মহাকাশসাধারণ বিজ্ঞান

সূর্য নিভে গেলে জীবন কী টিকে থাকবে?

Share
Share

একটি বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানমূলক অধ্যায়
✍️ লেখক: বিজ্ঞানী.অর্গ |

একদিনের গল্প—নাসার একটি টেলিস্কোপ প্লুটোর দিকে তাকিয়ে আছে। সময় তখন সূর্যের মৃত্যুপর্বের শুরু। পৃথিবী ইতিমধ্যে এক বিশাল লাল দৈত্যের আগুনে ছাই হয়ে গেছে। সমুদ্র নেই, পাহাড় নেই, বাতাস নেই। শুধু ফুটন্ত পাথর আর লাল উত্তপ্ত বায়ুমণ্ডল। অথচ প্লুটোর জমাট বরফ তখন গলছে, মিথেন আর কার্বনের বাষ্পে একটা পাতলা বায়ু তৈরি হয়েছে, আর কোনো আশ্চর্য প্রাণ এককোষী জীবের মতো বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে—নতুন এক পৃথিবী গঠনের সম্ভাবনা।

এই গল্পটি বাস্তব নয়, কিন্তু একেবারেই অসম্ভবও নয়। জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফিল প্লেইট যেমন বলেছিলেন, “সূর্যকে যদি কয়েক কোটি বছর সময় দেওয়া হয়, তবে সে এমন রূপ নেবে যা জীবনকে ভস্ম করে দেবে।” প্রশ্ন হচ্ছে, তখনও কি কোথাও, কোনোভাবে জীবন টিকে থাকতে পারবে?

প্রতিদিন সকালে যে সূর্য উঠছে, তাকে আমরা চেনা চেহারায় দেখেই অভ্যস্ত। কিন্তু সূর্য আসলে একটি বিশাল নিউক্লিয়ার চুল্লি। প্রতি সেকেন্ডে এটি প্রায় ৬০০ মিলিয়ন টন হাইড্রোজেনকে হেলিয়ামে রূপান্তর করছে, আর সেই সঙ্গে প্রচুর তাপ ও আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। এই হেলিয়াম ধীরে ধীরে সূর্যের কেন্দ্রে জমে ‘ছাইয়ের মতো’ ভারী স্তর তৈরি করে।

এই স্তরের উপর সূর্যের অন্যান্য গ্যাসীয় স্তরগুলো চাপ সৃষ্টি করে। ফলে হেলিয়াম স্তর সংকুচিত হয়ে আরো উত্তপ্ত হয়। এর ফলে সূর্য ধীরে ধীরে আরো উজ্জ্বল ও বিশালতর হয়ে ওঠে—একটি লাল দানব (Red Giant) তারায় রূপান্তরিত হয়।

এই রূপান্তরের সময় সূর্য তার বিস্তৃত আকারে বুধ ও শুক্রকে গ্রাস করবে, এবং তারপর পৃথিবীকেও। পৃথিবীর তাপমাত্রা তখন প্রায় ১৩০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছাবে। সমুদ্র বাষ্প হয়ে যাবে, বায়ুমণ্ডল উবে যাবে, আর শিলাগুলিও গলে গিয়ে লাভার সাগরে পরিণত হবে।

এই ধারণা বিজ্ঞানীরা পেয়েছেন দীর্ঘ গবেষণা, কম্পিউটার সিমুলেশন এবং সূর্যের মতো অন্যান্য নক্ষত্রের পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে। যেমন, হাবল স্পেস টেলিস্কোপ বহু ‘বৃদ্ধ নক্ষত্র’-এর জীবনচক্র পর্যবেক্ষণ করেছে। এছাড়া, ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সির গাইয়া মিশন থেকে সূর্যের ভর, বয়স ও ভবিষ্যতের ব্যাপারে উচ্চমাত্রার তথ্য পাওয়া গেছে।

আর এই ভবিষ্যদ্বাণী শুধু পৃথিবীর জন্য নয়। সৌরজগতের প্রায় সব গ্রহই এই উত্তপ্ত সূর্যের শিকার হবে। মঙ্গল কিছু সময় পর্যন্ত টিকে থাকলেও, শেষ পর্যন্ত তারও গতি হবে পৃথিবীর মতো।

তবে সব আশার আলো নিভে যায় না। প্লুটো, সূর্য থেকে ৫০ গুণ দূরে থাকা এক বরফাচ্ছাদিত গ্রহাণু, তখন হতে পারে একমাত্র সম্ভাব্য নিরাপদ আশ্রয়। তখনও তার পৃষ্ঠতল হবে -১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো ঠাণ্ডা, কিন্তু তার বরফ গলে পাতলা বায়ুমণ্ডল তৈরি করতে পারে। সেই বায়ুমণ্ডলে মিথেন ও কার্বনের উপস্থিতি জীবন রক্ষায় সামান্য সহায়ক হতে পারে।

বিষয়টি ঘিরে বিজ্ঞানীদের মধ্যে নানা মতভেদ রয়েছে। কেউ মনে করেন, প্লুটোর মতো শীতল গ্রহে টিকে থাকা জীব যদি থাকে, তবে তা হবে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাঁচের—হয়তো জমাট তরল মিথেনেই শ্বাস নেয় এমন কোনো অণুজীব। কেউ আবার বলেন, সৌরজগতের বাইরের চাঁদ যেমন জুপিটারের ইউরোপা বা স্যাটার্নের এনসেলাদাস—যেখানে বরফের নিচে তরল জলের সম্ভাবনা রয়েছে—তাদের ভেতরেও প্রাণ লুকিয়ে থাকতে পারে।

নতুন গবেষণা বলছে, যদি কোনো প্রযুক্তিবান প্রজাতি (যেমন মানুষ) আগে থেকেই সচেতন হয়, তবে তারা অন্য গ্রহে বা আন্তঃনাক্ষত্রিক মহাকাশযানে গিয়ে জীবন টিকিয়ে রাখতে পারে। তবে তা কেবল প্রযুক্তিগত নয়, সামাজিক ও নৈতিক দিক থেকেও বিশাল প্রশ্ন তুলে দেয়:
– আমরা কাদের বাঁচিয়ে নিয়ে যাব?
– কারা সিদ্ধান্ত নেবে?
– পৃথিবী ধ্বংসের আগে আমরা কীভাবে একসাথে প্রস্তুত হবো?

এই গবেষণা শুধু বিজ্ঞানীদের নয়, দার্শনিক, নীতিবিদ, পরিবেশবিদ এমনকি লেখকদের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। পৃথিবীর মৃত্যুর সম্ভাব্য দিন নিয়ে মহাকাশীয় অভিবাসনের কল্পনাগুলো আজ আর কেবল সায়েন্স ফিকশন নয়, বরং বিজ্ঞানভিত্তিক ভবিষ্যৎ ভাবনার অংশ। এলন মাস্ক-এর SpaceX, জেফ বেজোস-এর Blue Origin বা চীনের CNSA—সবাই এখন আন্তঃগ্রহ অভিযানের পরিকল্পনা করছে।

আগামী ৫–১০ বছরে কী হতে পারে?

  1. জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ নতুন গ্রহ ও উপগ্রহে প্রাণের সম্ভাবনার খোঁজ করছে।
  2. প্লুটো বা ইউরোপার মতো বরফাচ্ছাদিত উপগ্রহে রোবটিক মিশন পাঠানোর কাজ এগোচ্ছে।
  3. কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহার করে ‘অত্যন্ত প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকা প্রাণ’ তৈরি করার চেষ্টা হচ্ছে।
  4. মানবজাতিকে অন্য নক্ষত্রে পাঠানোর আগে চাঁদ বা মঙ্গলকে ‘সাময়িক বেস ক্যাম্প’ হিসেবে গড়ে তোলার প্রকল্প চলছে।

শেষ কথা:
পৃথিবী চিরকাল থাকবে না। সূর্য একদিন নিভে যাবে, আর পৃথিবী হবে ছাই। কিন্তু জীবন থেমে যাবে কি? বিজ্ঞান বলছে, জীবন অত্যন্ত জেদি—সে তার পথ খুঁজে নেয়। হয়তো ভবিষ্যতের কোনো দিন, কোনো গ্রহে, কোনো এক বহুদূরের সূর্যের আলোয় কেউ বলবে, “আমরা এসেছি সেই গ্রহ থেকে, যার নাম ছিল পৃথিবী।”

📚 তথ্যসূত্র:

  • Phil Plait, Bad Astronomy Blog, Slate Magazine
  • Nature Astronomy Journal
  • NASA JWST Mission Updates
  • ESA Gaia Spacecraft Reports
  • Scientific American (2025)

📌 লেখাটি ‘বিজ্ঞানী.অর্গ’–এর পাঠকদের জন্য লেখা, যারা বিজ্ঞানকে জানে, ভালোবাসে, এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনার প্রতি কৌতূহলী।

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

Related Articles
ইতিহাসের এই দিনেসাধারণ বিজ্ঞান

বয়সের হদিস: প্রাচীন জিনিসের বয়স কীভাবে নির্ধারণ করেন বিজ্ঞানীরা?

সহজ বাংলা ভাষায় কার্বন-১৪, পটাসিয়াম-আর্গন এবং অন্যান্য ডেটিং পদ্ধতি ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা...

পদার্থবিদ্যামহাকাশ

মহাকাশযানে গ্র্যাভিটেশনাল স্লিংশট: মহাকাশ ভ্রমণে বিপ্লবী কৌশল

মহাকাশ ভ্রমণে বিপ্লব ঘটাতে পারে এমন মহাকর্ষীয় স্লিংশট কৌশলের পিছনের বিজ্ঞান আবিষ্কার...

বিজ্ঞান বিষয়ক খবরমহাকাশ

নাসার সংকট: ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা

ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে নাসা গভীর অভ্যন্তরীণ সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে, যার মধ্যে বিশাল...

বিজ্ঞান বিষয়ক খবরমহাকাশ

সূর্য কি সুপারফ্লেয়ার এর মতন বিস্ফোরিত হতে পারে?

আমাদের সূর্য কি কোনও ধ্বংসাত্মক সুপারফ্লেয়ার সৃষ্টি করতে পারে? সৌর সুপারফ্লেয়ার সম্পর্কে...

পদার্থবিদ্যামহাকাশ

সূর্য কি সত্যিই হলুদ? মহাশূন্যের চোখে উন্মোচিত হলো সাদা সত্য

সূর্য কি সত্যিই হলুদ? সূর্যের আসল রঙ সম্পর্কে অবাক করা বৈজ্ঞানিক সত্য...

Three Columns Layout

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact

biggani.org❤️gmail.com

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

বিজ্ঞানী অর্গ (biggani.org) বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে গবেষণা ও বিজ্ঞান নিয়ে বাংলা ভাষায় তথ্য ও সাক্ষাৎকার প্রচার করে – নবীনদের গবেষণা ও উচ্চশিক্ষায় প্রেরণা দেয়া হয়।

যোগাযোগ:

biggani.org@জিমেইল.com

biggani.org, a community of Bangladeshi scientists, shares interviews and information about researchers and scientists in Bengali to inspire young people in research and higher education.