মুহাম্মদ জিয়াউল হক | এপ্রিল ১, ২০২৫ | বিশেষ প্রতিবেদন
গল্পের শুরু: এক সাংবাদিকের দুঃস্বপ্ন
ঢাকার এক ব্যস্ত বিকেলে শাহেদ আহমেদ, একজন প্রবীণ সাংবাদিক, তার ডেস্কে বসে আছেন। অফিসের বাতি এখনো জ্বলছে, কিন্তু newsroom-এর সেই সরগরম আমেজ আর নেই। একসময় এখানে ফোনকল, টেলিপ্রিন্টার আর সহকর্মীদের কলরবে মুখরিত পরিবেশ ছিল, এখন তালা ঝোলার উপক্রম। বিজ্ঞাপনদাতারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, পাঠকরাও আর আগের মতো সাইটে ঢুঁ মারেন না।
“আমাদের লেখা পাঠক পড়ছে ঠিকই, কিন্তু আমাদের সাইটে এসে নয়,” হতাশ ভঙ্গিতে বললেন শাহেদ। “সবার উত্তরই এখন চ্যাটবট থেকে পাওয়া যায়। আমাদের আর প্রয়োজন ফুরিয়েছে বলে মনে হচ্ছে।”
তার কথায় ফুটে উঠেছে সাংবাদিকতার সামগ্রিক দুর্দশা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) নির্ভর চ্যাটবটগুলোর কারণে এখন বহু সংবাদমাধ্যমের ওয়েবসাইটের পাঠকসংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমছে।
গুগল, ওপেনএআই, ও পর্দার আড়ালের লড়াই
সম্প্রতি TollBit নামের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, AI চ্যাটবটগুলো সংবাদমাধ্যমগুলোর ওয়েবসাইটে ট্রাফিক ৯৬% পর্যন্ত কমিয়ে দিয়েছে। তারা ১৬০টি নিউজ ও ব্লগিং প্রকাশকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেছে—২০২৪ সালের শেষ প্রান্তিকে এই চ্যাটবটগুলো মোট প্রায় ২০ লক্ষবার (২ মিলিয়ন) ওই সব ওয়েবসাইট ‘স্ক্র্যাপ’ করেছে, এবং প্রতিটি পৃষ্ঠা গড়ে সাতবার করে স্ক্র্যাপ করা হয়েছে। কিন্তু এই স্ক্র্যাপগুলো থেকে কোনো বিজ্ঞাপন-আয় হয় না, কারণ বট ক্লিকের মাধ্যমে রাজস্ব আসে না।
“TollBit-এর হিসেবে, আমরা এখন এমন পরিস্থিতিতে আছি যেখানে চ্যাটবটগুলো সংবাদের আসল উৎস থেকে তথ্য নিচ্ছে, কিন্তু পাঠকদের সেই উৎসে ফেরত পাঠাচ্ছে না,” বললেন TollBit-এর CEO তোশিত পানিগ্রাহী।
একই সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে Chegg, যারা গুগলের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। Chegg-এর CEO নাথান শুল্টজ বলেছেন,
“গুগলের AI Overview-এর কারণে আমাদের সাইটে আসার ট্রাফিক বিপুলভাবে কমে গেছে। পাঠকরা এখন গুগল থেকেই সরাসরি উত্তর পেয়ে যায়। আমাদের ব্যবসা কার্যত ধ্বংসের মুখে।”
সত্যি বলতে, শুধু Chegg নয়, বিশ্বের বহু বড় সংবাদমাধ্যমই এই সংকটে পড়েছে। কারণ, চ্যাটবটগুলো যখন সংবাদ বা গবেষণার তথ্য সংগ্রহ করে, তখন তারা সেটিকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে সাজিয়ে উপস্থাপন করে। পাঠকদের মূল ওয়েবসাইটে যাওয়ার দরকার পড়ে না। ফলাফল—একের পর এক পোর্টাল আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছে।
সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎ: আলোর পথ নাকি অন্ধকার?
এআই কি সাংবাদিকতার জন্য পুরোপুরি হুমকি, নাকি এখানে নতুন কোনো সম্ভাবনা আছে?
কিছু গবেষক মনে করেন, সংবাদমাধ্যমগুলোর উচিত প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া। উদাহরণস্বরূপ, এআইকে টুল হিসেবে ব্যবহার করে দ্রুত ও নির্ভুল খসড়া তৈরি, নতুন ধরণের সাবস্ক্রিপশন বা সদস্যপদ মডেল, পে-ওয়াল পদ্ধতি ইত্যাদি ব্যবহার করে বট ট্রাফিক রোধ করা যেতে পারে। এ ছাড়া কনটেন্ট লাইসেন্সিং বা রয়্যালটি নীতিমালা কার্যকর করে এআই কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা আদায় করা সম্ভব হতে পারে।
কিন্তু প্রবীণ সাংবাদিক রবার্ট ম্যাক্সওয়েল বলেন,
“এটা একটি অসম লড়াই। বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো সংবাদমাধ্যমের কাছ থেকে তথ্য নিচ্ছে, কিন্তু বিনিময়ে কিছুই দিচ্ছে না।”
সাংবাদিকতার অন্যতম প্রধান নীতি হলো তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করা। কিন্তু চ্যাটবটগুলোর সমস্যা হলো, তারা যে তথ্য দেয় তার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য পাঠকদের কোথাও পাঠায় না। এতে ভুল তথ্য বা আধা-সত্যের প্রসার বৃদ্ধি পেতে পারে।
আরও কিছু দৃষ্টিভঙ্গি: প্রকাশক ও পাঠক
এদিকে স্থানীয় একটি পত্রিকার সম্পাদক সায়মা খান বলেছেন,
“আমরা ইতিমধ্যে তিনজন স্টাফ ছাঁটাই করেছি। মজার ব্যাপার হলো, আমাদের কনটেন্ট চ্যাটবটের মাধ্যমে আরও বেশিসংখ্যক মানুষ দেখতে পাচ্ছে, কিন্তু বিজ্ঞাপনী রাজস্ব আমাদের খাতায় আর যোগ হচ্ছে না।“
পাঠক হিসেবে আমরা কি হারাচ্ছি? বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী রাহাত ইসলাম বললেন,
“আগে আমি নিউজ পোর্টালেই বিস্তারিত পড়তাম। এখন গুগলেই উত্তর পেয়ে যাই, কোর্টসি চ্যাটবট। কিন্তু এ তথ্য কতটুকু নির্ভরযোগ্য, তা বুঝে উঠতে পারি না।”
ফলাফল—সংবাদমাধ্যমগুলো শুধু ব্যবসায়িক ক্ষতির মুখে নয়, তারা ধীরে ধীরে জনসাধারণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের উৎস হিসেবেও তাদের অবস্থান হারাচ্ছে।
সম্ভাব্য সমাধান: হাতে হাত মিলিয়ে পথচলা
১. টেক কোম্পানির সঙ্গে অংশীদারিত্ব: সংবাদমাধ্যমগুলো এআই কোম্পানির সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কনটেন্ট শেয়ারিং মডেল তৈরি করতে পারে। লিঙ্কবেসড রেফারেল, রেভিনিউ শেয়ার, কিংবা বিশেষ সাবস্ক্রিপশন প্যাকেজ এসব কিছুর সম্ভাবনা রয়েছে।
২. নতুন ধরনের কনটেন্ট মডেল: পাঠকদেরকে আরো ইন্টারঅ্যাক্টিভ বা মাল্টিমিডিয়া কনটেন্ট দেওয়া, যেগুলো চ্যাটবট সহজে রিপ্রোডিউস করতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ, লাইভ ব্লগ, ভিডিওর সাথে যুক্ত প্রশ্ন-উত্তর সেশন ইত্যাদি।
৩. আইনি ও নীতিমালা সংস্কার: কপিরাইট ও ফেয়ার ইউজ নীতিমালার উন্নতি করে এআই কোম্পানিগুলোকে আরও দায়বদ্ধ করার উপায় খুঁজতে হবে।
৪. বিশ্বস্ততা তৈরিতে জোর: পাঠকদের মাঝে বিশ্বস্ততা গড়ে তোলা, যাতে তারা মূল উৎসে ফিরে আসতে উত্সাহিত হয়। বিশদ বিশ্লেষণ, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর গভীর অনুসন্ধান—যা কেবল মানুষ-চালিত সাংবাদিকতায় সম্ভব।
উপসংহার: নতুন চ্যালেঞ্জ, নতুন পথ
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অগ্রযাত্রা থামবে না, বরং এটি আরও শক্তিশালী হবে। কিন্তু সাংবাদিকতার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ পেশাকে রক্ষা করতে হলে, এআই কোম্পানিগুলোকে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে ন্যায্যভাবে কাজ করতে হবে।
“এটি শুধু সাংবাদিকতার সমস্যা নয়, গণতন্ত্র ও সত্যের প্রশ্ন,” বললেন সাংবাদিক শাহেদ আহমেদ। “আমরা কি প্রযুক্তিকে আমাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারব, নাকি প্রযুক্তিই আমাদের গ্রাস করবে?”
শাহেদের মতো অনেকেই এখন সন্ধান করছেন সেই উত্তরণের পথ। পাঠকদের মধ্যেও এক ধরনের দ্বিধা—সহজে উত্তর পেয়ে গেলেও, সেটির সত্যতা বা গভীরতা কতটা নিশ্চিত?
আপনার মতামত দিন:
সাংবাদিকতা কি এআই-এর সঙ্গে টিকে থাকতে পারবে, নাকি হারিয়ে যাবে প্রযুক্তির ছায়ায়?
Leave a comment