কলামগবেষণায় হাতে খড়ি

কলাম: i-motif: ডিএনএ-এর নতুন কাঠামো

Share
Share

লেখক- আজিজুল হক
সহকারী অধ্যাপক, ইয়েংনাম বিশ্ববিদ্যালয়।

ডিএনএ (Deoxyribonucleic Acid) সম্পর্কে আমাদের প্রচলিত ধারণা মূলত ডাবল হেলিক্সের গঠনকেই কেন্দ্র করে, যা বিজ্ঞানী রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিনের (Rosalind Franklin) এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফি ছবি বিশ্লেষণ করে জেমস ওয়াটসন (James D. Watson) এবং ফ্রান্সিস ক্রিক (Francis Crick) ১৯৫৩ সালে আবিষ্কার করেন। তারা দেখান যে ডিএনএ দুটি সুতো দিয়ে তৈরি, যা একে অপরকে পেঁচিয়ে একটি সর্পিল আকৃতি গঠন করে। তবে সাম্প্রতিক এক গবেষণায় ডিএনএর একটি নতুন এবং রহস্যময় কাঠামো আবিষ্কৃত হয়েছে, যাকে বলা হচ্ছে i-motif। এটি ডাবল হেলিক্সের সাথে অনেকটাই ভিন্ন এবং এর আবিষ্কার জীববিজ্ঞানে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।

i-motif

i-motif-এর ধারণা প্রথমবারের মতো ১৯৯০-এর দশকে উত্থাপিত হয়। ডিএনএর গঠন নিয়ে গবেষণা করার সময় বিজ্ঞানীরা পরীক্ষাগারে এটি দেখতে পান। তবে, এই কাঠামোটি জীবন্ত কোষে কখনও সনাক্ত করা হয়নি, ফলে বিজ্ঞানীদের মধ্যে সন্দেহ ছিল যে এটি বাস্তবে জীবন্ত কোষে বিদ্যমান কিনা। কারণ এটি খুব অস্থিতিশীল এবং ধারণা ছিল যে শরীরের স্বাভাবিক শারীরিক অবস্থায় এটি টিকে থাকতে পারবে না। তবে, ২০১৮ সালে অস্ট্রেলিয়ার গারভান ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল রিসার্চের গবেষকরা জীবন্ত মানব কোষে প্রথমবারের মতো i-motif সনাক্ত করেন। তারা একটি বিশেষ অ্যান্টিবডি তৈরি করেন যা শুধুমাত্র i-motif-এর সঙ্গে সংযুক্ত হয়, যার ফলে তারা সহজেই এই কাঠামোটি কোষে শনাক্ত করতে সক্ষম হন। এই অ্যান্টিবডির মাধ্যমে তারা দেখতে পান যে i-motif মানব কোষের বিভিন্ন অংশে উপস্থিত এবং এটি একটি সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে।

i-motif এবং ডাবল হেলিক্সের মধ্যে পার্থক্য

ডিএনএ-এর ডাবল হেলিক্স গঠন দুইটি সুতা নিয়ে গঠিত, যেখানে প্রতিটি সুতায় চারটি নিউক্লিওটাইড (Adenine, Thymine, Cytosine, এবং Guanine) নির্দিষ্ট নিয়ম অনুযায়ী জোড়া বাঁধে। Adenine (A) সর্বদা Thymine (T)-এর সাথে এবং Cytosine (C) সর্বদা Guanine (G)-এর সাথে জোড়া বাঁধে। এই সজ্জা ডিএনএর স্থায়িত্ব ও তথ্য সংরক্ষণের জন্য অপরিহার্য। অন্যদিকে, i-motif এর গঠন ডাবল হেলিক্সের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে, Cytosine (C) ভিত্তিগুলি একে অপরের সাথে সংযুক্ত হয়, সাধারণ G (Guanine) ভিত্তির পরিবর্তে। এই গঠনটি একটি ছোট গিঁটের মতো বাঁকানো অবস্থায় থাকে, যা ডাবল হেলিক্সের সোজা ও পেঁচানো গঠনের তুলনায় আলাদা। i-motif সাধারণত ডিএনএ-এর নির্দিষ্ট অঞ্চলে তৈরি হয়, বিশেষ করে যখন ডিএনএ-তে কম pH বা অ্যাসিডিক পরিবেশ বিদ্যমান থাকে। এই অবস্থায়, Cytosine ভিত্তিগুলি একে অপরের সাথে যুক্ত হয়ে একটি বিশেষ চার-স্তরের গঠন তৈরি করে। i-motif-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো এর অস্থায়িত্ব এবং পরিবর্তনশীলতা। এটি কোষের পরিবেশের ওপর নির্ভর করে গঠিত হয় এবং সহজেই খুলে যায়। যখন পরিবেশ অ্যাসিডিক থাকে, তখন এটি গিঁটের মতো বাঁকানো থাকে, এবং যখন পরিবেশ স্বাভাবিক অবস্থায় থাকে, তখন এটি আবার খুলে যায়। এই অস্থায়িত্বের কারণেই i-motif কে ডাবল হেলিক্সের মতো স্থায়ী গঠন হতে আলাদা করে। ডাবল হেলিক্স সাধারণত পরিবেশগত পরিবর্তনের সাথে সহজেই পরিবর্তিত হয় না এবং এটি অনেক বেশি স্থিতিশীল।

i-motif এর গুরুত্ব

i-motif এর আবিষ্কার কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? কারণ এটি আমাদের ডিএনএ নিয়ে প্রচলিত ধারণাগুলিকে সম্পূর্ণ নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করতে সাহায্য করছে। প্রথমত, এটি প্রমাণ করে যে ডিএনএ শুধু ডাবল হেলিক্সে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এর গঠন আরও বৈচিত্র্যময় হতে পারে। ডিএনএ’র এই নতুন গঠন জীবন্ত কোষের জিন নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়ার সাথে সরাসরি যুক্ত। i-motif সাধারণত এমন জায়গায় পাওয়া যায় যা জিন নিয়ন্ত্রণ এবং অভিব্যক্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি এমন একটি সুইচের মতো কাজ করতে পারে, যা নির্ধারণ করে কোন জিন সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় হবে। দ্বিতীয়ত, i-motif এর অ্যাসিডিক পরিবেশের উপর নির্ভরশীলতা এটিকে কোষের কাজ এবং বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। কোষের বিভিন্ন কাজ যেমন বিভাজন, বৃদ্ধির সময়, এবং জিনের নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়ায় pH বা অ্যাসিডিটির পরিবর্তন ঘটতে পারে। i-motif এই পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম, এবং এটি জিনের অভিব্যক্তি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে পারে।

i-motif এর ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

i-motif এর আবিষ্কার ডিএনএ গবেষণায় নতুন দিক উন্মোচন করেছে। এটি শুধুমাত্র জিন নিয়ন্ত্রণে নয়, ভবিষ্যতে রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানেও নতুন সম্ভাবনার জন্ম দেবে। একটি সম্ভাবনা হল i-motif এর সাহায্যে জেনেটিক রোগ যেমন ক্যান্সার এবং অন্যান্য জিনগত রোগ নিয়ন্ত্রণ করা। যেহেতু এটি জিনের সক্রিয়তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তাই এই কাঠামো ব্যবহার করে জিনের কার্যক্রম সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ক্যান্সার কোষের অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি বন্ধ করতে i-motif এর সুইচিং পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে। i-motif এর গবেষণা আরও উন্নত হলে, এটি ভবিষ্যতে জিন থেরাপি এবং জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। জেনেটিক রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে এটি নতুন নতুন পথ উন্মোচন করবে বলে বিজ্ঞানীরা আশা করছেন।


বিদ্র: ফেসবুক থেকে সংগ্রহীত:——–
https://www.facebook.com/share/p/1PJMzziHgF/

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

Related Articles
গবেষণায় হাতে খড়িবিজ্ঞান বিষয়ক খবর

AI টুলের মাধ্যমে গবেষণাপত্রের গুণগত মান বৃদ্ধি

একাডেমিক লেখায় ব্যাকরণ, স্পষ্টতা এবং শৈলী উন্নত করতে সাহায্য করে এমন শীর্ষ...

উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার সুযোগগবেষণায় হাতে খড়ি

গবেষণাপত্র খুঁজে পাওয়ার ৩টি গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক টুল

গবেষণাপত্রগুলি সহজেই খুঁজে পেতে, পড়তে এবং বুঝতে সাহায্য করার জন্য 3টি শক্তিশালী...

গবেষণায় হাতে খড়িজেনেটিকস

ওমিক্স ডেটা (Omics Data)

জিনোমিক্স থেকে প্রোটিওমিক্স পর্যন্ত - ওমিক্স ডেটা কীভাবে জীববিজ্ঞান এবং চিকিৎসায় বিপ্লব...

কলামগবেষণায় হাতে খড়ি

কলাম: সাইটেশন নয়, মানই আসল: গবেষক মূল্যায়নে নতুন ভাবনা

শুধু উদ্ধৃতি গণনা কি একজন ভালো গবেষককে সংজ্ঞায়িত করতে পারে? বাংলাদেশের বাস্তব...

উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার সুযোগগবেষণায় হাতে খড়ি

ORCID: গবেষকদের পরিচয় নিশ্চিত করার আধুনিক প্ল্যাটফর্ম

ORCID ID কীভাবে গবেষকদের জন্য বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি নিশ্চিত করে, নাম বিভ্রান্তি রোধ...

Three Columns Layout

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact

biggani.org❤️gmail.com

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

বিজ্ঞানী অর্গ (biggani.org) বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে গবেষণা ও বিজ্ঞান নিয়ে বাংলা ভাষায় তথ্য ও সাক্ষাৎকার প্রচার করে – নবীনদের গবেষণা ও উচ্চশিক্ষায় প্রেরণা দেয়া হয়।

যোগাযোগ:

biggani.org@জিমেইল.com

biggani.org, a community of Bangladeshi scientists, shares interviews and information about researchers and scientists in Bengali to inspire young people in research and higher education.