বিশ্বখ্যাত সায়েন্স ফিকশন সিরিজ ‘স্টার ট্রেক’-এ Replicator নামক এমন এক যন্ত্রের উল্লেখ আছে যা কিনা যেকোন ধরণের পার্থিব বস্তু তৈরীতে সক্ষম – তা এক কাপ ধূমায়িত চা-ই হোক বা যেকোন অস্ত্রই হোক। যদিও আপাতদৃষ্টিতে এধরণের যন্ত্র বানানো সম্ভব নয় বলেই আমাদের ধারণা, তবু কিছু মানুষ আজ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে – এমন যন্ত্র বানানো অসম্ভব নয়। ‘ন্যানোটেকনোলজী’ নামক এক প্রযুক্তির বদৌলতে মানুষ আজ কল্পকাহিনীকে বাস্তবে পরিণত করার স্বপ্ন দেখছে। বিগত কিছু বছর ধরে এই প্রযুক্তির উপর গবেষণা এবং আবিষ্কার আলোড়ন সৃষ্টি করে চলেছে বিভিন্ন স্তরের গবেষকদের মধ্যে। এই আলোড়ন আজ সাধারণ মানুষকেও আলোড়িত করছে।ন্যানোটেকনোলজী কি?-এ সম্পর্কে জানতে হলে আগে ‘ন্যানো’ কথাটির অর্থ জানতে হবে। ‘ন্যানো’ হল পরিমাপের অতি ক্ষুদ্র একটি একক। ১ মিটারের ১০০,০০,০০,০০০ (একশ’ কোটি)-এর ১ ভাগকে বলা হয় ১ ন্যানোমিটার, যা কিনা দৃশ্যমান আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের চাইতেও ক্ষুদ্র। উল্লেখ্য যে, মানুষের চুলের ব্যাস হল ৫০,০০০ ন্যানোমিটার। এ’থেকে মোটামুটিভাবে ধারণা করা যাচ্ছে যে-কত ক্ষুদ্র এই ন্যানোমিটার! সাধারণভাবে বলা যায়, ন্যানোমিটারে পরিমাপ করতে হয় এমন ক্ষুদ্র বস্তু নিয়ে যে প্রযুক্তি তা-ই হল ন্যানোটেকনোলজী, যদিও ন্যানোটেকনোলজীকে এত সহজে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। কত ন্যানোমিটার বিশিষ্ট বস্তু এই প্রযুক্তির অন্তর্গত – তা নিয়ে বিজ্ঞানীমহলে মতভেদ থাকলেও সাধারণত ১ থেকে ১০০ ন্যানোমিটার পর্যন্ত পরিমাপকে এই প্রযুক্তির মধ্যে বিবেচনা করা হয়। ১৯৮৬ সালে Dr. K. Eric Drexler সর্বপ্রথম ‘ন্যানোটেকনোলজী’ শব্দটি ব্যবহার করেন।এখন প্রশ্ন হল-‘ন্যানোটেকনোলজী’ বিজ্ঞানের কোন বিভাগের অন্তর্গত। মজার বিষয় হল যে একে কোন নির্দিষ্ট বিভাগের অন্তর্গত করা যায় না। জীববিদ, পদার্থবিদ, রসায়ণবিদ, প্রযুক্তিবিদ- সকলেই এই প্রযুক্তির সাথে সম্পর্কিত। কারো একক আধিপত্য নেই এই জগতে। কিন্তু বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন করা একজনের পক্ষে বেশ দুরূহ ব্যাপার। তবে নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী বিজ্ঞানী Dr. Horst Störmer আশাবাদ ব্যাক্ত করে বলেন যে, ন্যানোটেকনোলজীর সাথে জড়িত বিষয়গুলোর মধ্যে এমন একটি সাধারণ ভাষার উদ্ভব হবে যা জানা থাকলেই বিজ্ঞানের যে কোন বিষয়ে অভিজ্ঞ গবেষকই সকল বিষয়ে গভীর জ্ঞান অর্জন না করেই এই প্রযুক্তির উপর গবেষণা চালিয়ে যেতে পারবেন।এই প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে সমস্যা হল যে, বলবিদ্যার সংক্রান্ত স্বাভাবিক সূত্রাবলী এ’প্রযুক্তিতে খাটেঁ না। সহজ একটি উদাহরণ দেয়া যাক – এক গ্লাস পানির মধ্যে একটি স্ট্র বা কাঁচের নল ডোবান হল। তাহলে দেখা যাবে যে, নলের মধ্যে পানির উচ্চতা আর নলের বাইরের পানির উচ্চতা প্রায় সমান- যা কিনা স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু এখন যদি পূর্বাপেক্ষা আরো সরু নল ডোবান হলে দেখা যাবে যে, নলের মধ্যের পানির উচ্চতা বাইরের পানির উচ্চতার চেয়ে বেড়েছে। নল যত সরু হবে পানির উচ্চতা তত বাড়বে। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে যে, নলের ব্যাস যতই ক্ষুদ্র হচ্ছে, স্বাভাবিকতা ততটাই বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। ন্যানোস্কেলে পরিমাপযোগ্য বস্তুর ক্ষেত্রে বলবিদ্যার সূত্রসমূহের ব্যার্থতা আরো প্রকট ভাবে ধরা পরে। প্রাচীন বলবিদ্যা (Classical Mechanics)-এর দ্বারা ন্যানো বস্তু সমূহের বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করা যায় না বলে নতুন বলবিদ্যার প্রয়োজন। সৌভাগ্যের বিষয় যে, ন্যানোটেকনোলজীর উপর গবেষণা শুরুর কয়েক দশক আগেই এক নতুন বলবিদ্যার সূত্রপাত হয় যা দ্বারা ন্যানোস্কেলের বস্তু সমূহের বৈশিষ্টাবলী ব্যাখ্যা করা যায়। এই মহান বলবিদ্যার নাম হল কোয়ান্টাম বলবিদ্যা।আমরা একটি দেয়াল টপকানো ছাড়া দেয়ালের অপরপার্শ্বে যেতে পারবোনা। কিন্তু ন্যানোস্কেলের জগতে দেখা যায় যে, একটি ইলেক্ট্রন খুব সহজেই পর্যাপ্ত পরিমাণ শক্তি অর্জন ছাড়াই বাধা অতিক্রম করে অপর পার্শ্বে যেতে সক্ষম। এই অসম্ভব ঘটনার ব্যাখ্যা শুধুমাত্র কোয়ান্টাম বলবিদ্যার দ্বারাই সক্ষম। কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় এই ঘটনাকে টানেলিং (Tunneling) বলে। ন্যানোস্কেলের জগতে এমন অজস্র ঘটনা পরিলক্ষিত হয়। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে যে, ন্যানোটেকনোলজী সম্পর্কে জানতে হলে পুরাতন জ্ঞানকে সম্পূর্ণরূপে ভুলে গিয়ে নতুনভাবে আবার শুরু করতে হবে।সাম্প্রতিককালে বিজ্ঞানীগণ ন্যানোটেকনোলজীর দুটি মহা মহা আবিষ্কারের দিকে আকর্ষণ বোধ করছেন এবং অবিরত গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। এ’ দুই আবিষ্কার হল- ন্যানোওয়্যার (Nonowire) এবং কার্বন ন্যানোটিউব। ন্যানোওয়্যার হল অতি ক্ষুদ্র ব্যাসবিশিষ্ট সরু তার (ক্ষেত্রবিশেষে এই ব্যাসের পরিমাণ ১ ন্যানোমিটার-ও হয়)। বিজ্ঞানীরা আশা করছেন যে, কম্পিউটারসহ অন্যান্য ইলেক্ট্রনিক্স যন্ত্রে ব্যবহারযোগ্য অতি ক্ষুদ্র ট্রানজিস্টর তৈরি করা সম্ভব এই ওয়্যার দিয়ে। বিগত কয়েক বছরে কার্বন ন্যানোটিউব-এর আবিষ্কার ন্যানোওয়্যার-এর অবস্থানকে ম্লান করে একক আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে নিজ বৈশিষ্ট্যের গুণে। যদিও আমরা কার্বন ন্যানোটিউব সম্পর্কে অতি ক্ষুদ্রই জেনেছি, তবে যা জেনেছি তা আমাদের চমৎকৃত করার জন্য যথেষ্ট।কি এই কার্বন ন্যানোটিউব? কার্বন ন্যানোটিউব হল, সিলিন্ডার আকৃতিতে প্যাঁচানো গ্রাফিন (Graphene)। গ্রাফিন হল একটি কার্বন পরমাণুর সমান পুরুত্ব বিশিষ্ট একপ্রকার পাত (sheet), যার মধ্যে কার্বন পরমাণুগুলো একে অপরের সাথে যুক্ত হয়ে ষড়ভূজাকৃতির গঠন সৃষ্টি করে। গ্রাফিন পাতের প্যাঁচানোর পদ্ধতির উপর এই টিউবের বৈশিষ্টাবলী পরিবর্তিত হয়। ১৯৯১ সালে Dr. Sumio Iijima কার্বন ন্যানোটিউব আবিষ্কার করেন। দুইধরণের কার্বন ন্যানোটিউব পাওয়া যায় – SWNT : Single-walled Nanotubes (একস্তর গ্রাফিন শীট বিশিষ্ট ন্যানোটিউব) এবং MWNT : Multi-walled Nanotubes (একাধিক স্তর গ্রাফিন শীট বিশিষ্ট ন্যানোটিউব)। ন্যানোটিউবের ব্যাস ১ ন্যানোমিটার (SWNT-এর জন্য) হতে ৫০ ন্যানোমিটার (MWNT-এর জন্য) পর্যন্ত হতে পারে এবং দৈর্ঘ্য ১ মিলিমিটার-এর উপর পর্যন্ত হয়। MWNT-এর মধ্যে একস্তর হতে অপরস্তরের মধ্যে ০.৩৪ হতে ০.৩৬ ন্যানোমিটার ফাঁক থাকে।কার্বন ন্যানোটিউব-এর কিছু অনন্যসাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা বিজ্ঞানীগণের মধ্যে অসীম আগ্রহের সৃষ্টি করেছে। পরীক্ষা করে পাওয়া গেছে যে, স্টীলের তুলনায় SWNT ৫০ থেকে ১০০ গুণ মজবুত এবং প্রায় ৬ গুণ হালকা! ইহার স্থিতিস্থাপকতা ১১.২ টেরাপ্যাসকেল (TPa)। এই চমৎকার গাঠনিক বৈশিষ্ট্য ছাড়াও আরও কিছু বৈশিষ্ট্য পরীক্ষা করে পাওয়া গিয়েছে। দেখা গেছে যে, SWNT-এর তাপ পরিবাহকত্ব হীরকের তাপ পরিবাহকত্বের চাইতে দুইগুণ বেশি (উচ্চ তাপ পরিবাহকত্ব বিশিষ্ট পদার্থ হিসেবে হীরকের সুখ্যাতি আছে)। SWNT-এর আরো একটি আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হল – ইহার বিদ্যুৎ পরিবাহিতা, যার মান প্রতি বর্গ সেন্টিমিটারে ১০৯ এম্পিয়ার-যা কিনা কপার (তামা)-এর চাইতেও ১০০ গুণ বেশি!!! শুধু তাই নয়, পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, শূন্যস্থানে ২৭০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা পর্যন্ত SWNT স্থিতিশীল অবস্থায় থাকে অর্থাৎ এর গঠনের কোনরূপ পরিবর্তন হয় না।এখন প্রশ্ন হল যে – কি কি কাজে লাগানো যাবে এই কার্বন ন্যানোটিউবকে? সেমিকন্ডাক্টর টেকনোলজীতে, সূক্ষ যন্ত্রপাতি তৈরিতে, চিকিৎসা বিজ্ঞানে, এমনকি টেক্সটাইল শিল্পেও কার্বন ন্যানোটিউবের অজস্র ব্যবহার রয়েছে। ইলেক্ট্রনিক্সের জগতে এই টিউবের অপ্ররিমেয় ব্যবহারযোগ্যতা নিয়ে বিজ্ঞানীরা ব্যাপক আশাবাদী। ননভোলাটাইল মেমোরী (Nonvolatile Memory) চিপ তৈরিতে এই টিউবের ব্যবহার বিশেষ লক্ষ্যণীয়। যদি কার্বন ন্যানোটিউবে পরমাণুসমূহকে সঠিকভাবে সাজানো যায় তবে একে একটি উপযুক্ত সেমিকন্ডাক্টর (অর্ধপরিবাহী) পদার্থে পরিণত করা সম্ভব। তখন এই টিউব দিয়ে অতীব ক্ষুদ্র ট্রানজিস্টর তৈরী হবে, যার ফলে কম্পিউটার থেকে শুরু করে অন্যান্য ইলেক্ট্রনিক্স যন্ত্রপাতির আকৃতিও কল্পনাতীতভাবে ক্ষুদ্র হয়ে আসবে। বর্তমানে CNT (Carbon Nanotube) নির্ভর পানি ও বায়ুশোধন পদ্ধতি ব্যবহৃত হচ্ছে যা কিনা ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করতে সক্ষম। শক্তি সঞ্চয়ক কোষ বা ব্যাটারিতেও এই টিউবের ব্যবহার পরিলক্ষিত হচ্ছে। এই টিউব দিয়ে তড়িৎ পরিবাহী প্লাস্টিক তৈরী সম্ভব যার স্থিতিস্থাপকতা হবে অপরিসীম। তড়িৎ পরিবাহীতার মান অতি উচ্চ হওয়াতে এবং প্রান্তীয় অঞ্চল অতীব সূক্ষ্ম বলে ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক ফিল্ড এমিশন (Electro-magnetic Field Emission) সংক্রান্ত যন্ত্র প্রস্তুতিতে কার্বন ন্যানোটিউব ব্যবহৃত হচ্ছে। এ’সব ব্যবহার ছাড়াও বিভিন্ন প্রকার সেনসর, রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি, বোলোমিটার, ন্যানোমিক্সার, চিকিৎসা বিজ্ঞানে ব্যবহারযোগ্য মেমব্রেন, ভালব্ প্রভৃতি প্রস্তুতিতে CNT ব্যবহৃত হয়। দেখা যাচ্ছে যে, ন্যানোটেকনোলজীর ইতিহাস মাত্র কয়েক দশকের হলেও ইহার অগ্রগতি এবং মহা মহা আবিষ্কার বিজ্ঞানের জগতে এক নতুন অধ্যায়ের সূত্রপাত ঘটিয়েছে। এ’প্রযুক্তি পরিণত হয়েছে বিজ্ঞানের এক গুরুত্বপূর্ণ শাখায়। অগণিত বিজ্ঞানীদের অসীম আগ্রহ ও পরীক্ষানীরিক্ষা এই প্রযুক্তিকে দিন দিন বহুগুণ এগিয়ে নিয়ে চলেছে। আর এই প্রযুক্তি মানুষের কল্পনাকে বাস্তবে পরিণত করার পথ দেখিয়ে চলেছে। সেইদিন হয়ত আর দূরে নয় যেদিন Replicator-এর মত যন্ত্র ঘরে ঘরে থাকবে। মানুষ আর কল্পকাহিনী পড়ে স্বপ্নে বিভোর হবে না।
মাহফুজ
Ami akti university_te pori.
Nanotechnology somporke janar issa onekdin thekai silo. Aj ata pora jetuku jante parlam, tate ami surprised. Ami khusi_te prae kadai falasilam.
Thaknk u mahfuz vai.