তথ্যপ্রযুক্তিনতুন প্রযুক্তি

সমুদ্রের তলায় ডেটা সেন্টার: চীনের অভিনব পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ

Share
Share

✍️ নিউজ ডেস্ক, বিজ্ঞানী অর্গ
📧 [email protected]

একবিংশ শতাব্দীতে আমরা একটি তথ্য-নির্ভর পৃথিবীতে বাস করছি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), ক্লাউড কম্পিউটিং এবং ডিজিটাল প্রযুক্তির জোয়ারে আমাদের প্রতিদিনের জীবন পরিচালিত হচ্ছে অসংখ্য সার্ভার ও ডেটা সেন্টারের মাধ্যমে। কিন্তু এই ডেটা সেন্টারগুলোকে চালু রাখতে লাগে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ ও পানি—যার বেশিরভাগই খরচ হয় শুধুমাত্র ঠান্ডা রাখার জন্য।

প্রচলিত ব্যবস্থায়, ডেটা সেন্টারগুলো সাধারণত স্থাপন করা হয় শুষ্ক এলাকায়, কারণ সেখানে বাতাসে আর্দ্রতা কম থাকায় যন্ত্রপাতির ক্ষতির আশঙ্কা কম। তবে চীন এই ধারাকে সম্পূর্ণভাবে উল্টে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে এক নতুন পথে। তারা এখন বিশ্বের সবচেয়ে ভেজা জায়গায়, অর্থাৎ সাগরের তলায়, ডেটা সেন্টার স্থাপনের পথে।

২০২৫ সালের জুন মাসে সাংহাই উপকূল থেকে ছয় মাইল দূরে এক অভিনব ডেটা সেন্টার নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। এটি হবে একটি বায়ুশক্তিচালিত সাবমেরিন ডেটা সেন্টার, যা স্থাপন করা হবে গভীর সাগরের নিচে।

🔧 কিভাবে কাজ করবে এই পানির নিচের ডেটা সেন্টার?

প্রচলিত ডেটা সেন্টারে শত শত সার্ভার একসঙ্গে কাজ করে। এই সার্ভারগুলো থেকে যে তাপ উৎপন্ন হয়, সেটি সরিয়ে না নিলে যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে যেতে পারে এবং ডেটাও ধ্বংস হতে পারে। এজন্য সার্ভারগুলোকে ঠান্ডা রাখতে ঠান্ডা পানি ব্যবহার করা হয়। এই পানি ভূগর্ভ থেকে, নদী বা খাল থেকে, এমনকি ব্যবহৃত বর্জ্যজল পরিশোধন করেও সংগ্রহ করা হয়।

একটি সাধারণ ডেটা সেন্টারের প্রায় ৫০ শতাংশ বিদ্যুৎ খরচ হয় শুধু ঠান্ডা রাখার কাজে।

চীনের নতুন পানির নিচের ডেটা সেন্টারে থাকবে বিশেষ ধরনের পাইপলাইন ও রেডিয়েটর সিস্টেম, যা সরাসরি সমুদ্রের ঠান্ডা পানি টেনে এনে সার্ভারের তাপ শোষণ করবে। সমুদ্রের পানি পাইপের মাধ্যমে সার্ভার র‍্যাকের পিছনে থাকা রেডিয়েটরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হবে এবং সেখান থেকে তাপ শোষণ করে দূরে নিয়ে যাবে।

এই ব্যবস্থায় অতিরিক্ত পানি ছিটিয়ে দেওয়ার দরকার নেই, ফলে পানির অপচয় হবে না। এছাড়া প্রাকৃতিকভাবে ঠান্ডা থাকা সমুদ্রের পানি ব্যবহার করায় বিদ্যুৎ খরচও কমবে।

🌍 পরিবেশবান্ধব ভবিষ্যতের দিকে এক ধাপ এগিয়ে

ডেটা সেন্টার খাত বিশ্বব্যাপী কার্বন নিঃসরণের একটি বড় উৎস হয়ে উঠেছে। ধারণা করা হয়, বিশ্বের মোট বিদ্যুৎ খরচের প্রায় ১–৩ শতাংশ ডেটা সেন্টারগুলোর পেছনে ব্যয় হয়। এই খরচ দিনে দিনে আরও বাড়ছে, কারণ আমাদের অনলাইন নির্ভরতা বাড়ছে প্রতিদিনই।

এই প্রেক্ষাপটে চীনের এই পদক্ষেপকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।

এমবার (Ember) নামক এক শক্তি-বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বিশ্লেষক শাব্রিনা নদিলা বলেন:

“চীনের এই সাহসী উদ্যোগ টেকসই ডিজিটাল অবকাঠামোর দিকে এক বড় অগ্রগতি, যা বৈশ্বিক মানদণ্ডে পরিবর্তন আনতে পারে।”

অর্থাৎ, শুধু চীন নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর কাছেও এই উদ্ভাবন হতে পারে অনুকরণীয়।

🧠 কেন দরকার এমন উদ্ভাবন?

ডেটা সেন্টার নিয়ে সাম্প্রতিক গবেষণাগুলো বলছে:

  • একটি বড় ডেটা সেন্টার দৈনিক কয়েক লক্ষ গ্যালন পানি খরচ করে শুধু ঠান্ডা রাখার জন্য।
  • বেশিরভাগ ডেটা সেন্টার স্থাপন করা হয় মরুভূমি বা শুষ্ক এলাকায় (যেমন অ্যারিজোনা, কাতার, সৌদি আরব)।
  • কিন্তু এইসব এলাকায় পানির উৎস সীমিত, ফলে পরিবেশের উপর চাপ পড়ে।

এই সমস্যার বিকল্প হিসেবেই সাবমেরিন ডেটা সেন্টার একটি যুগান্তকারী ধারণা। সাগরের প্রাকৃতিক ঠান্ডা পানি সহজলভ্য এবং এটি অবিরাম প্রবাহমান—যা ক্রমাগত তাপ অপসারণে সহায়ক।

⚙️ প্রযুক্তিগত দিক

চীনের এই ডেটা সেন্টার প্রকল্পে বেশ কিছু অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে:

  • বায়ুশক্তিচালিত জেনারেটর: ডেটা সেন্টারের বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণে সমুদ্রের ওপরে ভাসমান টারবাইন ব্যবহার করা হবে।
  • রিমোট মনিটরিং সিস্টেম: সমুদ্রের নিচে স্থাপিত সার্ভারগুলোকে নিয়মিত নজরদারির জন্য থাকবে সেন্সর ও ক্লাউড কানেকশন।
  • মডুলার ডিজাইন: ভবিষ্যতে সহজে আরও ডেটা ইউনিট যোগ করা যাবে।

এছাড়া এই প্রযুক্তি ভূমিকম্প, সুনামি, বা তীব্র ঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পেতে সাবধানতা অবলম্বন করেছে।

🌐 ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা

চীন ছাড়াও আগ্রহ দেখিয়েছে মাইক্রোসফট। তারা ২০১৫ সালেই Project Natick নামে একটি পরীক্ষামূলক সাবমেরিন ডেটা সেন্টার তৈরি করেছিল স্কটল্যান্ড উপকূলে। সেখানে ৮৬৪টি সার্ভার সমুদ্রের নিচে সফলভাবে ২ বছর চালানো হয়।

চীনের প্রকল্পটি সেই পরীক্ষার থেকে অনেক বড় পরিসরে। এটি বিশ্বের বৃহত্তম সাবমেরিন ডেটা সেন্টার হিসেবে গড়ে উঠবে বলে আশা করা হচ্ছে।

চীনের এই উদ্যোগ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ৫জি, এবং ইন্ডাস্ট্রি ৪.০-ভিত্তিক প্রযুক্তিগুলোর চাহিদা পূরণে সহায়ক হবে। এছাড়া এটি দেশের প্রযুক্তিগত সক্ষমতার প্রতীক হিসেবেও কাজ করবে।

💡 বাংলাদেশের জন্য বার্তা

বাংলাদেশে বর্তমানে ডেটা সেন্টারের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে, বিশেষ করে ব্যাংকিং, স্বাস্থ্যসেবা, এবং শিক্ষাখাতে ডিজিটাল রূপান্তরের কারণে।

বাংলাদেশে কিছু বড় ডেটা সেন্টার গড়ে উঠেছে (যেমন টিয়ার–৪ ডেটা সেন্টার), তবে আমাদের সামনে এখনো বড় চ্যালেঞ্জ:

  • বিদ্যুৎ খরচ
  • শীতলীকরণ প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা
  • পরিবেশগত প্রভাব

চীনের এই নতুন সাবমেরিন মডেল আমাদের জন্য হতে পারে এক নতুন চিন্তার উদাহরণ। বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলোতে ভবিষ্যতে এমন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যেতে পারে, বিশেষ করে যদি আমরা নবায়নযোগ্য শক্তিকে সঙ্গে রাখতে পারি।

📌 উপসংহার

ডেটা সেন্টার এখন আর শুধুমাত্র প্রযুক্তির বিষয় নয়; এটি পরিবেশ, জ্বালানি এবং টেকসই উন্নয়নের একটি সমন্বিত অংশ।

চীনের এই সাহসী পদক্ষেপ প্রযুক্তির ইতিহাসে নতুন মাত্রা যোগ করবে বলেই আশা করা যায়। সাগরের তলায় ডেটা সেন্টার নির্মাণের মাধ্যমে তারা দেখিয়ে দিচ্ছে, কিভাবে পরিবেশ সংরক্ষণ এবং প্রযুক্তি উন্নয়ন একসাথে এগিয়ে যেতে পারে।

বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশগুলোর উচিত এই ধরনের উদ্ভাবনী উদ্যোগকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা এবং নিজেদের জন্য উপযুক্ত মডেল তৈরি করা।

ডেটা সেন্টারের ভবিষ্যৎ হয়তো জলে ভাসছে—কিন্তু প্রযুক্তির দিগন্তে এটি এক উজ্জ্বল সূচনা।


📢 আপনি কী ভাবছেন এই প্রযুক্তি নিয়ে? মতামত জানান আমাদের ফেসবুক পেজে অথবা লিখুন [email protected] ঠিকানায়।
বিজ্ঞানী অর্গ – বিজ্ঞানকে জানুন, চিন্তা করুন।

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

Related Articles
নতুন প্রযুক্তিবিজ্ঞান বিষয়ক খবর

১৬ বছর অন্ধ থাকার পর—মস্তিষ্কে চিপ বসিয়ে ফিরে পেলেন দৃষ্টিশক্তি!

আবিষ্কার করুন কিভাবে ১৬ বছর ধরে অন্ধ থাকা একজন মহিলা ব্রেন চিপ...

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাতথ্যপ্রযুক্তি

এআই ইনফ্লুয়েন্সার: ঘণ্টায় ১০ লাখ ডলার আয়ের চমক

চীনের AI প্রভাবশালীরা কীভাবে লাইভ-স্ট্রিম শপিংয়ে বিপ্লব ঘটাচ্ছে, প্রতি ঘন্টায় লক্ষ লক্ষ...

নতুন প্রযুক্তিপদার্থবিদ্যা

নিউক্লিয়ার ফিউশন: পরিচ্ছন্ন শক্তির এক নতুন ভোরের দ্বারপ্রান্তে আমরা?

নিউক্লিয়ার ফিউশন কীভাবে একটি পরিষ্কার, কার্যত সীমাহীন শক্তির ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি দেয় তা...

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাতথ্যপ্রযুক্তি

চ্যাটজিপিটিতেও লিঙ্গবৈষম্য! নারীরা কেন পিছিয়ে?

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারে নারীরা কেন পিছিয়ে পড়ছে? বাংলাদেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গ্রহণে লিঙ্গ...

Three Columns Layout

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact

biggani.org❤️gmail.com

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

বিজ্ঞানী অর্গ (biggani.org) বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে গবেষণা ও বিজ্ঞান নিয়ে বাংলা ভাষায় তথ্য ও সাক্ষাৎকার প্রচার করে – নবীনদের গবেষণা ও উচ্চশিক্ষায় প্রেরণা দেয়া হয়।

যোগাযোগ:

biggani.org@জিমেইল.com

biggani.org, a community of Bangladeshi scientists, shares interviews and information about researchers and scientists in Bengali to inspire young people in research and higher education.