অতিথি লেখক- আজিজুল হক
সহকারী অধ্যাপক, ইয়েংনাম বিশ্ববিদ্যালয়।
আজকাল প্রায়ই সংবাদপত্র বা সামাজিক মাধ্যমে দেখা যায় পিএইচডি ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে অথবা অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে এমনও প্রফেসর আছেন যাদের পিএইচডি ডিগ্রি নেই। বিষয়টি শুধু একাডেমিক যোগ্যতা নিয়ে নয়, এটি আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষার কাঠামো ও মান সম্পর্কে একটি গভীর প্রশ্ন তুলে ধরে।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলি, আমি যখন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএস শেষ করি তখন অনেক কিছু জানি মনে হতো। মনে হতো চাকরি পেলে নিশ্চয়ই সব পড়াতে পারব। কিন্তু যখন পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তি হলাম শুরুতে একই ভাবনা মাথায় ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বুঝলাম আমার সাবজেক্টের বেশিরভাগ আধুনিক কিছুই আমি জানি না। বুঝতে পারলাম আমি যেটুকু জানি সেটা হয়তো পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল, কিন্তু প্রকৃত গবেষণা বা উচ্চপর্যায়ের শিক্ষায় অবদান রাখার জন্য তা অত্যন্ত সীমিত। ধীরে ধীরে আমার এই উপলব্ধি তৈরি হয় যে এমএস পর্যন্ত একজন শিক্ষার্থীর জানার সীমা অনেক ছোট এবং সেই সীমাবদ্ধতা থাকা অবস্থায় কাউকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হলে সেটি শিক্ষার্থীদের সাথে এক ধরনের প্রতারণা।
বাংলাদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু কোর্সে এখনও যা পড়ানো হয়, সেগুলো অনেক উন্নত দেশে ২০ বছর আগেই মূলধারার বাইরে চলে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় হলো উচ্চতর জ্ঞানচর্চার স্থান, যেখানে চলমান জ্ঞানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন কিছু তৈরি হওয়ার কথা। এখানে পাঠ্যসূচি অনুসারে কেবল ক্লাস নেওয়া, সিলেবাস শেষ করা কিংবা পরীক্ষার খাতা দেখা শিক্ষকের কাজের একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। একজন প্রকৃত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক শুধু PowerPoint ব্যবহার করে লেকচার দেন না বরং তিনি গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করেন, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য প্রাসঙ্গিক সমস্যার সমাধানে চিন্তা করেন এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিশ্লেষণ ও অনুসন্ধানের ক্ষমতা গড়ে তোলেন। এই দক্ষতাগুলো ছাড়া কেবল নোট রেডার হবে, শিক্ষক নয়।
দুঃখজনক হলেও সত্য, আমি এমন অনেক বাংলাদেশি শিক্ষককে দেখেছি যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পাওয়ার পর পিএইচডিতে ভর্তি হয়েছেন, কিন্তু মনযোগ দিয়েছেন কেবল ডিগ্রি পাওয়ার দিকে, শেখার দিকে নয়। অনেক সময় আবার তারা প্রকাশ্যে গর্ব করে বলেন আমার তো পার্মানেন্ট চাকরি আছে, এখন আমার শুধু সার্টিফিকেটটাই দরকার। এই মনোভাব যদি মাত্র ১% শিক্ষকের মধ্যেও থাকে, তবে রাষ্ট্রের টাকা খরচ করে পিএইচডির নামে এই অপচয়ের দায় কে নেবে?
অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের নিজের কোনো আন্তর্জাতিক পাবলিকেশন নেই (Web of Science Indexed), কোনো স্কলারশিপ পাননি, অথচ তিনি পড়াচ্ছেন উচ্চতর গবেষণা পদ্ধতি, শিক্ষার্থীদের থিসিস রিভিউ করছেন, এমনকি গবেষণার মূল্যায়নও করছেন। এভাবে হাজার হাজার শিক্ষার্থী গবেষণার মূল চর্চা না শিখেই ডিগ্রি নিচ্ছে এবং দিন শেষে দেশে ডিগ্রিধারী বাড়ছে, গবেষক নয়। অবশ্যই এটা বলা ঠিক নয় যে পিএইচডি না থাকলেই কেউ অযোগ্য। তবে প্রশ্ন হলো একজন শিক্ষক যখন নিজেই গবেষণা জানেন না, তাহলে তিনি কীভাবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গবেষক বানাবেন?
তাই এখন সময় এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে পিএইচডি বাধ্যতামূলক করার দাবি আরও জোরালোভাবে তোলার। পিএইচডি ছাড়া শিক্ষক থাকা মানে শিক্ষা ব্যবস্থায় গবেষণাহীন, চিন্তাহীন একটি প্রজন্ম তৈরি করা। আমরা যদি সত্যিকারের Centre of Excellence গড়তে চাই, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের শুধু পিএইচডি থাকলেই হবে না, সেই সঙ্গে তার গবেষণার মান, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, প্রকল্প অংশগ্রহণ এবং গবেষণায় অবদান বিবেচনায় রাখতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় যেন শুধু সার্টিফিকেট বিতরণের কেন্দ্র না হয়ে সত্যিকারের জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হয়ে ওঠে, তা নিশ্চিত করতে হলে যোগ্য ও গবেষণাভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মানে গাইড, গবেষক, পথপ্রদর্শক। তাকে সেই জায়গাটিতে পৌঁছাতে হলে পিএইচডি শুধু প্রয়োজন নয়, অপরিহার্য।
Leave a comment