মঙ্গলগ্রহ আর দশটা গ্রহের মতো নয় (বলা উচিত ছিল আর ‘নয়টা’ গ্রহের মতো নয় – সবাই জানে সৌরজগতের গ্রহ হচ্ছে নয়টি)। মানুষের জন্ম থেকে তারা এ-গ্রহটাকে অন্যভাবে দেখে আসছে, তার কারণ এ-গ্রহটা দেখতে অন্যসব গ্রহ-তারা থেকে ভিন্ন – এটি লাল রঙের। একসময় মানুষ জানত না তাই এই ‘রক্তচক্ষু’ গ্রহকে যুদ্ধদেবতা গঅজঝ নাম দিয়েছিল, এখন আমরা জানি এই লাল রংএসেছে ফেরিক অক্সাইড (জংধরা লোহা) এবং মঙ্গলগ্রহের স্বচ্ছ বায়ুমণ্ডলের কারণে।
মঙ্গলগ্রহ অনেকদিন থেকেই পৃথিবীর মানুষ নানাভাবে দেখে আসছে; কিন’ তার পৃষ্ঠদেশ নিখুঁতভাবে প্রথমবার পর্যবেক্ষণ করেছিলেন ডাচ জ্যোতির্বিদ ক্রিশ্চিয়ান হুইজিন্স ১৬৫৯ সালে। তিনি হিসাব করে বের করেছিলেনযে, মঙ্গলগ্রহের একটি ‘দিন’ সাড়ে চব্বিশ ঘণ্টা – পৃথিবীর দিনের খুব কাছাকাছি। উদাহরণ দেওয়ার জন্য বলা যায়, বৃহস্পতির একদিন হচ্ছে দশ ঘণ্টা যা শুক্রগ্রহের প্রায় আট মাস! হুইজিন্সের প্রায় সাত বছর পরে ইতালির জ্যোতির্বিদ জিওভানি কাসিনি মঙ্গলগ্রহের দুই মেরুতে জমে থাকা বরফ আবিষ্কার করেছিলেন।
ধীরে ধীরে মঙ্গলগ্রহ নিয়ে আরো তথ্য এসে জমা হতে শুরু করল এবং ১৯৫০ সালের মাঝামাঝি বিজ্ঞানীরা প্রায় নিঃসন্দেহ হয়ে গেলেন যে মঙ্গলগ্রহ প্রাণের বিকাশের উপযোগী একটা গ্রহ। মঙ্গলগ্রহে হালকা বায়ুমণ্ডল আছে, পৃথিবীর মতো গ্রীষ্মকাল এবং শীতকালে মঙ্গলগ্রহের মেরু অঞ্চলের বরফ কমেএবং বাড়ে। পুরো গ্রহটাই যেহেতু ফেরিক অক্সাইড দিয়ে ঢাকা কাজেই অক্সিজেন নিশ্চয়ই রয়েছে। দিন পৃথিবীর মতোই প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা। শুধু তাই নয়, মঙ্গলগ্রহের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস (বুধ গ্রহের তাপমাত্রা৩৫০ ডিগ্রি, প্লুটো শূন্যের নিচে -২০০ ডিগ্রি!)। এই গ্রহে যদি প্রাণের বিকাশ না হয় তাহলে প্রাণের বিকাশ হবে কোন গ্রহে?
১৮৭৭ সালে জিওভানি শিয়াপারেলি একটা সাংঘাতিক আবিষ্কারকরলেন। তিনি দেখলেন মঙ্গলগ্রহের দুই মেরুতে শুধু যে বরফ রয়েছে তাই নয়, মঙ্গলগ্রহ জুড়ে রয়েছে অসংখ্য খাল। গ্রীষ্মকালে বরফ গলে সেই খাল বেয়ে পানির প্রবাহ বইতে থাকে। সারা পৃথিবীর মানুষ চমকে ওঠে – এই খাল কোথা থেকে এলো? তাহলে কি মঙ্গলগ্রহে বুদ্ধিমান প্রাণী রয়েছে যারা খাল কেটে পানিসেচেরব্যবস’া করেছে? পৃথিবীতে রীতিমতো হইচই শুরু হয়ে গেল – শুধু মঙ্গলগ্রহকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করার জন্য বিশেষ অবজারভেটরি তৈরি হলো যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনাতে। জ্যোতির্বিজ্ঞানী পার্সিভাল লোভেল টেলিস্কোপে মঙ্গলগ্রহকে আরো খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করলেন। দীর্ঘ পর্যবেক্ষণ করে তিনি ঘোষণা করলেন, মঙ্গলগ্রহের এই খালগুলো সত্যি – এটি একটি কৃত্রিম সেচব্যবস’ার অংশ, যার অর্থ মঙ্গলগ্রহে নিশ্চয়ই বুদ্ধিমান প্রাণী রয়েছে যারা খাল কেটে পানি সেচকরে চাষাবাদ করেছে। মঙ্গলগ্রহের মাঝে মাঝে যে অন্ধকার অংশ রয়েছে সেটা নিশ্চয়ই বনাঞ্চল বা শস্যের আবাদভূমি। লোভেল অনেক পরিশ্রম করে মঙ্গলগ্রহের বিস্ময়কর সেচব্যবস’ার জন্য তৈরি সেই খালগুলোর ছবি প্রকাশ করলেন।
শুধু তাই নয়, ১৮৭৭ সালে যখন মঙ্গলগ্রহের সেচব্যবস’া আবিষ্কৃত হয়েছে ঠিক সেই সময়ে মঙ্গলগ্রহের দুটি চাঁদ আবিষ্কৃত হলো। চাঁদগুলো খুবই ছোট আকারের – দশ থেকে পনেরো মাইলের বেশি নয়। একটির নাম দেওয়া হলো সিমাস (যার অর্থ ‘আতঙ্ক’), অন্যটার ফোবোস (যার অর্থ ‘ভীতি’)। চাঁদগুলো যে শুধু অস্বাভাবিক ছোট তাই নয়, তার আকার মোটেও আমাদের চাঁদের মতো গোলাকার নয় – বিদঘুটে আকারের। তার চাইতেও বিচিত্র ব্যাপার, একটি চাঁদ এতো দ্রুত মঙ্গলগ্রহকে প্রদক্ষিণ করে (সাত ঘণ্টায়) যে মঙ্গলগ্রহ থেকে মনে হবে এটা উলটো দিকে ঘুরছে।
পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা চাঁদ-দুটো পর্যবেক্ষণ করে আরো একটাবিচিত্র জিনিস আবিষ্কার করলেন, তাঁরা দেখতে পেলেন, মঙ্গলগ্রহের চাঁদ-দুটো ফাঁপা। যার অর্থ হলো, এগুলো সম্ভবত কৃত্রিম উপগ্রহ! মানুষ থেকেও উন্নত কোনোপ্রাণী দশ মাইল বিস-ৃত এই বিশাল মহাকাশযান মহাকাশে পাঠিয়েছে।
মঙ্গলগ্রহে বুদ্ধিমান প্রাণী আছে ‘নিশ্চিত’ হয়ে যাওয়ার পর তারা দেখতে কেমন হতে পারে সেটা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা হতে থাকে। লেখকরা সায়েন্স ফিকশন লিখতে লাগলেন মঙ্গলগ্রহের প্রাণী নিয়ে, ছায়াছবি তৈরি হলো, শিল্পীরা ছবি আঁকতে লাগলেন।
বিজ্ঞানীরা যদি এখানেই থেমে যেতেন তাহলে ভারী মজা হতো –আমরা এখনো বিশ্বাস করতে পারতাম যে, সত্যিই সেখানে আমাদের চাইতে বুদ্ধিমান প্রাণী রয়েছে। কিন’ সেটা হয়নি। বিজ্ঞানের মধ্যে কোনো ফাঁকি নেই, একটা জিনিসকে নিয়ে জল্পনা-কল্পনা করতে কোনো দোষ নেই। কিন’ যতক্ষণ পর্যন- পুরোপুরি নিশ্চিত না হচ্ছেন বিজ্ঞানীরা পেছনে লেগে থাকেন। এবারও তাই হলো। বিজ্ঞানীরা মঙ্গলগ্রহের পেছনে লেগে রইলেন। ১৯৩০ সালে গ্রিক জ্যোতির্বিদ ইউজিনিস আনে-ানিয়দি মঙ্গলগ্রহের অত্যন- নিখুঁত ম্যাপ তৈরি করলেন। সেই ম্যাপে দেখা গেল, মঙ্গলগ্রহের সেচব্যবস’ার জন্যে খাল আসলে এক ধরনের দৃষ্টিবিভ্রম। মঙ্গলগ্রহের চাঁদ আসলে সৌরজগৎ তৈরি হওয়ার সময় মঙ্গলগ্রহেরমহাকর্ষ বলে আটকেপড়া দুটি গ্রহকণা (ধংঃবৎড়রফ)। পৃথিবীর মানুষ খুব আশা করেছিল, বুদ্ধিমান প্রাণী না থাকলেও হয়তো গাছপালা বা উদ্ভিদ জাতীয় কিছু আছে। কিন’ ১৯৬৫ সাল থেকে যখন মেরিনার মহাকাশযান মঙ্গলগ্রহের কাছাকাছি গিয়ে সেখান থেকে নিখুঁত ছবি পাঠাতে শুরু করল, পৃথিবীর মানুষ তখন আবিষ্কার করল এটি একটি প্রাণহীন পাথরের গ্রহ। বিস-ীর্ণ এলাকাজুড়ে লাল পাথর, মৃত আগ্নেয়গিরির চড়াই-উতরাইয়ের বেশি কিছু নয়। বিজ্ঞানীরা তবু আশা ছাড়তে চাইলেন না। তাহলে এমন কী হতে পারে যে সেখানে জীবাণুর মতো ক্ষুদ্র প্রাণ রয়েছে, যেটা খালি চোখে দেখা যায় না? সেটা পরীক্ষা করা জন্য ভাইকিং-১ পাঠালেন মঙ্গলগ্রহে ১৯৭৩ সালে। সেটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেও প্রাণের কোনো অসি-ত্ব খুঁজে পাওয়া গেল না।
তারপর অনেকদিন কেটে গেছে, মঙ্গলগ্রহ নিয়ে উত্তেজনাও বেশ কমেই এসেছিল; কিন’ গত বছর হঠাৎ নতুন করে উত্তেজনা শুরু হয়েছে। মঙ্গলগ্রহ থেকে উল্কা এসে পড়েছে পৃথিবীতে, সেখানে জৈব অণুর মতো কিছু চিহ্ন পাওয়া গেছে। আবার জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়ে গেল নতুন করে। তাহলে কি আগে প্রাণ ছিল মঙ্গলগ্রহে?
মঙ্গলগ্রহে যে বিশেষ শুকিয়ে যাওয়া নদীর তলদেশ পাওয়াযায়, একসময় নিশ্চয়ই সেই নদী দিয়ে বিশাল জলরাশি বয়ে যেত – সে-সময় কি কোনো ধরনের প্রাণের বিকাশ ঘটেছিল মঙ্গলগ্রহে?
বিজ্ঞানীরা জল্পনা-কল্পনা করতে ভালোবাসেন; কিন’ সিদ্ধান-টি নেন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। সেই সিদ্ধান-টিই নেওয়ার জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়েছে – মঙ্গলগ্রহে নতুন করে মহাকাশযান পাঠানো হয়েছে। আরো পাঠানো হবে। কয়েক বছরের ভেতর মানুষও যাবে সেখানে। সত্যিই কি প্রাণ ছিল এই গ্রহে – তার উত্তর নিশ্চয়ই খুঁজে পাওয়া যাবে একসময়।
বিশাল এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে মানুষ একেবারে একা – সেটা মনে হয় মানুষ এতো সহজে মেনে নিতে পারে না! আর হঠাৎ করে যখন কাকতালীয়ভাবে একটা বিচিত্র ঘটনা ঘটে যায় তখন কি সবাই নতুন করে চমকে ওঠে না? যেমন একটি বিচিত্র ছবি হঠাৎ মঙ্গলগ্রহ থেকে ভেসে এলো, মনে হচ্ছে মঙ্গলগ্রহের পৃষ্ঠেপ্রায় এক মাইল বিস-ৃত একটা পাথরে একটা মানুষের মাথা খোদাই করে রাখা আছে। সেটি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে মানুষের দিকে।
বিজ্ঞানীরা অবশ্য এটাকে আলো আর ছায়ার কারসাজি বলে উড়িয়ে দিলেন! এই নিয়ে বেশ কয়েকবার অনেককিছু হেসে উড়িয়ে দেওয়া হলো। যখন কোনো একটা ব্যাপার ঘটবে যেটা আর হেসে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না – কী মজাইনা হবে তখন।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল
[কালি ও কলম Volume 7 Issue 7 August 2010 এ প্রকাশিত]
Many thanks Sir for this fantastic far-sighted article.
Using Liquid Crystal Polymer fibrous assembly, we developed engineered structural fabric in Canada for NASA’s exploratory mission. It is a uniquely designed inflatable structure that permits safe landing on Mars.
Hi, Friend (যখন কোনো একটা ব্যাপার ঘটবে যেটা আর হেসে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না – কী মজাইনা হবে তখন।)
I can find My friend জাফর in that sentence.
Though his age is as my father.
কি স্যার।কি সব বিশয় নিয়া লিখেন?নিজের বিশয় নিয়া লিখেন।