চিতা ও বাঘের শিকার ধরার পদ্ধতির বৈপরীত্যের কারণ হলো উভয়ের দৈহিক ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রভেদ আর সেই বৈপরীত্যে নিহিত আছে মানবসভ্যতায় প্রচলিত দুইটি বিপরীতধর্মী রণনীতি !
চিতা সর্বদা গর্জন করে তার শিকারকে প্রতিযোগীতায় আহ্বান করে। এরপর শিকার প্রাণপণে পালাতে শুরু করলে চিতাও শিকারটিকে উদ্দেশ্য করে দৌড় দেয় এবং প্রায় ৩০ সেকেন্ডের মধ্যেই চিতা শিকারটিকে দৌড় প্রতিযোগীতায় পরাজিত করে। চিতার পেশীবহুল দেহ চিতাকে শক্তি প্রদান করে, এবং চিতার স্থিতিস্থাপক মেরুদন্ড ও সেই মেরুদন্ডের সাথে যথেষ্ট আলগাভাবে যুক্ত থাকা সরু ও লম্বা লম্বা চারটি পা তাকে সেই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে প্রতি বর্গসেকেন্ডে ২৯ ফুট ত্বরণ নিয়ে দৌড় শুরু করার সামর্থ্য দেয়। এরই সাথে চিতার বিশেষ দৈহিক আকৃতি তার দৌড়ানোর সময়ে বায়ুর বাধা কমিয়ে তাকে ঘন্টায় ৫০-৮০ মাইল বেগে দৌড়তে সাহায্য করে। পালানোর সময়ে শিকার যখন বারবার গতির অভিমুখ পরিবর্তন করে, চিতার আড়াই ফুট লম্বা লেজ চিতার দৌড়ের বেগ ও দেহের ভারসাম্য বজায় রেখে শিকারটিকে অনুসরণ করে চিতাকে দ্রুত দিক পরিবর্তন করতে সাহায্য করে। চিতার দৌড়ানোর সময়ে তার চারটি পায়ের পারস্পরিক চলন যদি আমরা খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করি, আমরা বুঝতে পারব চিতার সবচেয়ে দ্রুতগামী স্থলজ স্তন্যপায়ী প্রাণী হয়ে ওঠার কারণ – চিতার চারটি পা পর্যায়ক্রমে একত্রিত হয় ও তারপর ছড়িয়ে যায়। দৌড়ানোর সময়ে চিতার সমগ্র শরীর যতই অস্থির হোক, তার মাথা খুব একটা নড়ে না। শিকারের দৌড়ানোর অভিমুখে নিজের মাথাকে স্থির রাখে বলেই চিতা দৌড়ে খুব শীঘ্রই তার শিকারের কাছে পৌঁছে যায়। সে তার থাবায় নখরগুলিকে আংশিকভাবে ঢুকিয়ে রাখে যার ফলে ভূমির সাথে থাবার ঘর্ষণ গুণাঙ্ক বেড়ে যায়। তাই অত দ্রুত দৌড়ানোর সময়েও কখনও চিতার পা পিছলে যায় না ! চিতার এই বৈশিষ্ট্যকে অনুসরণ করেই দৌড় প্রতিযোগীতায় দৌড়বীরেরা স্পাইক জুতো ব্যবহার করেন।
প্রাপ্তবয়স্ক চিতার ওজন ২১-৭২ কেজি কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক বাঘের ওজন ৬৫-৩১০ কেজি, অর্থাৎ বাঘের গড় ওজন চিতা অপেক্ষা অনেকটাই বেশী। দেহের ওজন অপেক্ষাকৃত বেশী হওয়ায় এবং চিতার মত দৌড়োপযোগী দৈহিক গঠন না থাকায় বাঘ বেশী না দৌড়িয়েই শিকারকে পাকড়াও করতে চেষ্টা করে। চিতা শিকারকে হত্যা করার আগে তার আত্মবিশ্বাসকে হত্যা করে, কিন্তু বাঘ এমন পদ্ধতিতে শিকারকে পাকড়াও ও হত্যা করে যে শিকারের আত্মবিশ্বাস কার্যকরী হওয়ার সুযোগই পায় না ! বাঘের চোখের রেটিনা অংশে আলোক সংবেদী রড্ কোষ অনেক বেশী সংখ্যায় থাকে বলে বাঘ রাতে খুব ভালোই দেখতে পায়। তাই রাতে তেমন ভালো দেখতে পায় না এমন শিকারকে বাঘ রাতে আক্রমণ করে থাকে। এছাড়াও বাঘেদের হলুদ গায়ে কালো ডোরা কাটা দাগ তাদেরকে অরণ্যে ঝোপে-ঝাড়ের আড়ালে গা ঢাকা দিতে সাহায্য করে। গা ঢাকা দিয়ে বাঘ শিকারের উপর নজর রাখে ও সঠিক সুযোগের অপেক্ষা করে, এবং সঠিক সুযোগ পেলেই ঝোপের মধ্য থেকে শিকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এছাড়াও বাঘ তার নখরগুলিকে থাবায় সম্পূর্ণরূপে ঢুকিয়ে রেখে নিঃশব্দে শিকারকে অনুসরণ করতে পারে ও পিছন থেকে শিকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
চিতার শিকার ধরার পদ্ধতি মানবসভ্যতায় প্রচলিত সাবেকি রণনীতির অনুরূপ যেখানে ক্ষমতা-প্রদর্শনকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়, কিন্তু বাঘের শিকার ধরার পদ্ধতি থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে মানবসভ্যতায় “অ্যাম্বুশ”(অতর্কিতে আক্রমণ) নামক অনন্য রণনীতির জন্ম হয়েছে যেক্ষেত্রে ক্ষমতার আস্ফালনকে নয় বরং যুদ্ধে জয় লাভ করাকেই কেবল গুরুত্ব দেওয়া হয়।
Leave a comment