গবেষণা জগতে আর্টিকেল রিট্রাকশন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা ঘটে যখন কোনো গবেষণা আর্টিকেল প্রকাশিত হওয়ার পর তা গুরুতর ত্রুটি, তথ্য বিভ্রাট, প্লেজিয়ারিজম বা জালিয়াতির কারণে আনুষ্ঠানিকভাবে বাতিল করা হয়। সাধারণত, এটি তখনই ঘটে যখন গবেষণা ফলাফল ভুল প্রমাণিত হয় বা নৈতিকতার লঙ্ঘন ঘটে। রিট্র্যাকশন প্রক্রিয়া গবেষকদের সততার প্রতি গুরুত্বারোপ করে এবং ভবিষ্যতের গবেষণায় সতর্কতা আনে। এই প্রবন্ধে আজিজুল হক কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা বলেছেন। এই প্রবন্ধটি পড়লে আপনি ভবিষ্যতের পথে প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন করতে পারবেন এবং নিজের গবেষণা ও শিক্ষাগত লক্ষ্যসমূহকে সঠিকভাবে গঠন করতে সক্ষম হবেন।
আর্টিকেল রিট্রাকশন কী?
গবেষণা জগতে আর্টিকেল প্রত্যাহার বা রিট্রাকশন (Retraction) একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর বিষয়। আর্টিকেল রিট্রাকশন বলতে কোনো গবেষণা আর্টিকেল প্রকাশিত হওয়ার পর তা জার্নাল কর্তৃপক্ষের দ্বারা আনুষ্ঠানিকভাবে বাতিল বা অপসারণ করা বোঝায়। সাধারণত, একটি আর্টিকেল প্রত্যাহার করা হয় যখন গবেষণার মধ্যে গুরুতর ত্রুটি, তথ্য বিভ্রাট, চুরি (প্লেজিয়ারিজম), কিংবা জালিয়াতি বা প্রতারণামূলক আচরণ (যেমন, মিথ্যা পিয়ার রিভিউ) প্রমাণিত হয়। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট আর্টিকেলটি আর বৈধ বা বিশ্বাসযোগ্য হিসেবে গণ্য হয় না। Nature-এর একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে ২০২৩ সালে গবেষণা আর্টিকেল প্রত্যাহারের সংখ্যা ১০,০০০ ছাড়িয়ে গেছে। গত দুই দশকে সৌদি আরব, পাকিস্তান, রাশিয়া এবং চীনে প্রত্যাহারের হার ছিল সবচেয়ে বেশি। ২০২৩ সালের প্রত্যাহারের প্রায় সবগুলোই লন্ডনভিত্তিক প্রকাশক Wiley-এর সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিন্দাউই-এর মালিকানাধীন জার্নাল থেকে হয়েছে। এ বছর এখন পর্যন্ত হিন্দাউই জার্নালগুলো ৮,০০০ এরও বেশি আর্টিকেল প্রত্যাহার করেছে। প্রত্যাহারের প্রধান কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, “পিয়ার-রিভিউ প্রক্রিয়া আপসের সম্মুখীন হয়েছে” এবং “প্রকাশনা ও পিয়ার-রিভিউ প্রক্রিয়ার পদ্ধতিগত কারসাজি”।
আর্টিকেল প্রত্যাহারের কারণ:
আর্টিকেল প্রত্যাহারের প্রধান দুটি কারণ হলো — সৎ উদ্দেশ্য এবং অসৎ উদ্দেশ্য। যখন গবেষক সৎ উদ্দেশ্যে গবেষণা পরিচালনা করেন, কিন্তু গবেষণার ফলাফল বা উপসংহার ভুল হয়, তখন তিনি নিজেই আর্টিকেল প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এই ধরনের প্রত্যাহারকে সাধারণত “স্বেচ্ছায় প্রত্যাহার” বলা হয়, যা একাডেমিক জগতে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয় এবং গবেষকের সততা নির্দেশ করে। অন্যদিকে, যদি গবেষণায় অসততার প্রমাণ পাওয়া যায়, যেমন — মিথ্যা তথ্য প্রদান, তথ্য চুরি, অন্যের নামে প্রকাশ, একাধিকবার একই আর্টিকেল জমা দেওয়ার চেষ্টা, অথবা নৈতিকতা লঙ্ঘন, তাহলে জার্নালের সম্পাদকীয় বোর্ড আর্টিকেল প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে গবেষকের ক্যারিয়ার, অর্থায়ন, এবং ভবিষ্যত প্রতিষ্ঠার উপর গুরুতর প্রভাব পড়ে।
আর্টিকেল প্রত্যাহারের প্রভাব:
একটি আর্টিকেল প্রত্যাহার হওয়া মানে কেবলমাত্র সেই গবেষক বা সংশ্লিষ্ট গবেষণার উপর প্রভাব ফেলা নয়; বরং এর পরোক্ষ প্রভাব আরও গভীর। যেসব গবেষক সেই আর্টিকেলকে নির্ভরযোগ্য তথ্য হিসেবে ধরে তাদের গবেষণা চালিয়েছেন বা চিকিৎসার ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন, তাদের কাজও ঝুঁকির মুখে পড়ে। একটি রিট্র্যাক্টেড আর্টিকেলকে ভিত্তি করে নতুন গবেষণা পরিচালিত হলে, সেই গবেষণার ফলাফলেও ভুল হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। বিশেষত, রেফারেন্স বা সাইটেশনের (citation) ক্ষেত্রে রিট্র্যাক্টেড আর্টিকেলগুলো এড়িয়ে চলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ভুল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে নতুন গবেষণা করলে তা ভবিষ্যতে আরও বিভ্রান্তিকর তথ্য তৈরি করতে পারে। এই কারণে, প্রত্যাহারকৃত আর্টিকেলগুলো সম্পর্কে গবেষকদের সতর্ক থাকা উচিত। আর্টিকেল প্রত্যাহার শুধুমাত্র নির্দিষ্ট একটি গবেষণাকে নয়, পুরো গবেষণা ক্ষেত্রকেই নাড়িয়ে দেয়, যা সংশ্লিষ্ট জ্ঞান ও বিশ্বাসের ওপর আঘাত হানে। এর ফলে আস্থা সংকট সৃষ্টি হতে পারে এবং নতুন গবেষণার জন্য অতিরিক্ত সময় ও সম্পদের অপচয় ঘটে।
আর্টিকেল প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া:
আর্টিকেল প্রত্যাহার গবেষণা জগতে একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া, যা সাধারণত তখনই করা হয় যখন কোনো গবেষণাপত্রে গুরুতর ত্রুটি, তথ্য জালিয়াতি, নৈতিকতা লঙ্ঘন বা অন্য কোনো ধরণের ভুল পাওয়া যায় যা সংশোধনযোগ্য নয়। এই প্রক্রিয়াটি সাধারণত একাধিক ধাপে সম্পন্ন হয়। প্রথমে সংশ্লিষ্ট লেখকদের ইমেইলের মাধ্যমে জানানো হয় যে, তাদের আর্টিকেল নিয়ে সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে, লেখকগণ নিজেরাই এ ধরনের ত্রুটি আবিষ্কার করে জার্নালের সম্পাদককে ইমেইল করে জানিয়ে দেন। এই ধাপের পর, সম্পাদকীয় বোর্ড আনুষ্ঠানিকভাবে লেখকদের কাছে প্রত্যাহারের অনুরোধ পাঠায়, যেখানে আর্টিকেলটির ত্রুটিসমূহ বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়। আবার, লেখকগণ নিজেরাই আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পাদকীয় বোর্ডের কাছে আর্টিকেল প্রত্যাহারের জন্য অনুরোধ করতে পারেন। বৃহৎ প্রকাশনা সংস্থা যেমন Elsevier, Springer, বা Wiley সাধারণত প্রত্যাহারের জন্য একটি ‘Retraction Notice’ প্রকাশ করে, যা মূল আর্টিকেলের লিঙ্কের সাথে যুক্ত থাকে। যদিও মূল আর্টিকেলটি অনলাইনে পাওয়া যায়, তবুও সেটিতে একটি “Retracted” মার্ক দেওয়া থাকে এবং HTML ভার্সনটি প্রায়শই সরিয়ে নেওয়া হয়। এর মাধ্যমে, প্রত্যাহারিত আর্টিকেল স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয় যাতে পাঠকরা সহজেই বুঝতে পারেন যে আর্টিকেলটির তথ্য এবং ফলাফল আর গ্রহণযোগ্য নয়। এই প্রক্রিয়া গবেষণা কমিউনিটিকে সতর্ক থাকতে সাহায্য করে এবং বৈজ্ঞানিক প্রকাশনার মান বজায় রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এটি একদিকে যেমন গবেষণার স্বচ্ছতা ও সততার প্রতি গুরুত্বারোপ করে, অন্যদিকে ভবিষ্যতের গবেষকদের জন্য সতর্কতা হিসাবে কাজ করে।
বিজ্ঞানী ডট অর্গ এর পক্ষ থেকে আমরা আজিজুল হককে তার প্রেরণাদায়ক ও গঠনমূলক আলোচনা জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। তার বার্তা তরুণ গবেষকদের জন্য বিজ্ঞানমনস্কতা, সৃজনশীলতা এবং অধ্যবসায়ের গুরুত্ব সম্পর্কে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করবে। এই মূল্যবান বক্তব্য তাদের একটি টেকসই ও সফল বৈজ্ঞানিক ক্যারিয়ার গঠনে সহায়ক হবে এবং ভবিষ্যতের গবেষণা ক্ষেত্রকে আরও সমৃদ্ধ করবে।
Leave a comment