ড. তপন কুমার সাহাঃ আমার ছেলেবেলা কেটেছে ঢাকা থেকে ৪০ কি.মি. দূরে ধামরাই উপজেলার একটি গ্রামে। সেখানে আমার জন্ম, সেখান থেকে আমি এসএসসি (সেকেন্ডারি স্কুল সার্টিফিকেট বা মেট্রিক) শেষ করেছি। তারপর আমি নারায়ণগঞ্জে চলে আসি। এখান থেকে আমি এইচএসসি ( হাইয়ার সেকন্ডারি স্কুল সার্টিফিকেট বা HSC) শেষ করি। এরপর আমি ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি বুয়েট থেকে B.SC Engineering পাশ করি। আমাদের গ্রামে বিজ্ঞান শেখার সুযোগ খুবই কম ছিল যেটা আমার ছেলেবেলায় সবথেকে চ্যালেঞ্জিং ছিল। তারপরেও নিজের মনের জোর এবং পরিবারের সদিচ্ছা কারণে আমি বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহী হই। কিন্তু পরিবেশ খুবই প্রতিকূল ছিল বলা যায়। তাছাড়া খুবই উপভোগ্য বাল্যকাল ছিল আমার। তারপর নারায়ণগঞ্জে আমাদের পরিবার চলে আসার পরে সেখানে কিছুটা ভালো সুযোগ পাই এবং প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর যেভাবে করতে চেয়েছি অনেকটা সেভাবে হয়েছে।
ড. তপন কুমার সাহাঃ বুয়েটে আমার বিষয় ছিল ইলেকট্রিকাল ও ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং।
ড. তপন কুমার সাহাঃ সত্যিকার অর্থে তখনকার সময়ে তেমন কোন সুযোগ ছিল না নিজের পছন্দের কোন বিষয় নিয়ে কাজ করার। আমার প্রথম যে সুযোগটা আসে আই আই টি তে মাস্টার্স করতে আসি তখন। তখনই আমি বুঝতে পারি আমার আগ্রহ কি বিষয়ে। তখনই আমি বুঝতে পারি যে আমার আগ্রহের বিষয় হল ইলেকট্রিসিটি জেনারেশন, ট্রান্সমিশন এন্ড distribution, সহজ বাংলায় আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থা বলতে পারি। মাস্টার্সে আমি এই বিষয় নিয়েই গবেষণা করি। মাস্টার্স শেষ করার পরে পিএইচডি তে এই বিষয়গুলোরই বর্ধিত অংশ নিয়ে আরো বিস্তারিত গবেষণা করি। কিন্তু বুয়েটের শেষ-বর্ষে আমার তেমন কোন ভাবনা ছিল না, কোন বিষয়ে গবেষণা করলে ভালো হবে। বুয়েটে মোটামুটি ৪ জন মিলে একটি টিমে আমাদের একটা থিসিস প্রোজেক্ট ছিল। সুতরাং আলাদা করে আগ্রহী বিষয় নিয়ে কাজ করার খুব একটা সুযোগ ছিল না।
ড. তপন কুমার সাহাঃ দিল্লী আই আই টি তে মাস্টার্স করেছিলাম ভারতীয় সরকার এর স্কলারশিপ নিয়ে ।
ড. তপন কুমার সাহাঃ আই আইটি অনেক দিক দিয়েই গবেষণা ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে। তাদের শিক্ষকদের আন্তর্জাতিক গবেষণা স্বীকৃতি এবং তারা ইন্ডাস্ট্রির অনেক সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে কাজ করে। তিন দশক আগে আমি আন্তর্জাতিক ভাবে তাদের যে পদচারনা দেখেছি তা আসলেই অনেক উন্নত। আমি আসলেই তাদের তুলনা বা পার্থক্য করতে চাইনা।
ড. তপন কুমার সাহাঃ আই আই টির মাস্টার্স শেষ করার পরে আমি বাংলাদেশে ফিরে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৮৮ পর্যন্ত এসিস্ট্যান্ট (সহকারী) প্রফেসর ছিলাম। তারপর সেখান থেকে আমি কানাডিয়ান ন্যাচারাল সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ কাউন্সিল এর স্কলারশিপ নিয়ে পিএইচডি করতে কানাডা যাই। তখন আমার একটা সুযোগ আসে অস্ট্রেলিয়াতে ইমিগ্রেশন নেওয়ার। মূলত ঢাকা থেকে এপ্লাই করি। তখন আমি কানাডায় পিএইচডি শেষ না করেই অস্ট্রেলিয়াতে চলে আসি। তারপর আমি অস্ট্রেলিয়াতে এসে কুইন্সল্যান্ড থেকে পিএইচডি শেষ করি। পিএইচডি শেষ করার পর এখানে নর্থ কুইন্সল্যান্ডে জেমস Cook ইউনিভার্সিটিতে আড়াই বছর পড়াই। তারপর ১৯৯৬ সাল থেকে ইউনিভার্সিটি অফ কুইন্সল্যান্ড এ একাডেমিক হিসেবে যোগদান করি এবং তখন থেকেই প্রায় ২৩ বছর এর উপর অর্থাৎ এখন পর্যন্ত আমি কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটিতেই পড়াই এবং গবেষণা করছি।
ড. তপন কুমার সাহাঃ যেহেতু গবেষণা সেক্টর টা অনেক ডাইনামিক। অনেক পরিবর্তনশীল। তাই আমার দুটো ফোকাস, উন্নত বিশ্ব ইলেকট্রিসিটির যে অবকাঠামো সেটা ৭০-৮০ দশকে তৈরী হয়েছে, ফলে অনেক দামি যন্ত্রপাতির সীমিত সময়সীমা, যেমন ১টা বড় সাইজ এর ট্রান্সফর্মার এর বাজার মূল্য ২-৬ মিলিয়ন ডলার দাম পড়ে। এই ট্রান্সফর্মার টা যদি কোন পূর্বাভাস ছাড়াই নষ্ট হয়ে পড়ে তাহলে কিন্তু একটি মারাত্মক বিপর্যয় হতে পারে। এর ফলে হাজার হাজার মানুষ লোডশেডিং এর ঝামেলায় পড়তে পারে। সেজন্য আমি পুরনো যন্ত্রপাতিগুলোর কার্যক্ষমতা ও কতদিন তা কাজ করতে পারবে তা নির্ণয় করি বা তাদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ নিয়ে কাজ করি। এটা আমার গবেষণার মূল বিষয়বস্তু। তারপর গত ১০ বছর ধরে আরেকটা বিষয় নিয়ে কাজ করছি তা হল নবায়নযোগ্য শক্তি বা রিনিউয়েবল এনার্জি বিশেষ করে সোলার এবং উইন্ড এই দুটোর ব্যবহার নিয়ে। এদের গ্রিড সংযোগ করতে গেলে যে সমস্ত সমস্যা দেখা যায় যেমন বিপণনে যে সমস্যা সমস্যা দেখা যায় – সেগুলির সমাধান নিয়ে আমি এবং আমাদের টিম কাজ করে।
ড. তপন কুমার সাহাঃ সাধারণত মাটির অনেক নীচে উত্তপ্ত পাথর থাকে যার তাপমাত্রা প্রায় ২০০-৩০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড হয়। যেমন অস্ট্রেলিয়াতে প্রায় ৫- ৮ কিমি মাটির নিচে হাজার হাজার কিমি জুড়ে প্রাকৃতিকভাবে উত্তপ্ত অংশ রয়েছে। সেই তাপ দিয়ে পানিকে জলীয় বাষ্পে রূপান্তর করা হয় এবং তা দিয়ে টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদ করা হয়। তবে মূল সমস্যা হল মাটির নিচে ঠিক কোথায় আছে তা বের করতে হয় এবং সেখান থেকে কিভাবে বিদ্যুৎ তৈরী করে ট্রান্সমিশন লাইন দিয়ে মানুষে বাসায় পৌছান যায়।
ড. তপন কুমার সাহাঃ অস্ট্রেলিয়াতে এখন সোলার গ্রিড বা সৌর বিদ্যুতের গ্রিড সবচেয়ে বেশী ব্যবহৃত হচ্ছে এবং এরপরে রয়েছে উইন্ড বা বায়ু-শক্তি। অস্ট্রেলিয়াতে ভূ-তাপ বিদ্যুৎ উৎপাদনের অনেক জায়গা পাওয়া গেলেও এটি খুব খরচ বহুল এবং প্রযুক্তিগত ভাবেও কঠিন- তাই এটি তেমন জনপ্রিয় হয়নি। অস্ট্রেলিয়ার পাশাপাশি অনেক দেশেই জিও থার্মাল নিয়ে কাজ হচ্ছে। কিন্তু সৌরবিদ্যুত গ্রিড নিয়ে জার্মানি ও চীনে প্রচুর প্রয়োগ হচ্ছে। ভারতে সৌর এবং বায়ু এই দুটি শক্তি নিয়েই কাজ এগুচ্ছে।
ড. তপন কুমার সাহাঃ হ্যাঁ। অস্ট্রেলিয়াতে ও সেই মডেলটি রয়েছে। দিনের বেলায় বাড়ির ছাদে বিদ্যুৎ তৈরী করে জাতীয় গ্রিডে বিক্রি করা যায় আবার রাতে জাতীয় গ্রিড থেকে কিনে ব্যবহার করা যায়।
ড. তপন কুমার সাহাঃ চীনে আমি সরাসরি শিক্ষকতার সাথে যুক্ত নই। তবে চীনের দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে আমি যুক্ত আছি এবং প্রায়শই সেখানে যাই। চীন থেকে গবেষক ছাত্র ও পোস্ট ডোক্টরাল ফেলো আসে আমাদের সাথে অস্ট্রেলিয়াতে কাজ করতে। আমাদের একটি রিসার্চ এসোসিয়েশন রয়েছে। চীনে গবেষণায় ভালো বাজেট বরাদ্দ করে এবং খুবই মানসম্মত গবেষণা সেখানে হচ্ছে। ওদের গবেষকরাও অনেক পরিশ্রমী।
ড. তপন কুমার সাহাঃ এখন চীনের গবেষণার মান অনেক ভালো এবং চীনের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উপরে অবস্থান করছে।
ড. তপন কুমার সাহাঃ ৩ টা ক্ষেত্রে আমরা কাজ করি। এগুলো হচ্ছে বিদ্যুতকে সহজলভ্য করা, কিভাবে খরচ কমানো যায়, এছাড়া নিরাপত্তাও উন্নত করতে হবে। ট্রান্সফর্মার খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ আমাদের বিদ্যুৎ বিপণনের ক্ষেত্রে। এছাড়া জেনারেশন, ট্রান্সমিশন আর ডিস্ট্রিবিউশনের জন্য ভালো ডায়াগনোসিস পদ্ধতি প্রয়োজন। ট্রান্সফর্মার যা নেটওয়ার্কে সংযুক্ত থাকবে এবং আমরা এগুলোর সরাসরি অবস্থা জানতে পারবো। লাইভ প্রেডিকশন এবং কন্ডিশন মনিটর এর উপর কাজ করি। এছাড়া আমরা ইন্ডাস্ট্রি ইঞ্জিনিয়ারদের ট্রেনিং এর জন্য কন্টিনিউইং প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট এর উপর কিছু কোর্স প্রদান করি। ইতিমধ্যে আমরা চারটি কোর্স দিয়েছি যেখানে অংশগ্রহণকারীরা সবাই ইন্ডাস্ট্রি ইঞ্জিনিয়ার ও প্রযুক্তির লোকজন। এবং সেখান এর লেকচার গুলো ও আমরা জয়েন্টলি শেয়ার করি। আমরা যৌথ ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক, শিক্ষক ও শিল্পে কাজ করা লোকজন একসাথে ইন্ডাস্ট্রির সমস্যা সমাধানে কাজ করি। আমরা যে সমস্যা গুলো নিয়ে কাজ করি সেগুলো মূলত ইন্ডাস্ট্রি থেকে আসা সমস্যা। আমাদের ২২ টি অস্ট্রেলিয়ার এবং আন্তর্গাতিক সংগঠন আছে। খুব বড় পরিসরের পাওয়ার জেনারেশন, ট্রান্সমিশন, ডিস্ট্রিবিউশন, ট্রান্সফর্মার ম্যানুফ্যাকচারার, কনসালটেন্ট, সার্ভিস প্রভাইডারস রা ও আমাদের সেন্টার এর সদস্য। সদস্যদের বার্ষিক চাঁদাতে চলে কেন্দ্রটি। সদস্যদের কাছ থেকে আমরা বর্তমান তাদের সমস্যা গুলো জেনে নিই। এগুলোর উপর ভিত্তি করেই আমরা ট্রান্সফর্মার এসেসমেন্ট সহ অন্যান্য কাজ গুলো করি। মেশিন লার্নিং এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর টেকনিক এপ্লাই করে আমরা ট্রান্সফর্মার এর লাইভ এসেসমেন্ট করি। যাতে মিনিমাম মেজারমেন্ট এর মাধ্যমে full ট্রান্সফর্মার এর তথ্য কাজে লাগিয়ে নতুন ট্রান্সফর্মার এর কন্ডিশন টাকে এসেস করার চেষ্টা করি।
ড. তপন কুমার সাহাঃ বিভিন্ন ট্রান্সফর্মার থেকে আমরা অনেক ধরনের তথ্য বা ডাটা পাই। সেই ডাটা বিশ্লেষণ করে ট্রান্সফর্মার এর অবস্থা বা তার কোন সমস্যাকে গণনা করা হয়। এই ক্ষেত্রে আমরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে ডাটাকে বিশ্লেষণ করি।
ড. তপন কুমার সাহাঃ বাংলাদেশ থেকে অনেক ছাত্র আমার সাথে কাজ করেছে। আমি উপদেশ দিব অনার্স বা আন্ডার-গ্রাজুয়েট এর পরে মাস্টার্স সম্পন্ন করতে। এরপরে ভালো IELTS এ নম্বর তুলে রিসার্চ এর দিকে মনোযোগ দিতে হবে। মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের ছাত্রছাত্রীদেরকে কিন্তু প্রতিযোগিতা করতে হবে চীন ও ভারতের মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে। বৃত্তি নিয়ে পড়ার জন্য অনেক প্রস্তুতি সম্পন্ন করে তারপরে তারা আমাদের মত কোন একাডেমিকস এর সাথে কাজ করতে পারে।