বিজ্ঞান বিষয়ক খবরমহাকাশ

ধূমকেতুর দেশে অতিথি: ৩আই/অ্যাটলাস ও আমাদের সৌরজগতের সীমা

Share
Share

২০২৫ সালের ১ জুলাই। হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ল্যারি ডেনো এক অচেনা ছায়াপথচারী বস্তু আবিষ্কার করেন চিলির একটি টেলিস্কোপে নজর রেখে। বস্তুটির নামকরণ হয় 3I/ATLAS — সৌরজগতের তৃতীয় ‘ইন্টারস্টেলার অবজেক্ট’ বা আন্তঃনাক্ষত্রিক বস্তু। এ যেন এক বিপুল সৌরপর্যটক, যা সূর্যের টানে সামান্য বাঁক নিয়েই আবার বেরিয়ে যাবে তার আদি নক্ষত্র থেকে ছিটকে আসা অজানা পথে।

এমন বিরল মহাজাগতিক দর্শনার্থীর সন্ধান পাওয়া মানে মহাকাশবিজ্ঞানের জন্য এক বিশাল সুযোগ। কারণ, এই ধরণের বস্তু আমাদের সৌরজগতের বাইরের ইতিহাস, রসায়ন, এমনকি গ্রহ গঠনের রহস্য উন্মোচনে সহায়ক হতে পারে।

মহাজাগতিক আগন্তুকের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা

ধরা যাক, আমাদের সৌরজগত একটা বিশাল পরিবার। পরিবারটি ঘুরছে সূর্যের চারপাশে। এখন ভাবুন, একদিন হঠাৎ এক আগন্তুক এল বাইরের অন্য কোনো গ্যালাক্সির প্রান্ত থেকে। সে কিছুক্ষণ ঘুরেফিরে চলে গেল। এই ‘আগন্তুক’ হল 3I/ATLAS। এর গতি এতটাই বেশি (প্রায় ৬০ কিমি/সেকেন্ড) যে এটি সূর্যের মাধ্যাকর্ষণ বলকেও অগ্রাহ্য করে চলে যাবে চিরতরে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই বস্তুটি কোনো এক প্রাচীন নক্ষত্রের আশেপাশে গঠিত হয়েছিল, হয়তো সেই নক্ষত্র এখন আর অস্তিত্বেও নেই। এটির ঘূর্ণন গতি, আকার ও গঠন বিশ্লেষণ করে বোঝা যায়, এটি ৩ থেকে ১১ বিলিয়ন বছর পুরনো হতে পারে — আমাদের সৌরজগতের দ্বিগুণ বা তিনগুণ বয়সী।

ইতিহাসের দিকে ফিরে দেখা

২০১৭ সালে প্রথম এমন ইন্টারস্টেলার অবজেক্ট ধরা পড়ে: 1I/ʻOumuamua। তারপর আসে 2I/Borisov। আর এবার 3I/ATLAS। প্রথমটি দেখতে ছিল সিগার বা প্যানকেকের মতো, দ্বিতীয়টি ছিল ধূমকেতুর মতো। ৩আই/অ্যাটলাসও প্রাথমিকভাবে ধূমকেতু হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে, যদিও এটির লেজ খুব স্পষ্ট নয় — এখনো পর্যন্ত ধূলিময় এক ধোঁয়াশা মাত্র।

এটি আমাদের সৌরজগতের বৃহস্পতির কক্ষপথ অতিক্রম করেছে এবং এখন মঙ্গলগ্রহের দিকে যাচ্ছে। অক্টোবর নাগাদ এটি সূর্যের কাছাকাছি পৌঁছবে (perihelion)। তখন এর বরফ গলতে শুরু করবে, এবং আমরা দেখতে পারব এক বিশাল লেজ — এ যেন মহাশূন্যে আগুনে ঘেরা একটি শীতল কাচের গোলক!

কী দিয়ে তৈরি এই বস্তুটি?

এটিই বিজ্ঞানীদের জন্য সবচেয়ে রোমাঞ্চকর প্রশ্ন। যদি এটি খুব পুরনো হয়, তবে এর মধ্যে থাকা বরফ ও গ্যাস আমাদের বলে দিতে পারে গ্যালাক্সির প্রাচীন রাসায়নিক গঠন। NASA’র গডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টারের স্টেফানি মিলাম ও তাঁর দল JWST (James Webb Space Telescope) ব্যবহার করে এটি বিশ্লেষণ করবেন — খুঁজে দেখবেন, এতে আছে কিনা পানি, কার্বন ডাই-অক্সাইড, হাইড্রোজেন সায়ানাইড কিংবা আরও অজানা যৌগ।

পৃথিবী থেকে দেখা না গেলেও, মঙ্গলগ্রহ দেখতে পাবে

দুর্ভাগ্যবশত, অক্টোবরের শেষে যখন 3I/ATLAS সূর্যের সবচেয়ে কাছাকাছি পৌঁছবে, তখন পৃথিবী থাকবে সূর্যের বিপরীত পাশে। অর্থাৎ আমরা সরাসরি কিছু দেখতে পাব না। তবে NASA’র MAVEN উপগ্রহ, যেটি বর্তমানে মঙ্গলের কক্ষপথে আছে, সেটি এই বস্তুটি পর্যবেক্ষণ করতে পারে। মঙ্গল থেকে দৃশ্যমান হলে, আমরা দেখতে পারব এর লেজ গঠন ও গ্যাস নিঃসরণের ধরণ — এক অমূল্য উপাত্ত।

এটিকে ধরা সম্ভব?

দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমরা এত দ্রুত কোনো মহাকাশযান পাঠাতে পারি না এই বস্তুটির দিকে। এর গতি এবং অবস্থান আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। তবে ২০২৯ সালে ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা (ESA) যে ‘Comet Interceptor’ নামে একটি মিশন চালু করবে, সেটি ভবিষ্যতে এই ধরনের ইন্টারস্টেলার বস্তুর দিকে ধাবিত হতে পারে যদি সময়মতো আরেকটি অনুপ্রবেশকারী ধরা পড়ে।

বিজ্ঞানী মহলে বিতর্ক ও সম্ভাবনা

তবে প্রশ্ন উঠছে, আমরা কেন এত কম সংখ্যক ইন্টারস্টেলার অবজেক্ট দেখতে পাই? মহাকাশে যদি এই ধরনের বিলিয়ন বিলিয়ন বস্তু ঘুরে বেড়ায়, তবে আমরা আরো অনেককেই দেখার কথা। গবেষকরা বলছেন, হয়তো ছোট ইন্টারস্টেলার বস্তুরা আমাদের বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে জ্বলে-পুড়ে যায়, কিংবা এতটাই ছোট যে তারা আমাদের টেলিস্কোপে ধরা পড়ে না।

তবে আশা জাগছে ভেরা সি. রুবিন অবজারভেটরির ওপর, যেটি ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ ১০ বছরব্যাপী আকাশ পর্যবেক্ষণ শুরু করবে। বিজ্ঞানীরা আশাবাদী, এটি অন্তত ৬ থেকে ৫০টি নতুন ইন্টারস্টেলার বস্তু খুঁজে পাবে।

ভবিষ্যতের দিগন্ত

৩আই/অ্যাটলাস আমাদের বিজ্ঞানচর্চাকে কেবলমাত্র আরও এক নতুন তথ্যের উপহার নয়, বরং আমাদের কল্পনা ও অনুসন্ধানের পরিধিও প্রসারিত করেছে। এই একটি বস্তু আমাদের শেখাচ্ছে কীভাবে গ্যালাক্সির এক প্রান্ত থেকে ছিটকে আসা বস্তু আমাদের সৌরজগতের গল্পের সাথে একসূত্রে গাঁথা পড়তে পারে। এর রাসায়নিক গঠন আমাদের দেখাবে তারা ও গ্রহের গঠনগত বৈচিত্র্য, এর গতি ও ঘূর্ণন আমাদের বলবে মহাকাশে কীভাবে এই বস্তুরা ছড়িয়ে পড়ে।

এই নতুন আগন্তুক আমাদের চোখে চোখ রেখে যেন বলছে — “তোমরা একা নও, মহাশূন্যে আরো অনেক আছে তোমাদের গল্প শুনতে চায়।” একে ঘিরে থাকা ধোঁয়াশা সরে গেলে হয়তো আমরা একদিন তার আদি গৃহের সন্ধানও পেয়ে যাব।

এটাই বিজ্ঞানের সৌন্দর্য — অজানার পিছু ছুটে চলা, যতক্ষণ না জানা হয় সবটা। ৩আই/অ্যাটলাস সেই পথে আরেকটি দীপ্ত আলোকবিন্দু।

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

Related Articles
মহাকাশসাধারণ বিজ্ঞান

সূর্য নিভে গেলে জীবন কী টিকে থাকবে?

সূর্যের মৃত্যু হলে জীবনের কী হবে? পৃথিবীর ভবিষ্যৎ, প্লুটোতে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা...

গবেষণায় হাতে খড়িবিজ্ঞান বিষয়ক খবর

জীবনের নতুন সংজ্ঞা! রহস্যময় সত্তা “Sukunaarchaeum mirabile” কি আমাদের বোঝাপড়াকে পাল্টে দিচ্ছে?

সুকুনাআর্কিয়াম মিরাবিল আবিষ্কার করুন, একটি রহস্যময় অণুবীক্ষণিক জীব যা আমাদের জীবনের সংজ্ঞাকে...

নতুন প্রযুক্তিবিজ্ঞান বিষয়ক খবর

১৬ বছর অন্ধ থাকার পর—মস্তিষ্কে চিপ বসিয়ে ফিরে পেলেন দৃষ্টিশক্তি!

আবিষ্কার করুন কিভাবে ১৬ বছর ধরে অন্ধ থাকা একজন মহিলা ব্রেন চিপ...

পদার্থবিদ্যামহাকাশ

মহাকাশযানে গ্র্যাভিটেশনাল স্লিংশট: মহাকাশ ভ্রমণে বিপ্লবী কৌশল

মহাকাশ ভ্রমণে বিপ্লব ঘটাতে পারে এমন মহাকর্ষীয় স্লিংশট কৌশলের পিছনের বিজ্ঞান আবিষ্কার...

বিজ্ঞান বিষয়ক খবরমহাকাশ

নাসার সংকট: ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা

ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে নাসা গভীর অভ্যন্তরীণ সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে, যার মধ্যে বিশাল...

Three Columns Layout

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact

biggani.org❤️gmail.com

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

বিজ্ঞানী অর্গ (biggani.org) বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে গবেষণা ও বিজ্ঞান নিয়ে বাংলা ভাষায় তথ্য ও সাক্ষাৎকার প্রচার করে – নবীনদের গবেষণা ও উচ্চশিক্ষায় প্রেরণা দেয়া হয়।

যোগাযোগ:

biggani.org@জিমেইল.com

biggani.org, a community of Bangladeshi scientists, shares interviews and information about researchers and scientists in Bengali to inspire young people in research and higher education.