শুরুর গল্প:
রাত ১টা। মাথায় পরীক্ষার টেনশন। হালকা কিছু দেখতে দেখতে মনটা হালকা করবো- এই ভেবে ফেসবুক খুললাম।
প্রথমে একটুখানি মিম, তারপর একটা মোটিভেশনাল রিল, তারপর এক বন্ধুর স্ট্যাটাস।
চোখ তুললাম ১টা ৪৮-এ।
মাথা ঝিমঝিম করছে। কিছু মনে থাকছে না। কিন্তু আমি তো কেবল স্ক্রল করছিলাম!
তাহলে এত ক্লান্তি কেন?
Scroll Fatigue: ক্লান্তি, কিন্তু অন্যরকম
সাধারণত ক্লান্তি বলতে আমরা বুঝি শারীরিক বা মানসিক অবসাদ। কিন্তু “Scroll Fatigue” হল এমন এক ধরণের ক্লান্তি, যা তৈরি হয় নিউরোনাল decision overload থেকে। অর্থাৎ, আপনি যতক্ষণ স্ক্রল করছেন, আপনার মস্তিষ্ক তখন হাজার হাজার ছোট সিদ্ধান্ত নিচ্ছে-
“এই পোস্টটা পড়ব?”
“এই ছবিটা লাইক দেব?”
“এই ভিডিওটা স্কিপ করব?”
এই ‘micro-decision’ গুলো প্রথমে অতি সাধারণ মনে হলেও, দিনের পর দিন, ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে এগুলো মস্তিষ্কের ওপর এক ধরনের নিউরোলজিক্যাল চাপ সৃষ্টি করে।
Prefrontal Cortex: ক্লান্তির মূল মঞ্চ
মানব মস্তিষ্কের prefrontal cortex অংশটি আমাদের ফোকাস, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, এবং পরিকল্পনা তৈরির কাজ করে। এটি খুব শক্তিশালী, তবে সীমাহীন নয়।
একটি বিখ্যাত গবেষণায় (Baumeister et al., 1998, “Ego depletion: Is the active self a limited resource?”) দেখা গেছে, দিনের প্রথম ভাগে মানুষের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা সবচেয়ে শক্তিশালী থাকে, এবং দিনের শেষে decision fatigue শুরু হয়।
ফেসবুক স্ক্রলিং এই ক্ষমতাকে আরো দ্রুত নিঃশেষ করে দেয়। কারণ প্রতিটি স্ক্রলেই নতুন তথ্য, নতুন চেহারা, নতুন ইমোশনাল রেসপন্স। ফলে prefrontal cortex রিলাক্স করার সুযোগ পায় না।
Dopamine Loop: আনন্দের ফাঁদে ক্লান্তি
সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করার সময় মস্তিষ্কে ডোপামিন নামক নিউরোট্রান্সমিটার নিঃসৃত হয়-এটি আনন্দ, উত্তেজনা ও অনুপ্রেরণার অনুভব তৈরি করে।
কিন্তু সমস্যা হলো, এই আনন্দ হয় ক্ষণস্থায়ী ও খণ্ড খণ্ড-reward আসে ঠিকঠাক, কিন্তু তা কখনোই সন্তোষজনক না। তখনই তৈরি হয় “hedonic treadmill” effect—অর্থাৎ, আপনি ক্রমাগত আনন্দ পেতে ছুটছেন, কিন্তু সন্তুষ্টি কখনো ধরা দিচ্ছে না। (Brickman & Campbell, 1971)
একাধিক গবেষণায় (Montag & Walla, 2016, “Carrying the Internet in your pocket: Links between Internet addiction, smartphone usage and emotional intelligence”) দেখা গেছে, অতিরিক্ত স্ক্রলিং ব্যবহারকারীর reward circuitry-তে প্রভাব ফেলে, যার ফলে তারা পরবর্তীতে সাধারণ আনন্দময় বিষয়েও আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
নিউরোসায়েন্স ব্যাখ্যা: মস্তিষ্কের ক্লান্তি মানে কী?
Amygdala: স্ক্রলিংয়ের সময় বিভিন্ন আবেগীয় কন্টেন্টের কারণে এই অংশটি ক্রমাগত সক্রিয় থাকে-এটি স্ট্রেস ও উদ্বেগ বাড়ায়। (LeDoux, 2000)
Hippocampus: ইনফরমেশন প্রসেসিং ও মেমোরি গঠনের কেন্দ্র। অতিরিক্ত ও এলোমেলো তথ্যের কারণে এটি decision tag দিতে পারে না- ফলে মনে রাখাও কঠিন হয়।
Default Mode Network (DMN): যখন আমরা কিছু না করে রিলাক্স করি, এই সিস্টেম কাজ করে। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়া এই অংশের কাজ বন্ধ করে দেয়, ফলে আমরা বিশ্রাম নিলেও “রিচার্জ” হই না। (Raichle et al., 2001)
Scroll Fatigue এর লক্ষণসমূহ:
1. হালকা মাথা ব্যথা ও ধোঁয়াটে অনুভব
2. decision নিতে দেরি হওয়া
3. ফোকাসের অভাব
4. পড়া মুখস্থ করতে না পারা
5. অল্পতেই বিরক্তি বা হতাশা
বিজ্ঞান বলছে, সমাধানও আছে:
Digital Fasting (ডিজিটাল উপবাস):
প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় স্ক্রল থেকে বিরত থাকা-যাতে prefrontal cortex রিল্যাক্স করতে পারে।
Intentional Browsing:
“স্ক্রল করবো ১৫ মিনিট, শুধু নির্দিষ্ট পেজ বা ভিডিও দেখব”-এইরকম পরিকল্পিত ব্যবহার।
Pomodoro Technique:
২৫ মিনিট কাজ, ৫ মিনিট স্ক্রল। সময় বেঁধে দিলে dopamine loop কন্ট্রোলে রাখা যায়।
Focused Content Creation:
নিজে কন্টেন্ট তৈরি করলে ব্রেইন কনসেপ্টually ইনভল্ভড থাকে-passive scrolling কমে।
শেষ কথাঃ
আমরা যখন বলি, “আজ মাথা কাজ করছে না”- অনেক সময় তার কারণ হয়তো শরীর নয়, বরং আমাদের নিউরোনের ক্লান্তি।
Facebook বা Instagram স্ক্রলিং মানেই বিশ্রাম নয়- অনেক সময় সেটাই হয় মস্তিষ্কের নীরব পরিশ্রম, যার ক্লান্তি আপনি টের পান না- শুধু অনুভব করেন।
মো. ইফতেখার হোসেন
চিকিৎসা শিক্ষার্থী, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ | নিউরোসায়েন্স, অভ্যাস গঠন ও মানুষের মস্তিষ্কের আচরণগত পরিবর্তন নিয়ে আগ্রহী।
Leave a comment