বিশেষ প্রতিবেদন | বিজ্ঞান বার্তা
একটি ইমেলের গল্প
ড. রাকিব হাসান গভীর রাত অবধি তাঁর গবেষণার উপর কাজ করছেন। তাঁর দল ক্যান্সার কোষের বিস্তার রোধে একটি নতুন প্রোটিন আবিষ্কার করেছে, যা চিকিৎসা বিজ্ঞানে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে। তিনি চান এই গবেষণাটি সংবাদ মাধ্যমে আসুক, যাতে সাধারণ মানুষ ও নীতিনির্ধারকরা গুরুত্ব বুঝতে পারেন।
একটি ইমেল লিখে তিনি পাঠালেন কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে। কিন্তু কয়েকদিন পরেও কোনো সাড়া নেই। হতাশ হয়ে তিনি ভাবতে থাকলেন—সাংবাদিকরা কি তাঁর গবেষণাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না, নাকি তিনি ভুল উপায়ে যোগাযোগ করছেন?
এমনই পরিস্থিতির সম্মুখীন হন অনেক বিজ্ঞানী। কিন্তু কেন? বিজ্ঞানীরা এত গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেও কেন সাংবাদিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হন?
সাংবাদিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন কীভাবে?
একজন বিজ্ঞান সাংবাদিক প্রতিদিন অসংখ্য গবেষণা নিয়ে ইমেল পান। তাঁদের পক্ষে সব গবেষণা কাভার করা সম্ভব নয়। তাই বিজ্ঞানীদের উচিত সঠিক কৌশলে তাঁদের গবেষণার গল্প তুলে ধরা।
১. ব্যক্তিগত স্পর্শ দিন, গণ-ইমেল নয়
সাধারণত, অনেক গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের গণসংযোগ দফতর একসঙ্গে শত শত সাংবাদিককে একই ইমেল পাঠান। এটি একটি সাধারণ ভুল। সাংবাদিকরা ব্যক্তিগত যোগাযোগকে বেশি গুরুত্ব দেন।
বিজ্ঞান সাংবাদিক বেনজামিন প্ল্যাকেট বলেন,
“আমি একবার একজন গবেষকের কাছ থেকে এমন একটি ইমেল পেয়েছিলাম যেখানে তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন, এটি তাঁর প্রথম প্রকাশিত গবেষণা এবং তিনি চান এটি মানুষ জানুক। তাঁর ইমেলে ব্যক্তিগত স্পর্শ ছিল, যা আমাকে আকৃষ্ট করেছিল। ফলে, আমি তাঁর গবেষণাটি কাভার করি।”
অর্থাৎ, যদি বিজ্ঞানীরা সাংবাদিকদের আগ্রহ বোঝার চেষ্টা করেন এবং তাঁদের আগ্রহের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ গবেষণা তুলে ধরেন, তাহলে প্রতিক্রিয়া পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
পাঠক তানিয়া মেহেদী মন্তব্য করেছেন, “আমি সব সময় বিজ্ঞানসংক্রান্ত খবর পড়তে ভালোবাসি। কিন্তু অনেক সময় একই ধরনের বিজ্ঞপ্তি এত বেশি আসে যে খুঁজে বের করা কঠিন হয়ে যায় কোনটি আসলে নতুন ও গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তিগতভাবে লেখা ইমেল বা পিচ আমার কাছে বেশি বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়।”
২. শুধু গবেষণা নয়, গল্প বলুন
একটি গবেষণার সংখ্যাগত ফলাফল যতই চমকপ্রদ হোক, তা যদি আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করা না হয়, তাহলে তা সংবাদমাধ্যমে ঠাঁই পাবে না। গবেষণার মানবিক দিক তুলে ধরতে হবে।
খ্যাতনামা বিজ্ঞান লেখক কার্ল জিমার বলেন,
“সাংবাদিকরা গল্প খোঁজেন, সংখ্যা নয়। গবেষণার পিছনের কাহিনি যদি শক্তিশালী হয়, তবে তা পাঠকদের আগ্রহ তৈরি করবে।”
উদাহরণস্বরূপ, ড. রাকিবের গবেষণা শুধু নতুন এক প্রোটিন আবিষ্কারের গল্প নয়, বরং এটি এক সাহসী লড়াই—যেখানে বিজ্ঞানীরা নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলছেন।
৩. দৃশ্যমান উপস্থাপনা: ছবি ও গ্রাফিক্স ব্যবহার করুন
একটি আকর্ষণীয় ছবি বা ডাটা ভিজুয়ালাইজেশন সাংবাদিকদের জন্য বড় সহায়ক হতে পারে। সংবাদমাধ্যমগুলোর ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ভিজুয়াল কনটেন্টের গুরুত্ব অনেক বেশি।
একজন জার্মান বিজ্ঞান সাংবাদিক, হান্স পিটারসন বলেন,
“আমরা যখন কোনো গবেষণার কথা লিখি, তখন সম্পাদকরা প্রথমেই জানতে চান—কোন ছবি দেওয়া হবে? যদি বিজ্ঞানীরা নিজেই ভালো মানের ছবি বা ডাটা ভিজুয়ালাইজেশন সরবরাহ করতে পারেন, তাহলে গবেষণার কাভারেজের সুযোগ বাড়ে।”
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গবেষক ড. শহীদুল হক মন্তব্য করেছেন, “একটি ছবিই অনেক সময় গবেষণার প্রভাবকে সাধারণ মানুষের কাছে স্পষ্ট করে তোলে। ভিজুয়াল দিকটির কথা ভাবতে হবে।”
৪. মূল বক্তব্য আগে বলুন, বিশদ ব্যাখ্যা পরে
গবেষকরা প্রায়ই গবেষণার পিচ পাঠানোর সময় একদম পদ্ধতিগতভাবে তথ্য সাজিয়ে দেন—প্রথমে ভূমিকা, তারপর ব্যাকগ্রাউন্ড, তারপরে ফলাফল। কিন্তু সাংবাদিকরা ‘লিড’ চান—অর্থাৎ গবেষণার মূল অর্জন কী?
বিশিষ্ট বিজ্ঞান সাংবাদিক ডেবোরা ব্লাম বলেন,
“গবেষকরা তাঁদের গবেষণার প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মূল খবর চাপা দিয়ে ফেলেন। প্রথমেই বলে ফেলুন—আপনার গবেষণার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি কী?”
সুতরাং, গবেষণা পিচ করতে হলে প্রথমেই বলতে হবে—এই গবেষণার মাধ্যমে কী নতুন জানা গেল এবং এটি কীভাবে সমাজে প্রভাব ফেলতে পারে।
একটি সফল পিচের নমুনা
একটি শক্তিশালী বিজ্ঞান পিচের নমুনা হতে পারে এ রকম:
“গবেষকরা নতুন একটি প্রোটিন আবিষ্কার করেছেন যা ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি ৬০% পর্যন্ত কমিয়ে দিতে পারে। এই আবিষ্কার ক্যান্সার চিকিৎসার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে। গবেষণাটি সম্প্রতি ‘নেচার মেডিসিন’-এ প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণার মূল গবেষক ড. রাকিব হাসান বলেন, ‘আমরা আশা করছি, আমাদের গবেষণার ফলে নতুন ধরনের ক্যান্সার থেরাপি উন্নত করা সম্ভব হবে।’ সংযুক্ত গবেষণা সংক্ষেপ ও চিত্রাবলি পাঠানো হলো। আপনার আগ্রহ থাকলে সাক্ষাৎকারের জন্য আমরা প্রস্তুত।”
এটি সংক্ষিপ্ত, আকর্ষণীয় এবং সরাসরি মূল বিষয়ে আসে।
শেষ কথা: বিজ্ঞানের গল্পকে আকর্ষণীয় করুন
একজন বিজ্ঞানী হিসেবে শুধু গবেষণা করাই যথেষ্ট নয়, এটি জনসাধারণের কাছে কীভাবে পৌঁছানো যায়, সেটিও জানা জরুরি।
খ্যাতনামা বিজ্ঞান সাংবাদিক এড ইয়ং বলেন,
“বিজ্ঞানীরা যদি তাঁদের গবেষণা সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে না পারেন, তাহলে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারগুলো আড়ালে থেকে যাবে।”
সুতরাং, গবেষণা শুধু জার্নালে সীমাবদ্ধ না রেখে জনসাধারণের কাছে নিয়ে যেতে চাইলে সাংবাদিকদের সঙ্গে কার্যকরভাবে যোগাযোগ করতে হবে। এবং এটি করার সঠিক উপায় হলো—ব্যক্তিগত যোগাযোগ, গল্প বলার কৌশল, আকর্ষণীয় ভিজুয়াল ব্যবহার এবং মূল পয়েন্টকে সামনে আনা।
আপনার গবেষণাও হয়তো পরবর্তী বিজ্ঞান সংবাদ হতে পারে, যদি এটি সঠিকভাবে উপস্থাপন করা হয়!
Leave a comment