নিউজ ডেস্ক, বিজ্ঞানী অর্গ
✉ biggani.org.
আমরা প্রতিদিন গাছ দেখি—রাস্তার পাশে, গ্রামের মাঠে, শহরের পার্কে কিংবা নিজের বাড়ির উঠোনে। কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছি, এরা কী একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করে? কিংবা গাছের জগতে কী কোনো ‘ভাষা’ আছে?
প্রথমে শুনলে অবিশ্বাস্য লাগতে পারে, কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান বলছে, গাছেরা আসলে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করে—শুধু আমাদের মতো শব্দে বা চোখে দেখা যায় এমন ভাষায় নয়, বরং তাদের নিজস্ব এক ধরনের রাসায়নিক ও শারীরবৃত্তীয় ভাষায়। এই যোগাযোগের পদ্ধতিকে বিজ্ঞানীরা বলেন “উড ওয়াইড ওয়েব”—মানে গাছের জগতে একধরনের ইন্টারনেট!
বনের নিচে লুকিয়ে থাকা সংযোগের জাল
মাটির নিচে বিস্ময়কর এক পৃথিবী কাজ করছে যেটি আমরা দেখতে পাই না। এখানে গাছের মূল এবং ফাঙ্গাস (ছত্রাক) মিলে গড়ে তোলে এক বিস্ময়কর পারস্পরিক সম্পর্ক। এই মিথোজীবিতার নাম “মাইকরোরাইজা“।
ফাঙ্গাস গাছের মূলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তাদের কাছ থেকে চিনি ও অন্যান্য জৈব পদার্থ গ্রহণ করে, আর বদলে গাছকে দেয় খনিজ লবণ ও পানি। কিন্তু এখানেই শেষ নয়—ফাঙ্গাসের সুতো-সদৃশ গঠন, যাকে বলে হাইফা, তা মাটির অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে এবং একাধিক গাছের সঙ্গে সংযুক্ত হয়।
এই জালটি একটি গাছ থেকে আরেক গাছে তথ্য, রাসায়নিক সংকেত, এমনকি পুষ্টিও স্থানান্তর করতে পারে। এই নেটওয়ার্ককে কেউ কেউ বলেন “Wood Wide Web“—যেটি ইন্টারনেটের মতোই গাছেদের মধ্যে সংযোগ সৃষ্টি করে।
সংকেত আদান-প্রদান: শত্রুর আগমন
গাছেদের এই যোগাযোগ শুধু বন্ধুত্ব নয়, বিপদের সংকেত পাঠানোতেও ব্যবহার হয়।
ধরা যাক, কোনো এক গাছের পাতা একটি পোকার আক্রমণে আক্রান্ত হয়েছে। সেই গাছ তখন মাটির নিচে রাসায়নিক সংকেত পাঠাতে পারে আশপাশের গাছগুলোকে। এই সংকেত পেয়ে আশপাশের গাছগুলি তাদের পাতায় বিশেষ ধরনের প্রতিরক্ষামূলক রাসায়নিক উৎপাদন শুরু করে—যা পোকা তাড়াতে সাহায্য করে।
এমনকি কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, আক্রমণপ্রাপ্ত গাছ বাতাসেও রাসায়নিক বার্তা ছড়িয়ে দেয়—যার নাম ভোলাটাইল অর্গানিক কম্পাউন্ডস (VOCs)। এই গন্ধযুক্ত যৌগগুলো আশপাশের গাছকে সতর্ক করে দেয়: “সতর্ক হও, শত্রু আসছে!”
মা গাছের গল্প
বিখ্যাত কানাডিয়ান বনবিজ্ঞানী সুজান সিমার্ড তার গবেষণায় দেখিয়েছেন, বড় ও পুরাতন গাছগুলো—যাদের তিনি বলেন “মা গাছ“—তারা তরুণ গাছদের পুষ্টি সরবরাহ করে, এমনকি বিপদে থাকা গাছকে সাহায্য করে।
গবেষণায় দেখা গেছে, মা গাছ তার নিজের বংশধরদের বেশি সাহায্য করে—একেবারে মায়ের মতো। কোনো গাছ মারা যাওয়ার আগে আশপাশের গাছগুলোকে নাইট্রোজেন, কার্বন ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান পাঠিয়ে যায় যেন তারা টিকে থাকতে পারে।
বিজ্ঞানীরা কীভাবে জানলেন?
এই যোগাযোগ প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে বিজ্ঞানীরা রেডিওএকটিভ ট্রেসার, আইসোটোপ বিশ্লেষণ এবং জটিল মাটির মাইক্রোবায়োম গবেষণা ব্যবহার করেন।
উদাহরণস্বরূপ, একটি গাছে বিশেষ ধরনের কার্বন-১৩ আইসোটোপ ব্যবহার করে দেখা যায় যে তা পরে অন্য গাছের শরীরে ধরা পড়ছে—মানে মাটির নিচে সেই উপাদান আদান-প্রদান হয়েছে।
শহরের গাছেরা কী যোগাযোগ করে?
এই প্রশ্নের উত্তর কিছুটা জটিল। শহরের গাছেরা সাধারণত এককভাবে বা দূরত্বে থাকে, তাদের মধ্যে প্রাকৃতিক সংযোগ (যেমন মাইকরোরাইজাল নেটওয়ার্ক) গড়ে ওঠে না বললেই চলে। তবে কোনো পার্ক বা সবুজ জায়গা যেখানে মাটির জৈবিক কার্যকলাপ ভালো, সেখানে এমন সংযোগ তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
বাস্তবিক প্রভাব: কৃষি ও বন ব্যবস্থাপনা
এই আবিষ্কার শুধু গবেষণার জন্য নয়, বাস্তবিক জীবনে এর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে:
- টেকসই বন ব্যবস্থাপনা: এখন আমরা জানি, একটি বড় গাছ কেটে ফেললে শুধু একটা গাছই নয়, পুরো নেটওয়ার্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই বন ব্যবস্থাপনায় এ বিষয়টি বিবেচনা করা জরুরি।
- জৈব কৃষি: কৃষিক্ষেত্রে ফাঙ্গাস-গাছ সম্পর্ক ব্যবহার করে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার কমানো সম্ভব। এটি পরিবেশবান্ধব কৃষির পথে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে।
- দুর্যোগের প্রতিক্রিয়া: যদি মাটির নিচের এই সংযোগ জাল বজায় থাকে, তবে একটি গাছ আক্রান্ত হলে অন্য গাছ আগেই প্রস্তুতি নিতে পারে—ফসল রক্ষায় এ ব্যবস্থাকে কাজে লাগানো যেতে পারে।
কিন্তু গাছ কি সত্যিই কথা বলে?
এই প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয়, না, গাছেরা আমাদের মতো শব্দ ব্যবহার করে না, কিন্তু তারা রাসায়নিক ভাষা, হরমোন, ইলেকট্রিক সিগন্যাল এবং মাইকরোবায়াল মাধ্যম ব্যবহার করে বার্তা আদান-প্রদান করে।
এটি এক ধরনের “জৈব যোগাযোগ ব্যবস্থা”—যা তাদের বেঁচে থাকা, শত্রুর মোকাবিলা এবং সামাজিক সম্পর্কের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশে কী গবেষণা হচ্ছে এই নিয়ে?
বাংলাদেশে এই নিয়ে গবেষণা খুবই সীমিত হলেও, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সাভার কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগে কিছু শিক্ষার্থী এবং গবেষক মাটির জৈবিক কার্যকলাপ ও উদ্ভিদের প্রতিক্রিয়া নিয়ে কাজ করছেন।
ভবিষ্যতে আমাদের পরিবেশ ও কৃষিকে আরও টেকসই করতে হলে এ ধরনের গবেষণায় বিনিয়োগ ও আগ্রহ বাড়ানো দরকার।
উপসংহার
গাছের জগৎ নিঃসন্দেহে রহস্যময়। তারা কথা না বললেও, একে অপরকে বোঝে, বিপদে সাহায্য করে, এমনকি পুষ্টি শেয়ার করে।
এই কথোপকথন আমাদের চোখে পড়ে না, কিন্তু মাটির নিচে, বাতাসে, পাতায় পাতায় এই “নীরব ভাষা” প্রবাহমান।
এখন সময় এসেছে গাছকে শুধু ছায়া, কাঠ কিংবা অক্সিজেনের উৎস নয়, বরং জটিল সামাজিক জীব হিসেবে দেখার। আর তাদের রক্ষা করাও আমাদের সামাজিক দায়িত্বের অংশ হওয়া উচিত।
আপনি কি জানেন?
- একটি ওক গাছ এক বছরে গড়ে ২০টির বেশি প্রতিবেশী গাছের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে।
- “Wood Wide Web” শব্দটি প্রথম চালু করেন বিজ্ঞানী ড. সুজান সিমার্ড।
- গাছের পাতা থেকেও তারা একে অপরকে সংকেত পাঠাতে পারে, বিশেষ করে যখন পোকা বা শত্রুর আক্রমণ হয়।
✍ আপনি যদি পরিবেশ বা উদ্ভিদবিজ্ঞান নিয়ে লেখালেখি করতে আগ্রহী হন, যোগাযোগ করুন:
📧 [email protected]
🌐 biggani.org
Leave a comment