শিক্ষায় যেন সেখানে সকলে অংশভাক হন, সকলে যেন সেখানে শিক্ষার ভুরিভোজের সুযোগ পান, তাহলে তাঁরা তাঁদের শিক্ষার সুফল তাঁদের কর্মক্ষেত্রে প্রয়োগের সুযোগ পাবেন
মনোজকুমার দ. গিরিশ
১৭/১১/২০১০ কোলকাতা
এই বিষয়টি প্রথম আলো পত্রিকায় পড়েছিলাম। আবার পড়লাম। খুবই ভালো লাগলো।