বিজ্ঞান বিষয়ক খবরসাধারণ বিজ্ঞান

জ্যোতিষশাস্ত্র বনাম বাস্তব বিজ্ঞান

Share
Share

রাত তখন প্রায় সাড়ে দশটা। ঢাকার এক ব্যস্ত চায়ের দোকানে বসে আছেন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া সাদিক এবং তার বন্ধু রাকিব। চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে রাকিব বলে উঠল,
— “ভাই, আজকের রাশিফল বলছে, আমার জীবনে বড় পরিবর্তন আসবে! তাই আজ আমি পরীক্ষার পড়া বাদ দিয়ে একটু রিল্যাক্স করছি।

সাদিক হেসে জবাব দিল,
— “এইসব ভ্রান্তি বাদ দে! আসলে তোর পরিশ্রমই ঠিক করবে তোর ভবিষ্যৎ, নক্ষত্র নয়।

রাকিব মাথা নেড়ে বলল, “তোর কথার মধ্যে যুক্তি আছে, কিন্তু জানিস তো, মা ছোটবেলা থেকেই রাশিফলে বিশ্বাস করে। ওনার কথা অমান্য করা কঠিন!”

রাকিবের মতো লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতিদিন রাশিফল পড়ে, বিশ্বাস করে যে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান তাদের জীবনে পরিবর্তন আনবে। কিন্তু বিজ্ঞানের চোখে, জ্যোতিষশাস্ত্র কি সত্যিই কোনো গ্রহণযোগ্য বিষয়, নাকি এটি নিছক কসমিক প্রতারণা?

রাশিফলের জনপ্রিয়তার রহস্য

মানুষ স্বভাবগতভাবে অনিশ্চয়তাকে পছন্দ করে না। জীবনে কী ঘটবে, সফলতা আসবে কি না, এসব জানার জন্যই মানুষ ভবিষ্যদ্বাণীর প্রতি আকৃষ্ট হয়। জ্যোতিষীরা মানুষের এই দুর্বলতার সুযোগ নেয়।

মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, “বার্নাম এফেক্ট” (Barnum Effect) নামে এক ধরনের মানসিক প্রবণতা আছে, যেখানে মানুষ সাধারণভাবে প্রযোজ্য বক্তব্যকে নিজের জীবনের জন্য বিশেষভাবে সত্য মনে করে। উদাহরণস্বরূপ, “আপনি একজন সৃজনশীল ব্যক্তি, তবে মাঝে মাঝে আত্মবিশ্বাসের অভাব অনুভব করেন”— এই কথাটি প্রায় সবাই নিজের জীবনের সঙ্গে মেলাতে পারবে। জ্যোতিষশাস্ত্র এই কৌশলটাই ব্যবহার করে।

বিশ্বখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী কার্ল সাগান একবার বলেছিলেন,

“জ্যোতিষশাস্ত্র আসলে মানুষের কৌতূহল এবং অনিশ্চয়তাকে কাজে লাগিয়ে তৈরি একটি ব্যবসা।”

এখন প্রশ্ন হলো, যদি এটি মিথ্যা হয়, তবে কেন যুগ যুগ ধরে মানুষ এটিতে বিশ্বাস করে আসছে?


বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে জ্যোতিষশাস্ত্র

বাস্তব বিজ্ঞানে প্রতিটি তত্ত্ব পরীক্ষিত হতে হয়। জ্যোতিষশাস্ত্রের কোনো ভবিষ্যদ্বাণী নিয়মিতভাবে সফল হয় না। ১৯৮৫ সালে শৌন ও বারেন্স নামে দুই গবেষক ২০০০ মানুষের জীবন ও গ্রহের অবস্থানের তুলনা করে দেখেন যে, কোনো ধরনের মিল নেই।

একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০০৫ সালে ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের গবেষণায় উঠে আসে যে, ৪২% আমেরিকান বিশ্বাস করে যে জ্যোতিষশাস্ত্র বিজ্ঞানসম্মত!

নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান বলেছিলেন,

“বিজ্ঞান সত্যকে খোঁজার একটি প্রক্রিয়া, আর জ্যোতিষশাস্ত্র সত্যের বিকৃত প্রতিরূপ।”

কেন এটি বিজ্ঞান নয়?

প্রথমত, বিজ্ঞান নির্ভর করে পরীক্ষা এবং পুনরাবৃত্তির ওপর। জ্যোতিষশাস্ত্রের ভবিষ্যদ্বাণী বারবার সত্য প্রমাণিত হয় না। দ্বিতীয়ত, বিজ্ঞানে কোনো কিছু প্রমাণের জন্য কারণ ও প্রভাবের সম্পর্ক থাকতে হয়। গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে কীভাবে প্রভাব ফেলে, তা প্রমাণের জন্য কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই। তৃতীয়ত, একাধিক জ্যোতিষী একই ব্যক্তির জন্য ভিন্ন রাশিফল দেন, যা বৈজ্ঞানিকভাবে অসম্ভব।

তাহলে প্রশ্ন হল, মানুষ কেন এখনো বিশ্বাস করে? সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, এটি বিশ্বাস ও সংস্কৃতির মিশ্রণ। মানুষ ভাগ্যে বিশ্বাস করতে ভালোবাসে, কারণ এতে নিজের জীবন সম্পর্কে দায়িত্ব কম মনে হয়।

বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞান লেখক নীল ডিগ্রাস টাইসন বলেন,

“যদি রাশিফল সত্য হতো, তবে সকল মকর রাশির লোক একই দিনে চাকরি পেত, এবং একই দিনে চাকরি হারাত।”

তবে এমনকি শিক্ষিত মানুষও কেন জ্যোতিষশাস্ত্রে বিশ্বাস করে? মনোবিজ্ঞানী ড্যানিয়েল কানেম্যান বলেন,

“মানুষ যুক্তির চেয়ে আবেগ দ্বারা চালিত হয়।”


পরিশেষে বলবো, কসমিক প্রতারণা থেকে বের হওয়া জরুরি। বিজ্ঞানের যুগে দাঁড়িয়ে, কুসংস্কার আর জ্যোতিষশাস্ত্রে বিশ্বাস করা কতটা যুক্তিযুক্ত? ব্যক্তি বিশেষের বিশ্বাস থাকতেই পারে, কিন্তু বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে। একজন তরুণ শিক্ষার্থী হিসেবে সাদিক যেমন বলেছিল, “আমার ভবিষ্যৎ আমি নিজেই গড়বো, নক্ষত্র নয়!” আমাদেরও উচিত বাস্তবতা বোঝা, কারণ সত্যিকার পরিবর্তন আসে পরিশ্রম ও বিজ্ঞান-ভিত্তিক চিন্তাধারা থেকে, গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান থেকে নয়। তথ্য যাচাই করুন, কুসংস্কার থেকে বেরিয়ে আসুন।

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

Related Articles
উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার সুযোগবিজ্ঞান বিষয়ক খবর

গবেষণার গল্প যখন সংবাদ শিরোনাম: বিজ্ঞানীদের জন্য সাংবাদিকদের কাছে পিচ করার কৌশল

আপনার গবেষণাকে শিরোনাম করতে চান? বিজ্ঞানীরা কীভাবে তাদের আবিষ্কারগুলি সাংবাদিকদের কাছে কার্যকরভাবে...

গবেষণায় হাতে খড়িবিজ্ঞান বিষয়ক খবর

বৈজ্ঞানীদের কেলেঙ্কারি: যখন বিজ্ঞানীরা মিথ্যা বলেছিলেন

বিশ্বকে নাড়িয়ে দেওয়া চমকপ্রদ বৈজ্ঞানিক জালিয়াতি আবিষ্কার করুন! পিল্টডাউন ম্যান প্রতারণা থেকে...

সাধারণ বিজ্ঞানস্বাস্থ্য ও পরিবেশ

খাদ্য বিজ্ঞানের নামে প্রতারণা: অর্গানিক সুপারফুড ও ডিটক্স কতটা বিজ্ঞানসম্মত?

জৈব খাবার কি সত্যিই স্বাস্থ্যকর? সুপারফুড কি প্রচারের যোগ্য? ডিটক্স ডায়েট কি...

গল্পে গল্পে বিজ্ঞানসাধারণ বিজ্ঞান

আপনি বিজ্ঞানী কিনা বুঝবেন কীভাবে?

আপনার কি একজন বিজ্ঞানীর বৈশিষ্ট্য আছে? ৫টি মজার এবং আশ্চর্যজনক লক্ষণ আবিষ্কার...

গবেষণায় হাতে খড়িবিজ্ঞান বিষয়ক খবর

বাংলাদেশের তরুণ বিজ্ঞানীদের সাফল্যের গল্প: AIUB-এর গবেষণা দলের অনন্য অর্জন

AIUB-এর UCH গবেষণা গ্রুপ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে, IEEE চতুর্থ...

Three Columns Layout

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact

biggani.org❤️gmail.com

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

বিজ্ঞানী অর্গ (biggani.org) বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে গবেষণা ও বিজ্ঞান নিয়ে বাংলা ভাষায় তথ্য ও সাক্ষাৎকার প্রচার করে – নবীনদের গবেষণা ও উচ্চশিক্ষায় প্রেরণা দেয়া হয়।

যোগাযোগ:

biggani.org@জিমেইল.com

biggani.org, a community of Bangladeshi scientists, shares interviews and information about researchers and scientists in Bengali to inspire young people in research and higher education.