নিউজ ডেস্ক, বিজ্ঞানী অর্গ | [email protected]
১৪৭ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো, ২০২৫ সালের উইম্বলডন টেনিস টুর্নামেন্টে ঘটলো এক যুগান্তকারী পরিবর্তন—কোর্টে আর নেই কোনো মানব লাইন জাজ। তাদের জায়গা দখল করেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) দ্বারা চালিত এক স্বয়ংক্রিয় সিদ্ধান্তমূলক প্রযুক্তি, যা ক্যামেরা ও সেন্সরের মাধ্যমে বল ইন না আউট তা নির্ধারণ করে এবং সেই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে একটি রেকর্ড করা কণ্ঠে।
প্রযুক্তির এই নতুন সংযোজনের পেছনে যুক্তি স্পষ্ট—ত্রুটি কমানো, খেলার গতি বাড়ানো এবং রেফারিদের উপর মানসিক চাপ কমানো। ইউএস ওপেন এবং অস্ট্রেলিয়ান ওপেন আগেই এই পথে হেঁটেছে, এবার সেই তালিকায় যোগ দিল টেনিসের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী ও প্রাচীনতম গ্র্যান্ড স্ল্যাম, উইম্বলডন।
কেমন কাজ করে এই AI সিস্টেম?
উইম্বলডনের এই AI-চালিত হক-আই লাইভ প্রযুক্তি মূলত কোর্টজুড়ে স্থাপিত একাধিক হাই-স্পিড ক্যামেরা ও সেন্সর দিয়ে প্রতিটি বলের অবস্থান এবং গতি নিরীক্ষণ করে। এরপরে একটি স্বয়ংক্রিয় অ্যালগরিদম সেসব তথ্য বিশ্লেষণ করে বলে ইন না আউট তা ঠিক করে এবং সেই সিদ্ধান্ত সরাসরি ঘোষণা করে কৃত্রিমভাবে রেকর্ডকৃত একটি কণ্ঠস্বর।
প্রথমবার দেখে মনে হতে পারে এটি নিখুঁত। বাস্তবে যদিও প্রযুক্তি অনেক উন্নত হয়েছে, তথাপি “মানবীয় চোখ” ও “মানব অনুভূতি” যা কোর্টে থাকতো, তার একটি অংশ যেন হারিয়ে যাচ্ছে।
খেলোয়াড়দের আপত্তি: প্রযুক্তির ভুল সিদ্ধান্ত?
এই নতুন AI-সিস্টেম নিয়ে সকলেই যে সন্তুষ্ট, তা কিন্তু নয়। টুর্নামেন্ট চলাকালীন কিছু ম্যাচে খেলোয়াড়রা এই প্রযুক্তির উপর সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
বিশ্বনামধন্য খেলোয়াড় কার্লোস আলকারাজ তার তৃতীয় রাউন্ডের ম্যাচে বলেন, “আমি যদি চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ পেতাম, তবে অন্তত তিনটি বলের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতাম।”
তার বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, AI-সিস্টেম এখনো সম্পূর্ণরূপে নির্ভুল নয়। একইভাবে জ্যাক ড্রেপার এবং এমা রাডুকানু উভয়েই অভিযোগ করেছেন যে AI বেশ কয়েকটি ভুল সিদ্ধান্ত দিয়েছে।
এর ফলে প্রশ্ন উঠছে—এই AI-নির্ভরতা কি খেলোয়াড়দের সিদ্ধান্ত-নির্ভরতার স্বাধীনতা কমিয়ে দিচ্ছে?
দর্শকদের চোখে: হারানো মানবিক স্পর্শ
উইম্বলডনের সৌন্দর্য, ঐতিহ্য এবং রীতিনীতির জন্য বিখ্যাত। অনেক দর্শক মনে করেন, সাদা পোশাকের লাইনজাজেরা যেন টুর্নামেন্টের “মানবিক আবহ” তৈরি করতেন। তাদের চোখে কোর্টে AI সিদ্ধান্ত প্রযুক্তি চালু করায় উইম্বলডনের একটা “আত্মা” যেন হারিয়ে গেছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই লিখেছেন—“উইম্বলডনের ঐতিহ্যকে ধরে রাখা উচিত ছিল। প্রযুক্তি আসুক, কিন্তু মানুষের স্পর্শটাই আসল।”
এমনকি কোনো কোনো দর্শক বলছেন, কিছু ভুল সিদ্ধান্তের জন্য খেলোয়াড় ও দর্শকদের মধ্যে তৎক্ষণাৎ আবেগীয় প্রতিক্রিয়া ছিল, যা খেলার রোমাঞ্চ আরও বাড়িয়ে দিত। AI সেই অনুভূতিকে চাপা দিয়ে দিচ্ছে।
মানব বনাম মেশিন: সত্যিকার তুলনা
একদিকে যেখানে প্রযুক্তি প্রশংসা পাচ্ছে দ্রুত সিদ্ধান্ত, নিরপেক্ষতা ও কাজের ধারাবাহিকতার জন্য, সেখানে মানব লাইন জাজদের ছিল অভিজ্ঞতা, পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রতিক্রিয়া ও দর্শকদের সাথে একধরনের আন্তরিক সম্পর্ক।
মানব লাইন জাজদের ভুল হতে পারে, তবে সেই ভুলের দায় নেওয়ার মত মানুষ ছিল। AI যদি ভুল করে, তার দায়ভার কার?
টেনিসে প্রযুক্তির ইতিহাস
উইম্বলডনের এই AI চালু করাটা হঠাৎ কিছু নয়। ২০০৬ সাল থেকেই টেনিসের বড় বড় টুর্নামেন্টে প্রযুক্তির ভূমিকা বাড়তে থাকে। সেই সময়ই চালু হয় “চ্যালেঞ্জ সিস্টেম” যেখানে খেলোয়াড়রা সন্দেহ হলে বলের সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করতে পারতেন। এই চ্যালেঞ্জ পদ্ধতিতেই যুক্ত ছিল হক-আই প্রযুক্তি।
কিন্তু এখন সেই চ্যালেঞ্জ সিস্টেমটাই বিলুপ্ত। AI নিজেই এখন “শেষ কথা” বলে। এটাই অনেক খেলোয়াড় ও দর্শকের আপত্তির বড় কারণ—তারা চান প্রযুক্তি হোক সহায়ক, প্রভু নয়।
বিশ্বের অন্য টুর্নামেন্টে কী হচ্ছে?
অস্ট্রেলিয়ান ওপেন এবং ইউএস ওপেনে আগেই পূর্ণাঙ্গ AI প্রযুক্তি চালু হয়েছে। এই দুটি টুর্নামেন্ট তুলনামূলকভাবে আধুনিকতার দিকে ঝুঁকে পড়েছে, যেখানে উইম্বলডনের মতো ঐতিহ্যকে অতটা গুরুত্ব দেয় না।
তবে উইম্বলডনের সিদ্ধান্ত অনেককেই অবাক করেছে, কারণ এই টুর্নামেন্ট তার রীতিনীতি, পোশাকবিধি এবং ঐতিহাসিক শৈলীর জন্য সুপরিচিত। এমন একটি টুর্নামেন্টের AI নির্ভর হয়ে যাওয়া অনেকের চোখে এক ধরনের বৈপরীত্য তৈরি করেছে।
প্রযুক্তি কি সত্যিই নির্ভরযোগ্য?
এখন পর্যন্ত হক-আই লাইভ প্রযুক্তির নির্ভুলতার হার ৯৯% এরও বেশি বলে দাবি করা হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো—যদি একটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টের সময় ১% ভুল হয়, তবে তার মূল্য কত?
AI সিস্টেম কেবল সেন্সরের তথ্য ও অ্যালগরিদম অনুসরণ করে, কিন্তু খেলার গতিপ্রকৃতি, আবহাওয়া, বলের স্পিন কিংবা মানসিক চাপে নেওয়া সিদ্ধান্তের মতো সূক্ষ্ম বিষয়ে এখনো মানব মস্তিষ্কই এগিয়ে।
আমরা কোথায় যাচ্ছি?
কোনো সন্দেহ নেই, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের জীবনের বহু ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে—স্বাস্থ্যসেবা, পরিবহন, শিল্প, এমনকি শিক্ষা ক্ষেত্রেও। খেলাধুলাও এর ব্যতিক্রম নয়।
তবে প্রশ্ন উঠছে—এই প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ভীড়ে আমরা কি হারিয়ে ফেলছি আমাদের ঐতিহ্য, আবেগ, আর মানবিকতা?
প্রযুক্তি যেন সহায়ক হয়, মানবিক স্পর্শকে প্রতিস্থাপনকারী নয়।
বাংলাদেশের পাঠকদের জন্য কিছু ভাবনা
বাংলাদেশেও ক্রীড়াঙ্গনে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে—ক্রিকেটে DRS, ফুটবলে VAR ইত্যাদি। কল্পনা করুন, একদিন আমাদের জাতীয় ক্রীড়াক্ষেত্রেও এমন সিদ্ধান্ত আসবে—”AI রেফারির বদলে মানব রেফারি বাতিল!” তখন আমাদের মনোভাবই বা কী হবে?
এমন সিদ্ধান্তের আগে আমাদের উচিত প্রশ্ন তোলা:
- প্রযুক্তি কি আমাদের অভিজ্ঞতা উন্নত করছে, নাকি কেবল দ্রুততার পেছনে ছুটছে?
- আমরা কি কেবল কার্যকারিতাই চাই, নাকি কিছু অনুভূতি, ঐতিহ্যও ধরে রাখতে চাই?
উপসংহার: প্রযুক্তির সাথে সহাবস্থান চাই
উইম্বলডনের এই পরিবর্তন একটি বড় বার্তা দেয়—প্রযুক্তি দিন দিন আমাদের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা রূপান্তর করছে। কিন্তু প্রতিটি রূপান্তরই ভালো এমন নয়।
আমরা চাই উন্নত প্রযুক্তি, তবে চাই মানুষের জায়গাটা যেন রোবট না দখল করে। উইম্বলডনের নতুন AI যুগ আমাদের এক বড় প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে—আমরা কি এগোচ্ছি, না কি কিছু হারাচ্ছি?
আপনি কী ভাবছেন? উইম্বলডনে AI লাইন জাজ কি স্থায়ী হওয়া উচিত, নাকি ঐতিহ্য ও মানবিক অনুভূতির জায়গায় আবারও মানুষকেই ফিরিয়ে আনা উচিত?
আপনার মতামত জানান biggani.org-এ। প্রযুক্তি আর ঐতিহ্যের মাঝে আপনি কোনটা বেছে নেবেন?
Leave a comment