আবর্জনা থেকে শক্তি

ভূমিকাঃ
প্রতিদিনই কমবেশি সকল বাসা বাড়িতেই আবর্জনা হয়। আমরা সেসব আবর্জনা ফেলে
দেই । কিন্তু আপনারা কি জানেন, আবর্জনা থেকেও তৈরি করা সম্ভব শক্তি।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই এখন আবর্জনা থেকে শক্তি উৎপাদন করা হচ্ছে।
বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৩৫টিরও বেশি দেশে রয়েছে আবর্জনা থেকে শক্তি
উৎপাদনের প্লান্ট। তবে এদের মধ্যে শীর্ষ স্থানীয় ৫টি দেশ হলো ডেনমার্ক,
সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, আমেরিকা ও স্পেন। আবর্জনাকে পুড়িয়ে শক্তি
উৎপাদনের জন্য রয়েছে বিশেষ ধরনের প্লান্ট। সারা বিশ্বে এরকম প্লান্টের
সংখ্যা ৬০০-র বেশি। আর এসব প্লান্টে থেকে উৎপাদিত শক্তি ব্যবহার করা যাবে-
-স্টিম বা বাষ্প উৎপাদন করে শীত প্রধান দেশে কক্ষ গরম রাখতে।
-বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে।

আবর্জনা থেকে শক্তি উৎপাদনের কৌশলঃ
কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্লান্ট আর আর্বজনা থেকে শক্তি উৎপাদনের
প্লান্ট মোটামুটি একইরকম। শুধুমাত্র জ্বালানীটা আলাদা- কয়লার পরিবর্তে
আর্বজনা। এসব প্লান্ট বিদ্যুৎ তৈরির ধাপগুলো হলো-

প্রথম ধাপ, আবর্জনা পুড়িয়ে প্রথমে তা থেকে তাপশক্তি উৎপন্ন হয়।
দ্বিতীয় ধাপ, উৎপন্ন তাপশক্তি দিয়ে পানি থেকে বাষ্প উৎপন্ন করা যায়।
তৃতীয় ধাপ, উৎপন্ন বাষ্প দিয়ে টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়।

আসলে প্রচলিত পাওয়ার প্লান্টগুলোতে যে রকমভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা
হয়, আবর্জনা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রক্রিয়াও একই রকম। তবে কয়লা থেকে
সে পরিমাণ তাপশক্তি পাওয়া যায়, আবর্জনা থেকে ততোটা তাপশক্তি পাওয় যায়
না। সাধারণত ২০০০ পাউন্ড আবর্জনা পুড়িয়ে সে পরিমাণ তাপশক্তি পাওয়া
যায়, ৫০০ পাউন্ড কয়লা পুড়িয়ে ততোটা তাপশক্তি পাওয়া যায়।
ছবি
ছবিঃ
২০০০ পাউন্ড আবর্জনা পুড়িয়ে সে পরিমাণ তাপশক্তি পাওয়া যায়, ৫০০ পাউন্ড কয়লা পুড়িয়ে ততোটা তাপশক্তি পাওয়া যায়।

আবর্জনা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার জন্য বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পাশাপাশি
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকরা একটি কার্যকর ‘মোবাইল ওয়েস্ট টু
এনার্জি’ কনভার্টার তৈরির ব্যাপারে চেষ্টা করছেন। এই মোবাইল এনার্জি টু
ওয়েস্ট কনভার্টারটি বিভিন্ন ধরনের আবর্জনা পুড়িয়ে তা থেকে বিদ্যুৎ
উৎপাদন করতে পারবে। এছাড়াও এই কনভার্টারটিকে যুদ্ধক্ষেত্রে আমেরিকান
সৈন্যদের জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ করতেও ব্যবহার করা হবে বলে চিন্তা করছেন
গবেষকরা। এরকম একটি কার্যকর কনভার্টার তৈরি পুরোপুরি সফল হলে হয়তো
ভবিষ্যতে বাসাবাড়িতে এই কনভার্টার ব্যবহার করা যাবে। এবং এসব কনভার্টারের
মাধ্যমে আমরা ঘরের আবর্জনা দিয়ে নিজেরাই বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে নিজেদের
চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হবো।

আবর্জনায় শক্তির উৎসঃ
প্রশ্ন হলো আবর্জনার শক্তির উৎসটা কি ? আমরা এবার এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে
চেষ্টা করবো। আবর্জনাতে অন্যান্য ময়লার পাশাপাশি থাকে বিভিন্ন ধাতু,
কাগজ, প্লাস্টিক। প্লাস্টিক সাধারণত তৈরি করা হয় পেট্রোলিয়াম
(হাইড্রোকার্বন) থেকে। এছাড়াও আবর্জনাতে অন্যান্য জৈব পদার্থ থাকে যা
শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করেছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ আবর্জনা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলেও এ নিয়ে বিতর্কও
রয়েছে। বর্তমানে প্রকৌশলীদের কাছে একটি পছন্দের শব্দ হচ্ছে ‘Recycle’।
‘Recycle’ হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে আবর্জনা থেকে পুনরায়
ব্যবহার উপযোগী জিনিস প্রক্রিয়াজাত করা যায়। অনেকেই আবর্জনা পুড়ানোর
পরিবর্তে তা Recycle করার পক্ষপাতী। এই প্রক্রিয়ার বিভিন্ন সুবিধা
রয়েছে। Recycle করায় উৎপাদিত জিনিসের দাম কমে যায়।সুবিধার পাশাপাশি
অসুবিধাও আছে।যেমন:রঙিন এবং উজ্জ্বল বা গ্লসি কাগজ Recycle করা বেশ কঠিন।
তাই বলা যায়, দুটি প্রক্রিয়াই ব্যবহারযোগ্য। আবর্জনা থেকে বিদ্যুৎ তৈরির
এসব প্লান্টে আবর্জনার বেশিরভাগ অংশই পুড়ে যায়। তবে আবর্জনার কিছু অংশ
আছে যা পুড়ে না। একে বলা হয় অ্যাশ। এই অ্যাশের প্রধান অংশ হলো বিভিন্ন
ধরনের ধাতু। এসব অ্যাশ থেকে বিভিন্ন ধাতু পুনরুদ্ধার করে আবার বিভিন্ন
কাজে ব্যবহার করা সম্ভব।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কাগজ ও প্লাস্টিক সমৃদ্ধ আবর্জনার প্রায় ৮০% এরও বেশি
অংশ পুড়িয়ে তা থেকে শক্তি উৎপাদন করা সম্ভব। সাধারণ ১ টন আবর্জনা থেকে
৫২৫ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা সম্ভব।
কয়লা একটি প্রাকৃতিক সম্পদ। কয়লার মজুদ ফুরিয়ে আসলে হয়তো আবর্জনাই হবে
এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর প্রধান জ্বালানী। আবর্জনা থেকে বিদ্যুৎ
উৎপন্নকারী শীর্ষস্থানীয় দেশ ডেনমার্ক আবর্জনার ৫৪ শতাংশেরও বেশি
পুড়িয়ে তা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি
আরেকটি সুবিধা পাওয়া যায়। তা হলো বেশিরভাগ আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলায় বাকি
আবর্জনা ফেলতে জায়গা কম লাগে।

আবর্জনা থেকে শক্তি এবং পরিবেশ দূষণঃ
বিভিন্ন বিকল্প শক্তির উৎস ব্যবহারের সময় সব সময় একটা ব্যাপার খেয়াল
রাখা হয়, তা হলো পরিবেশ দূষণ। আবর্জনা থেকে শক্তি উৎপাদনের প্লান্টে
আবর্জনা পোড়ানোর ফলে উৎপন্ন হতে পারে বিষাক্ত গ্যাস এবং বিভিন্ন ধরনের
কণা যা পরিবেশ দূষণ ঘটাতে পারে। পরিবেশ দূষণ রোধ করার জন্য এসব প্লান্টে
ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন ধরনের পৃথকীকরণ যন্ত্র (Separator) এবং ফিল্টার।
এগুলো হলোÑ
-স্ক্রাবার (Scrubber)
-ফেব্রিক ফিল্টার (Fabric filter)
-ইলেকট্রোস্ট্যাটিক প্রেসিপিটেটর (Electrostatic Precipitator)
ছবি
ছবিঃ আবর্জনা থেকে শক্তি উৎপাদনের প্লান্ট

এছাড়াও এ প্লান্টে আছে এক ধরনের বিল্ট-ইন পরিবেশ দূষক নিয়ন্ত্রক
ডিভাইস। এ প্লান্টে আবর্জনা পুড়ানো হয় খুব উচ্চ তাপমাত্রায় (১৮০০-২০০০
ডিগ্রী ফারেনহাইট)। এর ফলে বিষাক্ত জটিল যৌগগুলো ভেঙ্গে অপেক্ষাকৃত কম
বিষাক্ত যৌগ উৎপন্ন হয়। যা পরিবেশের জন্য ইতিবাচক।

বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটঃ
আবর্জনা ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশের বেশিরভাগ জায়গাতেই একটি মাথাব্যাথার
বিষয়। বাংলাদেশ ন্যাশনাল এনার্জি পলিসি ২০০৪-এ ঢাকা শহরের আবর্জনা থেকে
বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যাপারে কিছু প্রকল্প হাতে নেয়ার কথা বলা হয়েছিল।
অবশ্য এরকম কোন প্রকল্প এখন পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। এধরনের প্রকল্প
বাস্তবায়িত হলে বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণের পাশাপাশি আবর্জনা ব্যবস্থাপনার
বিষয়টিও অনেক সহজ হয়ে যাবে। ১৯৯৭ সালের অক্টোবরে CGEA-ONYX নামক
ফ্রান্সের একটি সংস্থা ঢাকা শহরে আবর্জনা থেকে শক্তি উৎপাদনের সম্ভাব্যতা
যাচাইয়ের জন্য একটি জরিপ করেছিল। এই জরিপ অনুসারে ঢাকা শহরে কঠিন
আবর্জনার পরিমাণ-

উৎস পরিমাণ
ঘর-বাড়ি ১৪০০ টন
বাণিজ্যিক ৬০০ টন
শিল্প কারখানা ৮০০ টন
মেডিকেল ২০০ টন

আমাদের দেশে এই মুহূর্তে প্রধান সমস্যাগুলোর একটি হলো বিদ্যুৎ সমস্যা।
তাই আমাদের দেশেও আবর্জনা থেকে বিদ্যুৎ তৈরির বিষয়টি আরও গুরুত্বের সাথে
ভেবে দেখা দরকার।

 

লেখাটি টেকনোলজি টুডে, আমাদের প্রযুক্তি এবং আমার ব্লগে প্রকাশিত 

About বিপ্র রঞ্জন ধর

Check Also

‘জিনোম এডিটিং’ বিষয়ে বাংলা ভাষায় প্রথম বই

প্রথমবারের মতো এইবারের ২০২৩ এর একুশে বই মেলায় আসছে বাংলাদেশ ও বিশ্ব বিজ্ঞান একাডেমির ফেলো …

ফেসবুক কমেন্ট


  1. Thank you for ur nice information.Also thanks for bengali version.

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।