কবির হোসেনঃ ধন্যবাদ। আমার বাড়ি ঢাকার কেরানীগঞ্জে, সেখানেই বেড়ে উঠেছি। আমি বর্তমানে ডেনমার্কের ‘টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি অব ডেনমার্ক’ -এ পি,এইচ,ডি করছি। আমি এস,এস,সি পর্যন্ত পড়াশুনা করেছি ঢাকার কেরানীগঞ্জের একটি স্কুলে। তারপর এইচ,এস,সি করি পুরাণ ঢাকার গর্ভমেন্ট শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ থেকে। আগে থেকেই কম্পিউটারের প্রতি আকর্ষণ ছিল তাই ঢাকায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার প্রকৌশলে ভর্তি হয়েছিলাম ব্যাচেলর করার জন্য। সেখানে পড়া অবস্থায় কোরিয়ান গভর্নমেন্ট স্কলারশিপ(কেজিএসপি) এ আন্ডারগ্রাজুয়েট করার সুযোগ হয়। তাই ২০০৮ সালে চলে যাই কোরিয়াতে এবং সেখান থেকে ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্যাচেলর ডিগ্রি সম্পন্ন করি। ব্যাচেলর করা অবস্থায় সেখানে ‘ইনটেলিজেন্ট ইমেজ মিডিয়া এবং ইন্টারফেসিং’ ল্যাবে কাজ করার সুযোগ ঘটে, সেখানে মূলত ইমেজ প্রসেসিং, অবজেক্ট বিশেষ করে হিউমেন ট্র্যাকিং এর উপর কাজ করি। পরবর্তীতে সেই ল্যাব থেকেই প্রফেসর মাস্টার্সের স্কলারশিপ দেন। আমি ২০১৩ সালে মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পূর্ণ করি। মাস্টার্স শেষে স্যামসাং এর বাংলাদেশ ব্যাঞ্চে জয়েন করি সিনিয়র সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার পদে। বছর দুয়েক চাকরি করার পর ২০১৫ সালে ডেনমার্কে পিএইচডি স্কলারশিপ নিয়ে আসি। ডেনমার্কে আসার পরে আমার ছেলের জন্ম হল, এইতো এখন এখানে বউ, ছেলে আর একাডেমিক পড়াশুনা নিয়ে ভালই আছি ।
কবির হোসেনঃ বর্তমানে ড্রোন নিয়ে অনেক কাজ হচ্ছে কারণ এর অনেক ধরনের এপ্লিকেশন আছে যেমন ড্রোন দিয়ে মুভি শুট করা, সিকিউরিটি নিশ্চিন্ত করা, বন্যপ্রাণী ট্র্যাকিং করা, সোলার প্যানেলের কোন ডিফেক্ট আইডেন্টিফাই করা এবং মাটির নিচ দিয়ে যেই গ্যাসের পাইপ আছে সেখানে কোন ফাটল ধরেছে কিনা সেটাও ড্রোন দিয়ে আইডেন্টিফাই করা যায়। এই কাজগুলো হেলিকপ্টার, গাড়ি বা ম্যানুয়ালি করলে অনেক সময় সাপেক্ষ এবং খরচের ব্যাপার হয়, সেই ক্ষেত্রে ড্রোন প্রযুক্তি ব্যাবহার করলে খুব সহজে এবং কম খরচেই এগুলো করা যায়, এর জন্যই মূলত ড্রোন নিয়ে চারদিকে এত হইচই হচ্ছে।
কবির হোসেনঃ আমি উপরের প্রশ্নে ড্রোনের বেশ কিছু এপ্লিকেশনের ব্যাপারে আলোচনা করেছি। এই প্রত্যেকটি এপ্লিকেশনে ভিডিও ইনভল্ভ আছে। ড্রোনের কাজ হচ্ছে ভিডিও ধারণ করা, বাকি কাজ এর পর। এই ভিডিও গুলোর উপর এডভান্স কম্পিউটার ভিশন এলগোরিদম ব্যাবহার করে সোলার প্যানেলের ডিফেক্ট আইডেন্টিফাই করা, অবজেক্ট ডিটেক্ট করা, বন্যপ্রাণী ট্রাক করামত কাজগুলো কম্পিউটার সফটওয়্যার দিয়ে করা হয়। তাই এখানে ভিডিও কোয়ালিটি যদি ভাল না হয় তাহলে এই কাজগুলো করা যাবে না। এর জন্যই মূলত ভিডিও কোয়ালিটি এস্টিমেশনের প্রশ্ন আসে। আমি আরেকটু স্পিসিফিকভাবে এই ব্যাপারে বলতে চাই। আমরা বর্তমানে দুটো ড্রোন কোম্পানির সাথে কাজ করছি। আমাদের এপ্লিকেশন হল মাটির নিচ দিয়ে যেই গ্যাসের লাইন গিয়েছে সেখানে কোন ফাটল ধরেছে কিনা ড্রোন দিয়ে সেটা যেন আইডেন্টিফাই করা যায় সেরকম একটি এপ্লিকেশন দাড় করানো। আমাদের ড্রোনে ইনফারেড (Infrared ) ক্যামেরা লাগানো আছে, ইনফারেড ক্যামেরার বৈশিষ্ট্য হল এটা তাপমাত্রার তারতম্য ক্যাপচার করতে পারে। যদি গ্যাস লাইনে ফাটল ধরে ইনফারেড ভিডিওতে দেখা যাবে নিদিষ্ট সেই ফাটল অংশে অস্বাভাবিক তাপমাত্রা বেড়ে গেছে, এভাবেই গ্যাস লাইনের ফাটল বের করা যায়। এই প্রজেক্টে আমাদের গ্রুপের কেউ হার্ডওয়ার, কেউ সফটওয়্যারের পার্টটা দেখছে। এখানে আমার দায়িত্ব হল ড্রোনের ভিডিও কোয়ালিটি নিয়েই শুধু কাজ করা। ড্রোনের হার্ডওয়ারের পাওয়ার খুব কম, খুব বেশী কম্পিউটেশনাল পাওয়ার নেই। তাই ড্রোন যেই ভিডিওগুলো গ্রাউন্ডে পাঠায় সেগুলো সবসময় একটি নিদিষ্ট কোয়ালিটি মেইনটেইন করে পাঠানো সম্ভব নয়, ভিডিও যত কমপ্রেস করে পাঠানো যাবে গ্রাউন্ডে তত এনার্জি সেইভ হবে, ড্রোন তত ফাস্ট ভিডিও ক্যাপচার করতে পারবে। তবে এখানে কমপ্রেশন বেশী হলে দেখা যাবে ভিডিও কোয়ালিটি খারাপ হতে থাকবে এবং পরবর্তী প্রসেসিং করা যাবে না। আমার কাজ হল এমন একটি এলগরিদম দাড় করানো যেটা ভিডিও দেখে ড্রোন অপারেটরকে বলবে কোয়ালিটিটা কেমন আছে যাতে অপারেটর তাৎক্ষনিক সিদ্ধান্ত নিয়ে গ্রাউন্ড থেকে ড্রোনের সেটিং পরিবর্তন করতে পারে। আমার কাজ মূলত কোয়ালিটি বাড়ানো নয় বরং এমন একটি সিস্টেম দাড় করানো যা অপারেটরকে জানাবে কোয়ালিটি কেমন আছে। সাধারণত কয়ালিটি এস্টিমেশনের ক্ষেত্রে যেভাবে করা হয় সেটা হল যদি একটি ডিসটোরডেট ভিডিও থাকে এবং তার করেস্পন্ডিং অরিজিনাল ভিডিও থাকে তাহলে এই দুইটি ভিডিও মাইনাস করে খুব সহজেই বলা যায় কোয়ালিটি কেমন। আমাদের এই এপ্লিকেশনে চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার হল আমাদের অরিজিনাল বা রেফান্স ভিডিও নাই যে যার সাথে তুলনা করে কোয়ালিটি বলব। এটার জন্য মূলত আমি মেশিন লার্নিং ব্যাবহার করে একটি সিস্টেম দাড় করিয়ে এই সমস্যার সমাধান করেছি। এখন এই সিষ্টমকে আরো কিভাবে ভাল করা যায় সেটা নিয়ে কাজ করছি।
কবির হোসেনঃ ভিডিও কোডিং বলতে কি বুঝায় সেটার আগে আমি বলতে চাই ভিডিও কোডিং কেন গুরুত্বপূর্ণ। কোন ইমেজের রেজুলেশোন যদি ৭২০X৫৭৬ হয়, তাহলে একটি ইমেজ বা ফ্রেমকে রিপ্রেজেন্ট করতে লাগবে : অনেক ধরনের কোডিং আছে যেমন এমপেগ-থ্রি, এমপেগ-ফোর, জেপেগ, H.264 এবং সর্বশেষ H.265 ইত্যাদি। এমপি-থ্রি হয় এমপেগ-থ্রি দিয়ে, জেপিজি ইমেজ হয় জেপেগ দিয়ে এবং এরকমভাবে এমপি-ফোর হয় এমপেগ-ফোর দিয়ে। এমমি-থ্রি, এমপি-ফোর বা জেপিজি ইমেজ এগুলো সবই মূলত ভিডিও/ইমেজ কোডেড বা কমপ্রেস করা ভিডিও/ইমেজ। এই কোডিং টেকনিকের এর উপর নির্ভর করে আবার কোয়ালিটি এস্টিমেশন পদ্ধতি কিভাবে করতে হবে ।
ভিডিও হল সাধারণত অনেকগুলো ইমেজের সমষ্টি, সাধারণত এক সেকেন্ডে ২৫টি ইমেজ বা ফ্রেম দেখি আমরা। একটি ইমেজকে অনেকগুলো পিক্সেল দিয়ে রিপ্রেজেন্ট করা হয়, আবার একটি পিক্সেলকে ৩টি চ্যানেল(রেড, গ্রিন, ব্লু) দিয়ে রিপ্রেজেন্ট করা যায়। এখানে আবার এক একটি চ্যানেলকে আবার ৮ বিট দিয়ে রিপ্রেজেন্ট করা হয় (আরও হাই বিটের ইমেজও আছে, সেগুলো আলোচনা করলাম না এখানে) ।
২৫X৭২০X৫৭৬X৩X৮, হিসেব করলে দাঁড়ায় প্রায় ২৪৮,৮৩২০০০ বিট পার সেকেন্ড যা কিনা ৩০ এমবি এর সমান। এক সেকেন্ডের একটি ‘raw ‘ ভিডিও প্রায় ৫০টি নোবেল বা আধা ঘন্টার এমপি-থ্রি এর সমান। অথচ আমাদের বাসার ব্যান্ড উইথ সেই তুলনায় কিছুই না। তাহলে প্রশ্ন আমরা ফেইসবুক, ইউটিউব, দৈনন্দিন যেই ভিডিও রাখি বা দেখি এগুলো কিভাবে সম্ভব হচ্ছে। আমরা যেগুলো দেখি সবই কোডেড বা কমপ্রেসড ডাটা। ভিডিও কোডিং না থাকলে সব কিছুই স্থবির হয়ে যেত। ভিডিও কোডিং বলতে সাধারণত ডাটাগুলোর ভিজুয়াল কোয়ালিটি ঠিক রেখে কমপ্রেস করাকেই বুঝায়।
কবির হোসেনঃ খুব সংক্ষেপে বলি, মেশিন লার্নিং দিয়ে মূলত ডাটার মধ্যকার যেই প্যাটার্ন আছে সিস্টেমকে দিয়ে সেটা লার্ন করানো হয় যাতে সিস্টেম একই গোত্রের নতুন কোন ডাটা আসলে বলে দিতে পারে আউটপুট কি হবে। বর্তমানে মেশিন লার্নিং প্রায় সব ধরনের ফিল্ডেই ব্যবহৃত হচ্ছে যেমন ডিটেকশন, প্যাটার্ন রিকগনিশন, মেডিকেল ফিল্ডে রোগীর টিউমার বা শরীরের স্পেসিফিক অর্গান সনাক্তকরণে এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরিতেও ব্যবহৃত হচ্ছে।
কবির হোসেনঃ আমি মূলত যেহেতু ভিডিও কোডিং, মেশিন লার্নিং এবং কোয়ালিটি নিয়ে কাজ করছি। ভবিষ্যতে এই জিনিসগুলোর নতুন নতুন ইন্টারেস্টিং প্রবলেম নিয়ে নিয়ে কাজ করতে চাই।
কবির হোসেনঃ গবেষণার পাশাপাশি আমি বই পড়া, ট্রাভেলিং করা অনেক পছন্দ করি আর আমার ছোট ছেলে আছে তার সাথে সময় কাটাতে ভাল লাগে অবসরে।
কবির হোসেনঃ আসলে আমি উপদেশ দিতে চাই না, আমি যেটা বিশ্বাস করি সেটা হল নিজের কাজকে ভালবাসলে এবং সেখানে ভালোলাগা তৈরি করতে পারলে যে কোন লক্ষ্যেই পৌছানো যায়।