২০২৪ সনের একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায় বাংলাদেশের জনগণের প্রায় ৪৫% জনগণ মোবাইল ফোন কিংবা কম্পিউটারের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করে। এই বিশাল ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা মূলত পত্রিকার ওয়েবসাইট, ফেসবুক সহ অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া এর ব্যবহারকারী। এছাড়া কিছু ব্যবহারকারী ইকমার্স এবং হাতে গোনা কিছু ব্লগ এর সাইট পড়েন। এইগুলির বাহিরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সংক্রান্ত ওয়েবসাইট এর সংখ্যা খুবই নগণ্য। কিন্তু বাংলাদেশির হাতে তৈরি, খোদ ঢাকাতে বসে বিশ্ব দরবারে আন্তর্জাতিক প্রযুক্তির পলিসি ও দিকনির্দেশনা নিয়ে লিখছে এমন কেউই নেই- আমার সেটিই ধারণা ছিল। কিন্তু সেই ভুলটা ভাঙলো “দ্যা ওয়েভস” https://www.the-waves.org/ নামক একটি চমৎকার পোর্টাল দেখে। আজকে আপনাদেরকে সেই সাইটেরই গল্প শোনাব। এটি অনলাইন এনালাইসিস এবং কমেন্টানি বা মতামত পাবলিকেশন এর ওয়েবসাইট। এটি শুধু একটি ওয়েবসাইট বললে ভুল হবে, আবার অনলাইন ম্যাগাজিন বললেও যথার্থ হবে না—তাই একে ‘পোর্টাল’ বলেই সম্বোধন করছি।
দ্যা ওয়েভস কি নিয়ে কাজ করে?
বর্তমান সময়ে প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং এর প্রভাব সমাজের সর্বস্তরে ব্যাপক পরিবর্তন আনছে। এর সঙ্গে সঙ্গে উদ্ভাবনের জটিলতা এবং অনিশ্চয়তাও বাড়ছে। উদ্ভাবনের প্রক্রিয়া, এর চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগগুলোকে উপলব্ধি করে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে দ্যা ওয়েভস কাজ করছে একটি অনন্য প্ল্যাটফর্ম হিসেবে। দ্যা ওয়েভস একটি প্ল্যাটফর্ম যার লক্ষ্য হল উদ্ভাবনের গতিশীলতা বিশ্লেষণ করে সমাজের বৃহত্তর মঙ্গলের জন্য সঠিক নীতিমালা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করা। তাদের মিশন এবং দর্শন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং নীতিগত প্রভাবগুলো বিশ্লেষণ করার মাধ্যমে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উদ্ভাবনী ধারণাগুলোর বাস্তবায়নকে সমর্থন করা।
The Waves এর ওয়েবসাইট: https://www.the-waves.org/
দ্যা ওয়েভস-এর কার্যক্রম
দ্যা ওয়েভস এর মূল কাজ হলো উদ্ভাবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিশ্লেষণ ও প্রাসঙ্গিক মতামত প্রদান। তারা গবেষণা এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতির ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ক্ষেত্রের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করে এবং তাদের পাঠকদের সামনে তা তুলে ধরে। তাদের বিশ্লেষণ শুধু বর্তমানের প্রযুক্তি প্রবণতা এবং উদ্ভাবনই নয়, বরং তা ভবিষ্যতের প্রেক্ষাপটে কীভাবে প্রভাব ফেলবে তাও তুলে ধরে। দ্যা ওয়েভস এর কথা হল, উদ্ভাবনই একটি দেশের সমৃদ্ধি অর্জনের মূল চাবিকাঠি। তবে এটি কোনো সহজ বা সোজা পথ নয়। উদ্ভাবনের জগৎ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ধারণা আসছে, আর সেই সাথে বেড়ে চলেছে স্টার্টআপ ব্যর্থতার হার, আর্থিক ক্ষতি এবং বড় বড় কোম্পানির পতন। আবার একই সাথে ছোট ছোট উদ্যোগও একদিন বৈশ্বিক স্তরে সাফল্যের মুখ দেখছে। উদ্ভাবনের এই অনিশ্চিত পথগুলোকে বিশ্লেষণ করাই দ্যা ওয়েভস-এর অন্যতম উদ্দেশ্য। তারা উদ্ভাবনী প্রক্রিয়ায় সহায়তা করতে এবং নতুন নতুন আইডিয়াগুলোকে কীভাবে লাভজনকভাবে ব্যবহার করা যায় তার গাইডলাইন প্রদান করে। উদ্ভাবন থেকে লাভবান হওয়া কেবল ভালো শিক্ষা, অবকাঠামো বা বিনিয়োগের ওপর নির্ভরশীল নয়, বরং প্রতিযোগিতামূলক বাজার, সঠিক কৌশল এবং নীতি নির্ধারণেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসব বিষয়গুলোর সঠিক ভারসাম্য নির্ধারণ করাই দ্যা ওয়েভস-এর কাজের অন্যতম অংশ।
কীভাবে উদ্ভাবন সমাজকে প্রভাবিত করে?
প্রযুক্তিগত অগ্রগতি যেমন আমাদের জীবনকে সহজতর করছে, ঠিক তেমনি এটি সমাজের মধ্যে এক ধরণের বিভাজনও তৈরি করছে। উদ্ভাবন যেমন নতুন নতুন চাকরির ক্ষেত্র তৈরি করছে, তেমনি পুরনো পেশাগুলোকেও সংকটে ফেলছে। আবার উদ্ভাবনের মূল শক্তি হচ্ছে আইডিয়া। দ্যা ওয়েভস-এর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা যায় যে, উদ্ভাবনের মাধ্যমে নতুন নতুন ধারণাগুলো কিভাবে অর্থনীতিতে বিশাল পরিবর্তন আনে। উদাহরণ হিসেবে তারা বৈদ্যুতিক গাড়ির উদ্ভাবনকে তুলে ধরে, যা তেল-ভিত্তিক অর্থনীতির ওপর বিশাল প্রভাব ফেলেছে। তারা আরও বিশ্লেষণ করে যে, কীভাবে উদ্ভাবন বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়িয়ে দেয় এবং প্রতিষ্ঠিত বড় বড় কোম্পানিগুলোও কীভাবে স্টার্টআপ দ্বারা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়।
কেন দ্যা ওয়েভস গুরুত্বপূর্ণ?
বিশ্বব্যাপী উদ্ভাবনের প্রক্রিয়া অত্যন্ত গতিশীল এবং অনিশ্চিত। উদ্ভাবনী প্রযুক্তিগুলো কেবল উন্নত দেশগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং উন্নয়নশীল দেশগুলোকেও প্রভাবিত করে। তবে বড় সমস্যা হলো, উদ্ভাবনের বেশিরভাগ সুবিধা এবং সম্ভাবনা কেবল কয়েকটি উন্নত দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এই জায়গা থেকেই দ্যা ওয়েভস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে উদ্ভাবনের প্রতিযোগিতায় প্রবেশ করতে সহায়তা করে এবং তাদের আইডিয়াগুলোর মূল্যায়ন ও বাণিজ্যিকীকরণে সহায়তা করে।
দ্যা ওয়েভস বিশ্বাস করে যে, আইডিয়া ও উদ্ভাবন কেবল ধনী দেশগুলোর একচেটিয়া সম্পদ হওয়া উচিত নয়। এর পরিবর্তে, তারা একটি বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার আহ্বান জানায়, যেখানে প্রত্যেক দেশ এবং সংস্থার সমান সুযোগ থাকবে উদ্ভাবনের মাধ্যমে সমাজকে রূপান্তর করার।
দ্যা ওয়েভস এর পিছনের গল্প
এই পোর্টালের উদ্দ্যোক্তা হলেন আমারই প্রাক্তন সহকর্মী প্রোফেসর ড. রোকনুজ্জামান। তিনি বর্তমানে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল এবং কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন, যেখানে তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং ইকোনমিক্স এবং ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে শিক্ষা দিচ্ছেন। তার নেতৃত্বে পরিচালিত গবেষণা প্রকল্পগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের সফটওয়্যার এবং টেলিকম খাতের ধীর গতির বিকাশের কারণ অনুসন্ধান এবং সমাধান প্রস্তাবনার কাজ অন্যতম। ড. রোকনুজ্জামানের কাজ মূলত প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে ক্রমহ্রাসমান সম্পদ থেকে কীভাবে ক্রমবর্ধমান সম্পদ সৃষ্টি করা যায় তার সম্ভাবনার উপর কেন্দ্রীভূত।
তার একাডেমিক ও প্রায়োগিক গবেষণার মাধ্যমে তিনি বিজ্ঞানের সাথে প্রযুক্তি, অর্থনীতি, উদ্যোক্তাবৃত্তি এবং জননীতি একত্রে কিভাবে কার্যকর হতে পারে, সে সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন করেছেন। তিনি বিভিন্ন সৃজনশীল প্রকল্পের নেতৃত্ব দিয়েছেন, যার মধ্যে মাইক্রোকন্ট্রোলার-ভিত্তিক শিক্ষা কিট এবং হাতের ধরাছোঁয়ার মধ্যে রোগী পর্যবেক্ষণের মতো উদ্ভাবনী ডিভাইস তৈরির প্রকল্পগুলো উল্লেখযোগ্য।
মেমোরিয়াল ইউনিভার্সিটি অব নিউফাউন্ডল্যান্ড থেকে রোবটিক্স এবং ইন্টেলিজেন্ট সিস্টেমস-এ পিএইচডি অর্জনের পাশাপাশি, তিনি স্পেস রোবটিক্স প্রযুক্তির উপর গবেষণা করেছেন এবং তা কিভাবে পৃথিবীর খনি শিল্পে প্রয়োগ করা যায়, তার উপর কাজ করেছেন। তার গবেষণা, লেখালেখি এবং উদ্ভাবনী প্রকল্পগুলো বাংলাদেশের প্রযুক্তি খাতের উন্নয়নে অবদান রাখছে এবং সৃজনশীল উদ্যোক্তাবৃত্তি ও নীতিনির্ধারণে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করছে।
দ্যা ওয়েভস-এর মিশন ও ভবিষ্যৎ কি?
দ্যা ওয়েভস এর মূল মিশন সম্পর্কে কথা হয়েছিল এর উদ্দ্যোক্তা প্রোফেসর ড. রোকন জামান এর সাথে। তিনি জানালেন, “দ্যা ওয়েভসে এর মিশন হলো কীভাবে আইডিয়া তৈরি হয়, কীভাবে তা উদ্ভাবনে রূপান্তরিত হয়, এবং কীভাবে উদ্ভাবন থেকে সৃষ্ট সম্পদ বৃদ্ধি করা যায় তা বিশ্লেষণ করা। তারা উদ্ভাবনী প্রযুক্তিগুলো কীভাবে সমাজকে পরিবর্তন করে এবং ভবিষ্যতে আরও কী কী সুযোগ তৈরি হবে তার ওপর গবেষণা করে। আমাদের লক্ষ্য হল উন্নয়নশীল দেশগুলোর STEM (Science, Technology, Engineering, Mathematics) শিক্ষা এবং গবেষণার মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুযোগ তৈরি করা। আইডিয়া এবং উদ্ভাবনের মূল্যায়ন এবং ব্যবহারিক প্রয়োগের মাধ্যমে তারা দেশগুলোকে সহায়তা করতে চায় যাতে তারা তাদের নিজস্ব উদ্ভাবন শক্তির মাধ্যমে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারে।”
পরিশেষে
দ্যা ওয়েভস শুধু প্রযুক্তি উদ্ভাবনের বিশ্লেষণই করে না, তারা একটি উন্নয়নশীল ভবিষ্যতের জন্য দিকনির্দেশনা প্রদান করে। তাদের গভীর বিশ্লেষণ এবং উদ্ভাবনের ভবিষ্যৎ গতিবিধির উপর ভিত্তি করে তারা প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনকে আরও সঠিকভাবে ব্যবহার করে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাওয়ার উপায় খুঁজে বের করে। উদ্ভাবনের প্রতিযোগিতায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য দ্যা ওয়েভস এর অবদান অপরিসীম। তাদের কাজ কেবল প্রযুক্তিগত উন্নয়ন নয়, বরং বৈশ্বিক সম্পদ বন্টনেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে পারে।
২০২৩ সালের হিসাবে, বাংলাদেশের জিডিপি প্রায় $৪৩৭.৪২ বিলিয়ন (ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী)।বাংলাদেশ একটি স্থিতিশীল জিডিপি প্রবৃদ্ধির ধারা বজায় রেখেছে, কিন্তু মুদ্রাস্ফীতি এবং বাহ্যিক অর্থনৈতিক চাপের মতো চ্যালেঞ্জ অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করছে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতির উন্নয়ন মূলত প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন, রপ্তানি বহুমুখীকরণ, এবং দক্ষ জনশক্তির উপর নির্ভর করছে। আগামীতে রেমিট্যান্সের প্রবাহ বাড়ানো, শিল্পখাতের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করা অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশের জন্য দ্যা ওয়েভস এর মতন উন্নয়নশীল ভবিষ্যতের জন্য দিকনির্দেশনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে বাংলাদেশের নীতি-নির্ধারণী ও দিকনির্দেশনা সংক্রান্ত কর্মরত লোকজনের জন্য দ্যা ওয়েভসে এর মতন পোর্টালগুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
শুধু বাংলাদেশই নয় দ্যা ওয়েভস কাজ করে পুরো বিশ্বের জন্য। সারা বিশ্বের উন্নয়নশীল ভবিষ্যতের জন্য কর্মরত দ্যা ওয়েভস থেকে আমরা বাংলাদেশও সুবিধা নিতে পারবো। এবং একজন বাংলাদেশি এই ক্ষেত্রে দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন, তার দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশও উপকৃত হতে পারে বলেই আমার বিশ্বাস। প্রযুক্তি উদ্ভাবন, তার মেধাসম্পদ সংরক্ষণ এবং এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে দ্যা ওয়েভস এর এই প্রচারকে আমি সাধুবাদ জানাই এবং এর উদ্যাক্তা প্রোফেসর রোকন জামান ভাইয়ের সফলতা কামনা করছি।
Leave a comment