ড. এম ইন্নাস আলী (১৯১৬–২০১০) ছিলেন বাংলাদেশের পরমাণু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিকাশের অগ্রপথিক ব্যক্তিত্ব। তিনি এমন এক যুগে কাজ করেছিলেন, যখন বাংলাদেশে উন্নত গবেষণাগার, পর্যাপ্ত অর্থায়ন, ও পর্যাপ্ত মানবসম্পদ ছিল সীমিত। তবুও অদম্য মনোবল এবং দূরদৃষ্টি নিয়ে তিনি পরমাণু শক্তিকে শান্তিপূর্ণভাবে কাজে লাগিয়ে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখার চেষ্টা করেছেন। আন্তর্জাতিক মানের জ্ঞান এবং স্থানীয় বাস্তবতার মেলবন্ধন ঘটিয়ে তিনি গবেষণা, শিক্ষা ও নীতি-প্রণয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশে পরমাণু বিজ্ঞানের ভিত স্থাপন করেন।
প্রাথমিক জীবন ও শিক্ষা
এম ইন্নাস আলীর জন্ম বর্তমান বাংলাদেশের ভূখণ্ডে। শৈশব থেকেই তিনি বিজ্ঞানের প্রতি অনুরাগী ছিলেন এবং উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে গমন করেন। সেখান থেকে পরমাণু পদার্থবিজ্ঞানে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অর্জিত জ্ঞান ও দক্ষতা নিয়েই তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং দেশের বিজ্ঞানচর্চার মান উন্নয়নে আত্মনিয়োগ করেন।
পরমাণু গবেষণা ও প্রতিষ্ঠানের বিকাশ
স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে বাংলাদেশ পরমাণু প্রযুক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার এবং এর মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়নের সম্ভাবনা খুঁজছিল। এম ইন্নাস আলী এই প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তিনি বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন (BAEC)-এর বিকাশে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন, যা পরমাণু গবেষণা, প্রযুক্তি স্থানান্তর, এবং বিভিন্ন খাতে পরমাণু শক্তির ব্যবহার বিস্তারে মূল প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়ায়।
এখানে চিকিৎসা, কৃষি, শিল্প এবং পরিবেশ সংরক্ষণে পরমাণু প্রযুক্তির প্রয়োগের পথ উন্মোচন হয়। নিউক্লিয়ার মেডিসিন, কৃষিপণ্য সংরক্ষণে রেডিয়েশন প্রযুক্তি, এবং শিল্পে গুণগত মান নিয়ন্ত্রণের জন্য পরমাণু পদ্ধতির ব্যবহার বাংলাদেশকে বৈজ্ঞানিকভাবে এক ধাপ এগিয়ে দেয়। এম ইন্নাস আলীর পরিকল্পনা ও দিকনির্দেশনার ফলে পরমাণু গবেষণা শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে ওঠে, যার সুফল আজও বাংলাদেশ ভোগ করছে।
শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন
ড. এম ইন্নাস আলী বুঝতেন, পরমাণু প্রযুক্তির সুফল লাভ করতে হলে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি অপরিহার্য। তিনি নতুন প্রজন্মের বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, প্রযুক্তিবিদ এবং গবেষক তৈরিতে উদ্বুদ্ধ হন। বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মাধ্যমে তিনি ছাত্রছাত্রীদের নিউক্লিয়ার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে দক্ষ করে তোলার চেষ্টা করেন। এর ফলে দেশীয় গবেষক ও প্রযুক্তিবিদরা আন্তর্জাতিক মানের কাজ করে বিদেশি নির্ভরতা কমাতে সক্ষম হন।
নীতিমালা, নিরাপত্তা ও নৈতিকতার প্রশ্ন
পরমাণু শক্তি সংবেদনশীল এবং এর ব্যবহার সঠিক নিয়ন্ত্রণ ও নৈতিকতা ছাড়া বিপজ্জনক হতে পারে। এম ইন্নাস আলী পরমাণু শক্তির নিরাপদ ও দায়িত্বশীল ব্যবহারে জোর দেন। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ও নিরাপত্তার নিয়ম মেনে পরমাণু প্রযুক্তি যেন শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়, সেদিকে তিনি সর্বদা লক্ষ্য রেখেছিলেন। এর ফলে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি ব্যবহারে একটি দায়িত্বশীল অবস্থান নিতে পেরেছে, যা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের সুনাম বাড়িয়েছে।
আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও উদ্ভাবন
তিনি আন্তর্জাতিক গবেষণা নেটওয়ার্ক ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে উদ্যোগী ছিলেন। এই মাধ্যমে স্থানীয় গবেষকরা বিদেশি বিশেষজ্ঞ ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করে মূল্যবান অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন, যা পরবর্তীতে দেশের নিজস্ব গবেষণা সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করেছে। স্থানীয় সম্পদ ও সমস্যার ওপর ভিত্তি করে উদ্ভাবন ও পণ্য উন্নয়নে তিনি গবেষকদের উৎসাহ দিতেন। এভাবে বৈদেশিক প্রযুক্তি নির্ভরতা কমিয়ে দেশীয় প্রযুক্তি উন্নয়নের পথ উন্মুক্ত হয়।
সমাজে প্রভাব ও উত্তরাধিকার
পরমাণু প্রযুক্তির গবেষণা ও প্রয়োগ কেবল গবেষণাগারে সীমাবদ্ধ থাকেনি; এর প্রভাব সমাজের গভীরে পৌঁছেছে। খাদ্যসংরক্ষণ, চিকিৎসা, শিল্প, ও শক্তি উৎপাদন খাতে পরমাণু প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়েছে। এম ইন্নাস আলীর সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত ও দিকনির্দেশনা এ ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে। তার দেখানো পথ ধরে বাংলাদেশে নিউক্লিয়ার শক্তির ব্যবহার টেকসই উন্নয়নের গতি বাড়িয়েছে।
আজ যখন বাংলাদেশ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন এম ইন্নাস আলীর রেখে যাওয়া পরিকাঠামো ও মানসিক প্রস্তুতি বিশাল ভূমিকা রাখছে। তাঁর অবদান ছাড়া আজকের এই অগ্রগতি হয়তো এত সহজে সম্ভব হতো না।
উপসংহার
ড. এম ইন্নাস আলী ছিলেন বাংলাদেশের পরমাণু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিকাশের এক প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব। তিনি গবেষণা, শিক্ষা, নীতিগত কাঠামো গড়ে তুলে এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতকে অগ্রসর করেছিলেন। আজকের বাংলাদেশে পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার, দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি, এবং আন্তর্জাতিক মানের গবেষণার যে ধারা গড়ে উঠেছে, তাতে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তিনি আমাদের মনে করিয়ে দেন যে সঠিক দিকনির্দেশনা, দায়িত্বশীল ব্যবহারের মানসিকতা, এবং নবউদ্যমী গবেষণা উদ্যোগের মাধ্যমে বিজ্ঞান হতে পারে জাতীয় উন্নয়নের মাইলফলক।
Leave a comment