মুহাম্মদ কুদরাত-ই-খুদা (১৮৯৫–১৯৭৭) ছিলেন বাংলাদেশের একজন স্বনামধন্য বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, গবেষক, এবং ভাষা ও বিজ্ঞান শিক্ষার অগ্রপথিক। তিনি শুধু একজন রসায়নবিদ বা গবেষক ছিলেন না, বরং ছিলেন এক বহুমুখী প্রতিভা, যিনি বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা ও শিক্ষাবিষয়ে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিলেন। তাঁর জীবন ও কর্ম বাংলাদেশের শিক্ষা, বিজ্ঞান, সাহিত্য এবং সংস্কৃতিতে গূঢ় প্রভাব ফেলেছে, যা স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে অসামান্য অবদান রেখেছে।
জন্ম ও শৈশব
মুহাম্মদ কুদরাত-ই-খুদার জন্ম হয়েছিল ১৮৯৫ সালের ১২ ডিসেম্বর, তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের অধীনে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার মারগ্রাম গ্রামে। তাঁর পরিবার ছিল মধ্যবিত্ত ও ধর্মপরায়ণ, কিন্তু সেই সঙ্গে ছিল শিক্ষানুরাগী। পরিবার থেকেই তিনি ছোটবেলায় বিজ্ঞান চর্চা, জ্ঞানার্জন, ও পাঠাভ্যাসের প্রতি অনুরাগ লাভ করেন। প্রাথমিক শিক্ষা শেষে তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে রসায়নশাস্ত্রে অনন্য ফলাফল নিয়ে স্নাতক পাস করেন। পরবর্তীতে উচ্চশিক্ষার জন্য ইংল্যান্ডের লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট (D.Sc) ডিগ্রি অর্জন করেন। লন্ডন থেকে ফিরে এসে তিনি উপমহাদেশের বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতির বিকাশে নিজেকে নিবেদিত করেন।
পেশাগত জীবন ও গবেষণা
ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জনের পর মুহাম্মদ কুদরাত-ই-খুদা কলকাতায় শিক্ষকতা শুরু করেন। ভারত ভাগের পর তিনি পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) চলে আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা ও গবেষণার সাথে যুক্ত হন। তিনি মূলত রসায়ন শাস্ত্রে বিশেষজ্ঞ ছিলেন, বিশেষ করে জৈব রসায়ন এবং খাদ্য রসায়ন ক্ষেত্রে তাঁর অবদান উল্লেখযোগ্য। তাঁর গবেষণার মধ্যে ছিল দেশীয় সম্পদ—যেমন পাট (জুট) থেকে গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক পদার্থ ও সেলুলোজ ভিত্তিক পণ্য উন্মোচন করার চেষ্ট। তিনি দেখিয়েছিলেন যে পাট থেকে সেলুলোজ নিষ্কাশন ও এর বহুমুখী ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন মাত্রা পেতে পারে।
জ্ঞানচর্চায় বাংলা ভাষার প্রসার
মুহাম্মদ কুদরাত-ই-খুদা ছিলেন এক অসাধারণ চিন্তাবিদ, যিনি বিশ্বাস করতেন বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং উচ্চতর জ্ঞান শুধু ইংরেজি বা অন্য কোনও বিদেশি ভাষায় সীমাবদ্ধ রাখা উচিত নয়। তিনি মনে করতেন বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা ও পাঠদান করতে হবে, যাতে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম সহজেই বিজ্ঞানকে বুঝতে এবং কাজে লাগাতে পারে।
এই উদ্দেশ্যে তিনি বাংলা ভাষায় অসংখ্য বিজ্ঞানবিষয়ক গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর লেখা “বিজ্ঞান সাধনা,” “বিজ্ঞান কথা,” “ব্যাকরণ ও বিজ্ঞান,” ইত্যাদি বইগুলো বিদ্যার্থীদের বিজ্ঞান শিক্ষার ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করে। তিনি বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের পরিভাষা তৈরিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন, ফলে জটিল বৈজ্ঞানিক বিষয় সহজবোধ্যভাবে পাঠকের কাছে তুলে ধরা সম্ভব হয়।
শিক্ষা সংস্কারে অবদান
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি ও নতুন কাঠামো গড়ে তোলার লক্ষ্যে সরকার ১৯৭২ সালে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করে, যা “কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন” নামে পরিচিত। এই কমিশন শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর একটি ঐতিহাসিক প্রয়াস ছিল। কমিশনের মূল উদ্দেশ্য ছিল একটি বিজ্ঞানমনস্ক, মানবিক, এবং গণমুখী শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা, যা জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ এবং উন্নয়নমুখী জ্ঞানসমৃদ্ধ নাগরিক তৈরি করবে।
কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন অনুসারে:
- প্রাথমিক স্তর থেকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর পাঠ্যক্রম চালু করা।
- মাতৃভাষায় পাঠদান নিশ্চিত করা।
- কারিগরি শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের ওপর জোর দেওয়া।
- ছাত্রদের সৃজনশীলতা ও গবেষণামূলক চিন্তার বিকাশে উৎসাহ প্রদান।
এই শিক্ষানীতি পরবর্তীতে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যাপক প্রভাব ফেলে। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান শিক্ষার ওপর যত জোর তিনি দিয়েছেন, তা আজও প্রাসঙ্গিক। উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় দেশীয় সম্পদের ব্যবহার, স্থানীয় সমস্যা সমাধানে বিজ্ঞান প্রয়োগ ইত্যাদি বিষয় তাঁর দর্শনে অন্তর্ভুক্ত ছিল।
বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠান গঠনে ভূমিকা
মুহাম্মদ কুদরাত-ই-খুদা ছিলেন বাংলাদেশ কাউন্সিল অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ (BCSIR)-এর প্রথম চেয়ারম্যান। এই প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞান গবেষণা ও শিল্পায়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। কুদরাত-ই-খুদা এর নেতৃত্বে BCSIR দেশে প্রয়োগমুখী গবেষণার ধারা চালু করে। দেশীয় কাঁচামালকে বিভিন্ন শিল্পজাত পণ্যে রূপান্তরের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা এবং স্থানীয় সমস্যা সমাধানে বিজ্ঞানকে কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন পথিকৃৎ।
এছাড়াও তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারে বিভিন্ন উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন, যাতে দেশীয় বিজ্ঞান গবেষণা ও প্রযুক্তি বিকাশে অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়। সরকারী নীতিমালা প্রণয়নে তাঁর উপদেশ ও মতামত ছিল দূরদর্শী এবং বাস্তবমুখী।
বিজ্ঞান ও সাহিত্যের মেলবন্ধন
কুদরাত-ই-খুদা শুধু একজন বিজ্ঞানীই ছিলেন না; তিনি ছিলেন একজন সাহিত্যপ্রেমী ও সংস্কৃতিবান মানুষ। তিনি বিশ্বাস করতেন যে বিজ্ঞান ও সাহিত্য একে অপরের পরিপূরক। বিজ্ঞান আমাদের বস্তুনিষ্ঠ সত্যের সন্ধান দেয়, আর সাহিত্য আমাদেরকে মানবিক উপলব্ধি ও অনুভবের জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। এই দুইয়ের মেলবন্ধনেই পূর্ণাঙ্গ শিক্ষার বিকাশ সম্ভব।
তিনি চেয়েছিলেন ছাত্রছাত্রীরা একাধারে বিজ্ঞানমনস্ক হোক, আবার মানবিক মূল্যবোধে জারিত হোক। একারণে তিনি তাঁর রচনায় বিজ্ঞানকে কেবল শুষ্ক তথ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সহজ গল্প, উপমা, রূপক ও সাহিত্যিক ভাষার মাধ্যমে তুলে ধরতেন। ফলে বিজ্ঞানের কূট তত্ত্বগুলো পাঠকদের কাছে হয়ে উঠতো সহজবোধ্য ও আকর্ষণীয়।
স্বীকৃতি ও পুরস্কার
মুহাম্মদ কুদরাত-ই-খুদার অনন্য অবদানের স্বীকৃতি দিতে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে। এটি দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা। এ ছাড়াও তিনি নানা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মাননা লাভ করেন। তাঁর বৈজ্ঞানিক, সাহিত্যিক ও শিক্ষামূলক অবদান শুধু তখনকার সমাজকেই নয়, আজকের বাংলাদেশকেও আলোকিত করছে। বিজ্ঞানের প্রসার, মাতৃভাষায় শিক্ষাদান, এবং স্থানীয় সম্পদকে কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের যে মডেল তিনি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, তা আজও শিক্ষাবিদ, নীতিনির্ধারক ও গবেষকদের অনুপ্রাণিত করে।
ব্যক্তিগত জীবন ও দর্শন
কুদরাত-ই-খুদা ছিলেন সাদাসিধে, বিনয়ী, ও মানবসেবায় নিজেকে নিবেদনকারী একজন আলোকিত মানুষ। তিনি বিশ্বাস করতেন জ্ঞান ও মানবিকতাই একটি সমৃদ্ধ ও সভ্য সমাজের মূল চাবিকাঠি। তাঁর অনুপ্রেরণা ছিল তরুণ প্রজন্মের সম্ভাবনা। তিনি ছাত্রদের সবসময় উৎসাহ দিতেন প্রশ্ন করতে, যুক্তি খোঁজে বের করতে, এবং নতুন চিন্তা ও উদ্ভাবনী চেতনা বিকাশে মনোনিবেশ করতে।
তিনি বারবার বলতেন, বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের সামনে সবচেয়ে বড় সম্পদ এর মানুষ। যদি মানুষকে সঠিকভাবে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-শিক্ষায় দক্ষ করে গড়ে তোলা যায়, তবে এই দেশ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে। আর এই লক্ষ্য অর্জনে মাতৃভাষায় বিজ্ঞানশিক্ষা, গবেষণা এবং স্থানীয় সম্পদকে বিজ্ঞানভিত্তিক পণ্যে রূপান্তর করার প্রচেষ্টা অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
মৃত্যু ও উত্তরাধিকার
মুহাম্মদ কুদরাত-ই-খুদা ১৯৭৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুতে বাংলাদেশ হারায় এক মহান চিন্তাবিদ, বিজ্ঞানী এবং শিক্ষা সংস্কারককে। কিন্তু তিনি রেখে গেছেন অমর আদর্শ এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো। আজও BCSIR ও অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান তাঁর দেখানো পথে চলছে। শিক্ষা ব্যবস্থায় তাঁর দেওয়া পরিকল্পনা ও দর্শন বীজরূপে রয়ে গেছে, যা পরবর্তীতে নানা শিক্ষানীতিতে প্রতিফলিত হয়েছে।
বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার ধারা, মাতৃভাষাভিত্তিক পাঠ্যক্রম, এবং প্রযুক্তি উদ্ভাবনে স্থানীয় সম্পদ ব্যবহারের যে ধারণা তিনি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, তা এখনো প্রাসঙ্গিক। তরুণ বিজ্ঞানী, গবেষক, শিক্ষক, ও শিক্ষানীতিনির্ধারকরা তাঁর জীবন ও কর্ম থেকে অনুপ্রেরণা গ্রহণ করে চলেছেন। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার যুগে দাঁড়িয়েও কুদরাত-ই-খুদার মতামত ও দিকনির্দেশনা স্মরণ করিয়ে দেয়—মাতৃভাষাভিত্তিক বিজ্ঞান শিক্ষা ও গবেষণা একটি জাতির জ্ঞানভিত্তিক বিকাশের মূল ভিত্তি হতে পারে।
উপসংহার
মুহাম্মদ কুদরাত-ই-খুদা ছিলেন এমন এক ব্যক্তিত্ব, যিনি দেশ, ভাষা, শিক্ষা, বিজ্ঞান ও মানবকল্যাণকে এক সূত্রে গাঁথতে চেয়েছিলেন। তিনি দেখিয়েছেন যে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান কেবলমাত্র বিদেশি ভাষার গণ্ডিতে আবদ্ধ রাখা উচিত নয়, বরং মাতৃভাষায় উপস্থাপন করে স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে একীভূত করা যেতে পারে। তাঁর কর্ম বাংলাদেশের শিক্ষা ও গবেষণার পথকে আলোকিত করেছে, বিজ্ঞানের প্রসারে এদেশের মানুষকে আত্মবিশ্বাসী করেছে, এবং স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে একটি বিজ্ঞানমনস্ক জাতি গঠনে অমূল্য ভূমিকা রেখেছে।
এভাবেই মুহাম্মদ কুদরাত-ই-খুদা চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন জ্ঞান, বিজ্ঞান ও মানবিকতায় আলোকিত এক অগ্রপথিক হিসেবে। তাঁর জীবনগাথা ও আদর্শ আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয় যে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়তে হলে মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চা, মৌলিক গবেষণা, এবং সর্বস্তরে শিক্ষার প্রসার অপরিহার্য। তাঁর মতো একজন মনীষীর সৃষ্ট পথ আজও আমাদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য পথনির্দেশক আলোকবর্তিকা হিসেবে রয়ে গেছে।
Leave a comment