২০২৪ সালে বৈশ্বিকভাবে কার্বন ডাই-অক্সাইড (CO₂) গ্যাসের পরিমাণ ইতিহাসের সর্বোচ্চ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে — বছরে ৩.৭ অংশ প্রতি মিলিয়ন (ppm)। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ পর্যবেক্ষণ সংস্থা NOAA এই তথ্য বিশ্লেষণে নিশ্চিত করেছে। অথচ এত বড় বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার প্রকাশের পরিবর্তে, ট্রাম্প প্রশাসন এই খবরকে নীরবে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছে।
NOAA সাধারণত প্রতি বছর বসন্তে বিশদ রিপোর্ট এবং প্রেস রিলিজের মাধ্যমে বিগত বছরের গ্রীনহাউস গ্যাস সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করে। কিন্তু এবছর তারা কোনো প্রেস রিলিজ দেয়নি, বরং শুধু ফেসবুক ও এক্স (পূর্বতন টুইটার) প্ল্যাটফর্মে সীমিত পোস্টের মাধ্যমে তথ্য প্রকাশ করেছে। এর মধ্যেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য — যে CO₂ বৃদ্ধির হার ছিল অতীতের যেকোনো বছরের চেয়ে বেশি — তা উল্লেখই করা হয়নি।
সূত্র অনুযায়ী, NOAA কর্মীরা যথারীতি একটি বিস্তারিত ওয়েব প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছিলেন, কিন্তু শেষ মুহূর্তে তা প্রকাশের সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়। সূত্রটি জানিয়েছে, ট্রাম্প প্রশাসনের ভয়ে পরিচয় গোপন রাখার শর্তে এই তথ্য জানানো হয়েছে।
এর পাশাপাশি, NOAA ইতিমধ্যে তাদের নিয়মিত মাসিক জলবায়ু ব্রিফিংও বন্ধ করেছে এবং সংস্থার গবেষণা ও জলবায়ু কার্যক্রম ধ্বংসের প্রস্তাব করা হয়েছে। এমনকি NOAA-র ওশানিক অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফেরিক রিসার্চ অফিস পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়ার পরিকল্পনাও এসেছে হোয়াইট হাউস থেকে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি এই রিপোর্ট যথাযথভাবে প্রচার করা হতো, তাহলে এটি একটি প্রধান আন্তর্জাতিক জলবায়ু সংবাদ হয়ে উঠতো। ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ ও ‘CNN’ কিছুটা তথ্য প্রকাশ করেছে, কিন্তু মূলধারার সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক কাভারেজ হয়নি।
পৃথিবীর প্রাকৃতিক কার্বন শোষক ব্যবস্থা নষ্ট হচ্ছে?
বিজ্ঞানীরা উদ্বিগ্ন যে, পৃথিবীর প্রাকৃতিক কার্বন শোষক — যেমন বনভূমি ও জলাভূমি — হয়তো ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। আগে এসব প্রাকৃতিক ব্যবস্থা অতিরিক্ত CO₂ শোষণ করে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি কিছুটা কমিয়ে আনতো। কিন্তু ক্রমাগত উষ্ণতা, খরা ও দাবানলে এগুলো নষ্ট হয়ে কম কার্বন শোষণ করতে পারছে।
ফ্রান্সের পিয়েরে-সাইমন লাপ্লাস ইনস্টিটিউটের জলবায়ু বিজ্ঞানী ফিলিপ সিয়াইস (Philippe Ciais) বলছেন,
“আমার মতে, যদি ভবিষ্যতেও শুষ্ক বছরগুলো চলতে থাকে, তাহলে এই প্রবণতা আরও বাড়বে।”
তিনি ও তার সহকর্মীরা সাম্প্রতিক এক গবেষণায় (যা এখনো রিভিউ সম্পন্ন হয়নি) বিশ্লেষণ করেছেন, ২০২৩ সালের মাঝামাঝি থেকে ২০২৪ সালের প্রথমার্ধে পৃথিবীর ট্রপিক্যাল অঞ্চলে অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণের প্রবণতা বেড়েছে। বিশেষ করে আমাজন অঞ্চলে খরা ও দাবানলের কারণে এই অবনতি দেখা গেছে।
এল নিনো (El Niño) প্রভাবের বাইরেও সমস্যা
যদিও প্রাকৃতিক জলবায়ু পরিবর্তন চক্র এল নিনো কিছুটা ভূমিকা রেখেছে, তা একমাত্র কারণ নয়। এবারের এল নিনো অতীতে দেখা শক্তিশালী এল নিনোদের তুলনায় ততটা প্রবলও ছিল না এবং ২০২৪ সালের প্রথমার্ধেই শেষ হয়ে যায়। কিন্তু ট্রপিক্যাল অঞ্চলে খরা ও দাবানল বছরের বাকি সময়েও অব্যাহত ছিল।
ফলে বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, পৃথিবী একটি বিপজ্জনক ‘ফিডব্যাক লুপ’-এর মুখোমুখি হয়েছে:
উষ্ণতা বাড়ছে → প্রাকৃতিক কার্বন শোষক ভেঙে পড়ছে → অতিরিক্ত CO₂ নিঃসরণ হচ্ছে → আরো উষ্ণতা বাড়ছে।
সিয়াইস সতর্ক করে বলেছেন,
“এক বছরের ডেটা দেখে আমরা এখনই বলতে পারি না যে সবকিছু নষ্ট হয়ে যাবে, কিন্তু এই ধারা অব্যাহত থাকলে পৃথিবী হয়তো বিজ্ঞানীদের পূর্বাভাসের চেয়ে দ্রুত উষ্ণ হয়ে উঠবে।”
নীতিনির্ধারণে দেরি, পরিস্থিতির অবনতি
উল্লেখযোগ্য হলো, ২০২৪ সালে জীবাশ্ম জ্বালানি (fossil fuels) নির্গমনও রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে। যদিও শুধুমাত্র এই নির্গমনেই CO₂ বৃদ্ধির ব্যাখ্যা হয় না, এটি স্পষ্ট যে বিশ্ব এখনো প্যারিস জলবায়ু চুক্তির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে নেই।
সিয়াইস মন্তব্য করেছেন,
“নীতিনির্ধারকরা বলেন, আমাদের কাছে এখনো কিছু সময় আছে ২ ডিগ্রি লক্ষ্য পূরণের জন্য। কিন্তু এগুলো নির্ভর করে এই বিশ্বাসের ওপর যে পৃথিবী যথেষ্ট পরিমাণে কার্বন শোষণ করতে পারবে। যদি সেই শোষণ ক্ষমতাই নষ্ট হয়, তাহলে সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাবে।”
সম্পর্কিত নিবন্ধ:
Leave a comment