[১৮৭১-১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দ]
বিজ্ঞানের বিষয়গুলো অনেকের কাছে
যথেষ্ট আগ্রহের। বিজ্ঞান আমাদের নতুন কিছু জানতে শেখায়। এমন একজন ব্যক্তিত্ব রয়েছেন
যাঁর ছোটবেলা থেকে বিভিন্ন ভাষা শিক্ষা ছাড়া বিজ্ঞানের বিষয়গুলো অন্যতম আকর্ষণ ছিল। তিনি
হচ্ছে আর্নেস্ট রাদারফোর্ড, বিজ্ঞানের জগতে এক অবিস্মরণীয় নাম। ‘রেডিও ওয়েভ ডিটেক্টর’ – এর আবিষ্কারক হিসেবে তিনি আমাদের
মাঝে চিরদিন স্মরণীয় হয়ে আছেন। তিনি পদার্থবিদ্যায় তাঁর অসাধারণ কৃতিত্বের জন্যে ১৯০৮ সালে
নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন।
অন্যতম অবদানসমূহ ঃ
১. আয়নের চরিত্র নির্ভুল পরিমাপ।
২. তেজস্ক্রিয় রশ্মি ‘আলফা’ এবং ‘বিটা’র আবিষ্কার।
‘৩. আর্টিফিসিয়াল
রেডিও অ্যাকটিভ রিয়্যাকশন’-এর জনক।
৪. যে কোনো
মৌলের পরমাণুর ভেতরটা খুবই ফাঁকা। শুধু মধ্যিখানে একটা খুব ছোট জায়গায় বড্ডো বেশি ধনাত্মক আধান
নিয়ে বসে রয়েছে কেউ।
পদার্থবিজ্ঞানী আর্নেস্ট রাদারফোর্ড
জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৮৭১ সালের ৩০ আগস্ট। পিতার নাম জেমস রাদারফোর্ড। আর মাতার
নাম মার্থা থম্পসন। পিতা জেমস রাদারফোর্ড ছিলেন একজন স্কটিশ। অন্যদিকে
মা ছিলেন একজন ইংরেজ।
ছোটবেলা থেকে আর্নেস্ট পড়াশোনায়
অধিক মনোযোগী ছিলেন। মাত্র পনেরো বছর বয়সে একটা বৃত্তি পরীক্ষায় তিনি এত বেশি
b¤^i পেলেন যে, আগের সব রেকর্ড-এর অবসান হলো। তিনি পড়তেন নেলসন কলেজে। তিন বছর
পর পাশ করে বের হলেন।
নেলসন কলেজ থেকে পাশ করে তিনি
চলে এলেন বিখ্যাত ক্যান্টারবেরি কলেজে। এখানে ১৮৮৯ থেকে ১৮৯৪ পর্যন্ত
ছ’বছর পড়াশোনা করেছিলেন। ১৮৯৩
সালে তিনি বি.এ ডিগ্রি আর ১৮৯৪ সালে এম.এ ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। গণিত
আর পদার্থবিদ্যা তখন তাঁর দখলে। এক সময় পদার্থবিদ্যায় অধিক মনোযোগী হলেন। কলেজের
শেষ বছরে তিনি রেডিও তরঙ্গ চিনবার ডিটেক্টর আবিষ্কার করেন। বিনা তারে তরঙ্গ পাঠানোতে মার্কনীর
কৃতিত্বের কথা বিজ্ঞানের ইতিহাসে লেখা আছে। অথচ ঐ বছরে আর্নেস্ট রাদারফোর্ড
আবিষ্কার করেছিলেন এই ‘রেডিও
ওয়েভ ডিটেক্টর’।
আর এই কাজে সুনামের সুবাদে কেমব্রিজে
গবেষণা করার একটা স্কলারশিপ পেতে তাঁর তেমন কোনো অসুবিধে হয় নি। বিখ্যাত
বিজ্ঞানী জে.জে. থমসনের সহিত কাজ করবার অভিজ্ঞতা তাঁর নিকট একটি বিরাট সুযোগ। যদিও
থমসন তখন ‘ইলেকট্রন আবিষ্কারক’ হিসেবে পরিচিতি পান নি। রাদারফোর্ড ছিলেন থমসনের প্রথম ছাত্র। থমসন
তাঁর ছাত্রকে এক্স-রশ্মি দিয়ে গ্যাস থেকে আয়ন তৈরি করে সেই আয়নগুলোর ধর্ম পর্যবেক্ষণের
জন্যে গবেষণাগারে প্রচুর কাজ করার পরামর্শ দিলেন।
গবেষণাগারে যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম
দেখে আর্নেস্ট রাদারফোর্ড তো ভীষণ খুশি। ইলেকট্রোমিটার, এক্স-রে টিউব, সমান্তরাল পাত কন্ডেন্সার, বিদ্যুৎ তৈরির ছোট ছোট নানা ধরনের যন্ত্র। গবেষণাগারে
মগ্ন হয়ে পড়লেন তিনি। আয়নের চরিত্র পরিমাপে সক্ষম হলেন। বিজ্ঞানী থমসন অভিমত ব্যক্ত
করলেন, আয়নের চরিত্র নির্ভুল পরিমাপের কাজে তাঁর নিজের চেয়েও রাদারফোর্ডের অবদান বেশি।
হেনরি বেকারেলের তেজস্ক্রিয়তা
আবিষ্কার সারা দুনিয়াকে অবাক করে দিয়েছে। সে ১৮৯৬ সালের ঘটনা। এই কাজে
রাদারফোর্ড পর্যবেক্ষণ করলেন, ইউরেনিয়াম থেকে যে তেজস্ক্রিয় রশ্মি বেরোয় তাকে দিয়েই গ্যাস
আয়নিত করা যায়। তাঁর মাথায় প্রশ্ন এলো, এই তেজস্ক্রিয় রশ্মির চরিত্রটা তবে কী? তিনি এই কাজে ওঠে পড়ে লাগলেন। বিশ্লেষণ করলেন, তেজস্ক্রিয় রশ্মিতে অন্তত দু-রকমের রশ্মি
রয়েছেই। একটা রশ্মির আয়নিত করার ক্ষমতা বেশি কিন্তু সহজে শোষিত হয়ে যায়। অন্য
রশ্মির আয়নিত করার ক্ষমতা কম কিন্তু সহজে শোষিত হয় না। তিনি এই রশ্মি দুটোর নাম দিলেন
‘আলফা’ এবং ‘বিটা’। বিজ্ঞানী
আর্নেস্ট রাদারফোর্ড এই কাজটি ১৮৯৮ সালে সম্পন্ন করেছিলেন।
এই বছর তিনি ডাক পেলেন মন্ট্রিল
ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। মাত্র সাতাশ বছর বয়সে পূর্ণ অধ্যাপকের পদ পেলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। পদার্থবিদ্যা
বিভাগে ছিল ম্যাকডোনাল্ড ফিজিক্স বিল্ডিং। যন্ত্রের প্রাচুর্যের জন্যে
এখানকার নামডাক পৃথিবী জোড়া। তামাক ব্যবসায়ী স্যার উইলিয়াম ম্যাকডোনাল্ড এই গবেষণাগারে
প্রচুর অর্থ দিচ্ছিলেন। ফলে এখানে বিজ্ঞানীরা যে যন্ত্র চাইতেন তা পেতে কখনো অসুবিধে
পেতে হয় নি। রাদারফোর্ডও এখানে গবেষণায় মগ্ন হলেন। কাজ করলেন ন’বছর। বিজ্ঞানী ফ্রেডরিক সডি, অটো হান-এঁদের সহিত কাজ করেছেন।
১৮৯৯ সালের ঘটনা। বিজ্ঞানী
রাদারফোর্ড একটা চমক লাগানো শিরোনাম দিয়ে গবেষণা পত্র বের করলেন। তা হচ্ছে
‘দি নিউয়ার অ্যালকেমি’। এক সময় অ্যালকেমিস্টরা সবকিছু
থেকেই সোনা তৈরির ব্যর্থ চেষ্টা করে গিয়েছেন। কিন্তু ঐ গবেষণা পত্রে রাদারফোর্ড
উল্লেখ করলেন, ‘থোরিয়াম অক্সাইড থেকে যে তেজস্ক্রিয়
রশ্মি বের হয় তা কোনো কিছুকে ছুঁলেই তেজস্ক্রিয় হয়ে যাচ্ছে।’ বিষয়টা এরকম তেজস্ক্রিয় রশ্মি
বেরিয়ে আসার সাথে সাথে একটা মৌল অন্য মৌলে পরিবর্তিত হচ্ছিল। পরিবর্তিত হয়ে যে নতুন মৌল তৈরি
হবে তার ‘হাফ লাইফ’ যদি বেশি হয়, তবেই মনেই হতে পারে, তৈরি হওয়া নতুন মৌলটি পূর্বেরটার চেয়ে বেশি তেজস্ক্রিয়।
ইউরেনিয়াম, থোরিয়াম এরা সবাই তেজস্ক্রিয় কণা ছাড়তে থাকে। নানা মৌলের মধ্য দিয়ে অবশেষে
শীসায় পরিণত হয়। বিজ্ঞানী ফ্রেডরিক সডি ও তিনি কাজ করলেন এক সাথে। তেজস্ক্রিয়তা কাকে বলে, বিষয়টা খোলসা করেছিলেন। এক মৌল থেকে অন্য মৌল তৈরি হয়, কথাটা তাঁরা প্রথমে বলেন নি, পরে বলেছিলেন। সডির জীবনটাও ছিল একরকম অদ্ভুত। ডেমোনস্ট্রেটার থেকে অক্সফোর্ডের
অধ্যাপক।
আলফা কণা যে হিলিয়াম পরমাণুর
নিউক্লিয়াস এই সত্যটি বের করেছিলেন বিজ্ঞানী রাদারফোর্ড। আর তিনি এই কাজে এতই অভিভূত
হয়ে পড়েছিলেন শেষের দিকে ‘আলফা’ কণা না বলে ‘মাই পার্টিকল’ বলতেন। যেন এটা তাঁর নিজস্ব সম্পদ। ১৯০৮ সাল তাঁর জীবনের জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর কারণ
নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হলেন। বক্তৃতা দিলেন নোবেল সভায়। এর শিরোনাম ছিল ‘দি কেমিক্যাল নেচার অফ দি আলফা
পার্টিকেলস ফ্রম রেডিও অ্যাকটিভ সাবস্টেনসেস’।
এর পরের বছর তিনি মন্ট্রিল ছেড়ে
ম্যানচেস্টারে চলে এলেন। মাকে লিখেছিলেন, ‘তিন হাজার মাইল দূরে থেকে গবেষণার কাজ সময়মতো প্রকাশ করতে পারি না। একই বিষয়ে
কাজ করছেন অনেকে। আগে না ছাপাতে পারলে সবটাই মাটি।’ ম্যানচেস্টারে নয় বছরে সত্তরটি গবেষণা পত্র প্রকাশ করেছিলেন।
১৯১১ সালের ঘটনা। বিজ্ঞানী
আর্নেস্ট রাদারফোর্ড ব্যক্ত করলেন এক যুগান্তকারী ও দুঃসাহসিক অভিমত তা হচ্ছে, ‘যে কোনো মৌলের পরমাণুর ভেতরটা
খুবই ফাঁকা। শুধু মধ্যিখানে একটা খুব ছোট জায়গায় বড্ডো বেশি ধনাত্মক আধান নিয়ে বসে রয়েছে কেউ।’ এটা শুধু তাঁর অভিমতই ছিল না। এর মাধ্যমে পরমাণুর গঠন কেমন তার ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়। একেবারে
মধ্যখানে ধনাত্মক নিউক্লিয়াস। ইলেকট্রন সব তার চারপাশে গোল হয়ে ঘুরছে।
ক্যাভেনডিশ অধ্যাপক জে.জে. থমসন
অবসর নিলেন। সে ১৯১৯ সালের ঘটনা। সকলে অভিমত ব্যক্ত করলেন, এই পদে যোগ্যতম ব্যক্তি আর্নেস্ট
রাদারফোর্ড। ফলে তাঁর বহুদিনের অভিমান দূরীভূত হল। কেউ নিশ্চয় তাঁকে কেমব্রিজের
ছাত্র নয় বলে আর অবজ্ঞা করবে না। তাঁর সাধনা ও পরিশ্রম সার্থক হয়েছে। কৃত্রিম তেজস্ক্রিয় বিক্রিয়া
বা ‘আর্টিফিসিয়াল রেডিও অ্যাকটিভ
রিয়্যাকশন’-এর জনক ছিলেন বিজ্ঞানী আর্নেস্ট
রাদারফোর্ড।
আর্নেস্ট রাদারফোর্ড বিজ্ঞানী
হিসেবে অভাবনীয় খ্যাতি পেয়েছিলেন। এই খ্যাতিমান বিজ্ঞানী মৃত্যুবরণ করেন ১৯৩৭ সালে। তাঁকে
কবর দেওয়া হয় বিশ্ববিখ্যাত সব বিজ্ঞানীদের কবরস্থান ওয়েস্টমিনিস্টার সমাধিস্থল ডারউইন, কেলভিন আর শিক্ষক জে.জে থমসনের পাশে।
Leave a comment