আমরা যখন কোনো প্রাচীন পাথরের মূর্তি, পাথরের তৈরী গুহাচিত্র বা হাজার বছরের পুরোনো কাঠের নৌকা খুঁজে পাই, তখন একটি সাধারণ প্রশ্ন ওঠে—এই জিনিসটির বয়স কত? কবে এটি তৈরি হয়েছিল? এই প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য বিজ্ঞানীরা যেসব পদ্ধতি ব্যবহার করেন, তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো কার্বন-১৪ (Carbon-14) ডেটিং। কিন্তু এটিই একমাত্র পদ্ধতি নয়। নানা ধরণের পদার্থ, পরিবেশ ও সময়কাল নির্ধারণের জন্য ভিন্ন ভিন্ন বিজ্ঞানভিত্তিক প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়। চলুন জেনে নিই, কীভাবে এই জটিল কিন্তু রোমাঞ্চকর কাজটি বিজ্ঞানীরা করে থাকেন।
কার্বন-১৪ ডেটিং পদ্ধতি: ইতিহাসের সময়মাপক
কার্বন-১৪ হলো একটি তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ যা প্রকৃতিতে স্বাভাবিকভাবেই বিদ্যমান থাকে। এটি মূলত কার্বনের একটি ভিন্ন রূপ। সাধারণত আমরা যে কার্বন দেখি, তা হলো কার্বন-১২ এবং কার্বন-১৩। কিন্তু কার্বন-১৪ তুলনামূলকভাবে খুবই বিরল এবং এটি তেজস্ক্রিয় হওয়ায় সময়ের সাথে সাথে এটি ভেঙে যায়।
কীভাবে কাজ করে এই পদ্ধতি?
প্রাণজগতে (মানুষ, পশু, উদ্ভিদ) বেঁচে থাকার সময় পর্যন্ত সবকিছুতে কার্বন-১৪ এবং কার্বন-১২ থাকে। কারণ তারা খাদ্য ও বাতাস থেকে এই কার্বন গ্রহণ করে। কিন্তু কোনো প্রাণী বা উদ্ভিদ মৃত্যুবরণ করার পর তারা আর কার্বন গ্রহণ করে না। তখন সেই দেহে থাকা কার্বন-১৪ ধীরে ধীরে ক্ষয় হতে থাকে। বিজ্ঞানীরা জানেন যে, কার্বন-১৪ এর অর্ধ-জীবন (Half-life)—অর্থাৎ একে অর্ধেক হয়ে যেতে যে সময় লাগে—প্রায় ৫৭৩০ বছর। তাই কোনো জৈব পদার্থে (যেমন কাঠ, হাড় বা বস্ত্র) কতটা কার্বন-১৪ অবশিষ্ট আছে, তা মেপে বিজ্ঞানীরা অনুমান করতে পারেন, সেই বস্তুটি কবে মারা গেছে বা বানানো হয়েছিল।
উদাহরণস্বরূপ, ধরা যাক একটি কাঠের খণ্ডে আমরা কার্বন-১৪ এর পরিমাণ দেখতে পেলাম অর্ধেকের সমান হয়ে গেছে। তাহলে বুঝতে পারা যায়, সেটি প্রায় ৫৭৩০ বছর পুরোনো। যদি মাত্র এক-চতুর্থাংশ থাকে, তাহলে বয়স হবে প্রায় ১১,৪৬০ বছর।
কার্বন-১৪ ডেটিং-এর সীমাবদ্ধতা
যদিও এটি একটি কার্যকর পদ্ধতি, তবে এরও সীমা আছে। কার্বন-১৪ ডেটিং শুধুমাত্র জৈব পদার্থের ওপর প্রয়োগ করা যায়—যেমন হাড়, কাঠ, কাপড়, চামড়া ইত্যাদি। এটি দিয়ে পাথর, ধাতব বস্তু বা সিরামিকের বয়স নির্ধারণ করা যায় না। পাশাপাশি, ৫০,০০০ বছরের বেশি পুরোনো কিছু হলে তাতে থাকা কার্বন-১৪ এতটাই কমে যায় যে তা আর নির্ভরযোগ্যভাবে পরিমাপ করা সম্ভব হয় না।
অন্য পদ্ধতিগুলো কী?
কার্বন-১৪ ডেটিং ছাড়াও আরো অনেক আধুনিক পদ্ধতি রয়েছে যেগুলোর মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের জিনিসের বয়স নির্ধারণ করা হয়। নিচে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি পদ্ধতি তুলে ধরা হলো:
১. পটাসিয়াম-আর্গন ডেটিং (Potassium-Argon Dating)
এই পদ্ধতি বিশেষভাবে ব্যবহৃত হয় আগ্নেয়গিরি থেকে উৎপন্ন শিলার বয়স নির্ধারণে। পটাসিয়াম-৪০ নামের একটি তেজস্ক্রিয় মৌল সময়ের সাথে সাথে ধীরে ধীরে আর্গন-৪০ এ রূপান্তরিত হয়। এই রূপান্তরের হার জেনে বিজ্ঞানীরা শিলা বা লাভার বয়স নির্ণয় করতে পারেন।
এটি লক্ষ লক্ষ বছর পর্যন্ত সময় নির্ধারণ করতে সক্ষম। এজন্য এটি বিশেষভাবে ব্যবহৃত হয় ডাইনোসরের যুগ কিংবা পৃথিবীর ভূতাত্ত্বিক ইতিহাস বোঝার জন্য।
২. ইউরেনিয়াম-লেড ডেটিং (Uranium-Lead Dating)
এটি পৃথিবীর প্রাচীনতম খনিজের বয়স নির্ধারণে ব্যবহৃত হয়। ইউরেনিয়াম ধীরে ধীরে ক্ষয় হয়ে সীসে পরিণত হয়। এই ক্ষয়ের হার জানা থাকায়, বিজ্ঞানীরা যদি কোনো খনিজে ইউরেনিয়াম ও সীসের অনুপাত পরিমাপ করেন, তাহলে তারা নির্ধারণ করতে পারেন সেই খনিজের বয়স কত।
এই পদ্ধতিতে এমনকি কয়েক বিলিয়ন বছরের পুরোনো বস্তুর বয়সও নির্ধারণ করা সম্ভব।
৩. থার্মোলুমিনেসেন্স ডেটিং (Thermoluminescence Dating)
এটি মূলত সিরামিক, পোড়ামাটির জিনিস বা আগুনে পোড়া মাটির বয়স নির্ধারণে ব্যবহৃত হয়। যখন কোনো পদার্থকে আগুনে পোড়ানো হয়, তখন তার মধ্যে কিছু ইলেকট্রন ফাঁদে পড়ে যায়। দীর্ঘ সময় পরে এই বস্তুটিকে আবার উত্তপ্ত করলে সেসব ইলেকট্রন আলো বিকিরণ করে। এই আলো বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা বলতে পারেন, কত বছর আগে এটি শেষবার আগুনে গিয়েছিল।
৪. ট্রি-রিং ডেটিং (Dendrochronology)
এই পদ্ধতিতে গাছের বয়স নির্ধারণ করা হয় তার কাণ্ডের রিং গণনা করে। প্রতি বছর গাছে একটি করে রিং যুক্ত হয়। তাই গাছের কাণ্ড কেটে রিংগুলো গুনে সহজেই তার বয়স বোঝা যায়। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন অঞ্চলের গাছের রিং মিলিয়ে স্থানীয় জলবায়ুর ইতিহাসও জানা যায়।
এই পদ্ধতি প্রাচীন কাঠ বা কাঠের তৈরি ভবনের বয়স নির্ধারণেও সাহায্য করে।
৫. আর্কিওম্যাগনেটিক ডেটিং (Archaeomagnetic Dating)
পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের দিক সময়ের সাথে সাথে সামান্যভাবে পরিবর্তিত হয়। যখন মাটি বা মৃৎপাত্র উত্তপ্ত হয়ে ঠাণ্ডা হয়, তখন সেগুলোর কণাগুলো সেই সময়কার চৌম্বকক্ষেত্রের দিকে নিজেকে সাজিয়ে নেয়। পরে সেই চৌম্বকিক দিক নির্ধারণ করে বিজ্ঞানীরা অনুমান করতে পারেন বস্তুটি কবে আগুনে পোড়ানো হয়েছিল।
বিভিন্ন পদ্ধতির ব্যবহারিক প্রয়োগ
বাংলাদেশেও এইসব পদ্ধতির ব্যবহার দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ, মহাস্থানগড়, ময়নামতি বা পানাম নগরের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের বয়স নির্ধারণে কার্বন-১৪ ডেটিং ও থার্মোলুমিনেসেন্স পদ্ধতির ব্যবহার হয়েছে। এছাড়া হিমালয় অঞ্চলের ভূতাত্ত্বিক ইতিহাস বোঝার জন্য পটাসিয়াম-আর্গন ডেটিং ব্যবহৃত হয়েছে।
বয়স নির্ধারণ মানে শুধু সময় গণনা নয়
কোনো বস্তু কত বছরের পুরোনো—এই তথ্যটি নিছক একটুকরো সংখ্যা নয়। এটি আমাদের অতীত বুঝতে সাহায্য করে। প্রাচীন সভ্যতা কখন শুরু হয়েছিল, জলবায়ু কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, মানুষ কীভাবে বিভিন্ন প্রযুক্তি শিখেছে—এইসব প্রশ্নের উত্তর পেতে বয়স নির্ধারণ এক অপরিহার্য মাধ্যম।
উদাহরণস্বরূপ, আফ্রিকার কোনো এলাকায় খুঁজে পাওয়া মানুষের হাড় যদি ৩০,০০০ বছরের পুরোনো হয়, তাহলে বোঝা যায় সেই অঞ্চলটি তখনই বসবাসযোগ্য ছিল। আবার মধ্যপ্রাচ্যে পাওয়া পোড়ামাটির বাসনপত্র যদি ৭,০০০ বছরের পুরোনো হয়, তাহলে বলা যায়, সেই সময়েই কৃষি ও নগর সভ্যতা গড়ে উঠতে শুরু করেছিল।
বাংলাদেশের জন্য এর গুরুত্ব
আমাদের দেশের ইতিহাস হাজার বছরের পুরোনো। মহাস্থানগড়, ওয়ারী-বটেশ্বর, পাহাড়পুর বা ময়নামতি—এসব ঐতিহাসিক স্থান থেকে পাওয়া প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের বয়স নির্ধারণ আমাদের জাতীয় পরিচয় গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিজ্ঞানভিত্তিক বয়স নির্ধারণ পদ্ধতি ছাড়া আমরা কখনোই নির্ভরযোগ্যভাবে বলতে পারতাম না, কোন সভ্যতা কখন গড়ে উঠেছিল, কোথায় মানুষ প্রথম বসতি গড়েছিল।
উপসংহার:
কার্বন-১৪ ডেটিং হোক কিংবা ইউরেনিয়াম-লেড, প্রতিটি বয়স নির্ধারণ পদ্ধতি আমাদের অতীতের দরজা খুলে দেয়। এই বিজ্ঞানসম্মত গবেষণাই আমাদের শেখায়, আমরা কে, কোথা থেকে এসেছি, আর আমাদের সভ্যতা কীভাবে গড়ে উঠেছে। প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে এই পদ্ধতিগুলো আরো নিখুঁত ও বিস্তৃত হচ্ছে, যার ফলে আগামী দিনে হয়তো আমরা আরো স্পষ্টভাবে ইতিহাসের কুয়াশা ভেদ করে দেখতে পারব আমাদের শেকড়।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যদি এসব আধুনিক পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা বাড়ানো হয় এবং বাংলাদেশে প্রয়োজনীয় গবেষণাগার তৈরি করা হয়, তাহলে নিজস্ব ইতিহাস বোঝার ক্ষেত্রে দেশ আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবে। কারণ, ইতিহাস শুধু অতীত নয়—এটি আমাদের ভবিষ্যতের দিশারি।
আপনি যদি আরও জানতে চান, বিজ্ঞান কীভাবে আমাদের অতীতকে ব্যাখ্যা করে, তাহলে নজর রাখুন biggani.org -এ।
আপনার যদি এই লেখাটি নিয়ে প্রশ্ন থাকে বা নতুন কোনো বিষয় জানতে আগ্রহ থাকে, জানাতে ভুলবেন না।
– লেখক
বিজ্ঞান সাংবাদিক
biggani.org
Leave a comment