– মনোযোগ, বিশ্বাস ও নিউরোপ্লাস্টিসিটির গল্প
মানুষ প্রতিদিন কোনো না কোনো রকম ‘ভাবনা’ করে- কখনো সেটা আতঙ্ক, কখনো কৃতজ্ঞতা, কখনো প্রার্থনা। ধর্মীয় বা পার্থিব -নিয়মিত একমুখী ভাবনায় কি সত্যিই মস্তিষ্কে শারীরিক পরিবর্তন ঘটে? নিউরোসায়েন্স এখন বলে: হ্যাঁ, ঘটে। এবং তা নেহাত কম নয়।
🔹 পর্ব ১: “মস্তিষ্ক কি পরিবর্তনশীল?”
বিষয়: Neuroplasticity
নিউরোপ্লাস্টিসিটি হলো মস্তিষ্কের আত্ম-গঠনক্ষমতা। আপনি প্রতিদিন যেভাবে চিন্তা করেন, ব্রেইনের নিউরাল কানেকশনগুলোও সেভাবেই পুনর্গঠিত হয়।
Habitual thinking rewires your brain.
📌 উদাহরণ:
বারবার “আমি পারি না” ভাবলে self-doubt এর সার্কিট শক্তিশালী হয়। প্রতিদিন “আল্লাহ আমার রক্ষা করবেন” বা “আমি কৃতজ্ঞ” ভাবলে তৈরি হয় positive neural loops।
🔹 পর্ব ২: “প্রার্থনার সময় কী ঘটে ব্রেইনে?”
ফাংশনাল MRI (fMRI) দিয়ে দেখা গেছে, নিয়মিত প্রার্থনাকারীদের: Prefrontal cortex বেশি সক্রিয় হয় (মনোযোগ ও আত্মনিয়ন্ত্রণ), Amygdala কম উত্তেজিত হয় (চিন্তা ও ভয় কম), Anterior cingulate cortex সজাগ থাকে (সহানুভূতি, বেদনার অনুভব কমে)।
📚 গবেষণা:
Dr. Andrew Newberg (Neurotheology): নিয়মিত প্রার্থনা বা মেডিটেশনে ব্রেইনের grey matter বাড়ে।
🔹 পর্ব ৩: “ধর্মীয় অভ্যাস বনাম নিউরোসায়েন্স”
ইসলাম, খ্রিস্টান ধর্ম, হিন্দু ধর্ম- সব ধর্মেই নিরবিচারে একমুখী ভাবনার চর্চা আছে। যিকির, নামাজ, জপ, মন্ত্র পাঠ — এগুলো কি শুধু ধর্মীয় আচরণ, না কি Neurological reset?
🔍 গবেষণায় দেখা যায়:
Repetitive spiritual practices মস্তিষ্কে ডেল্টা ও আলফা ওয়েভ বাড়ায় – মানে: শান্তি ও একাগ্রতা।
🔹 পর্ব ৪: “চিন্তা, অনুভব ও বিশ্বাস- সবই রাসায়নিক?”
প্রতিটি ভাবনার সাথে সংশ্লিষ্ট হয় কেমিক্যাল:
ভয় = Cortisol
বিশ্বাস/আস্থা = Oxytocin
প্রশান্তি = Serotonin
উপলব্ধি = Dopamine
🎯 তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি:
নিয়মিত প্রার্থনায় ব্রেইন শেখে- “আমি নিরাপদ”, এবং সেই অনুভব chemical ভাষায়ও প্রতিফলিত হয়।
১২টি তথ্যঃ
✅ ১. মস্তিষ্ক কি পরিবর্তনশীল? – নিউরোপ্লাস্টিসিটির ভূমিকা
মানুষের মস্তিষ্ক স্থির নয়-এটি প্রতিনিয়ত বদলায়। এই বদলানোর ক্ষমতাকে বলে নিউরোপ্লাস্টিসিটি। আপনি প্রতিদিন যা ভাবেন, যা করেন, ব্রেইন সেই অভ্যাসগুলোর জন্য নিজেকে নতুনভাবে গঠন করে। ধরুন আপনি নিয়মিত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন- তাহলে ‘কৃতজ্ঞতামূলক’ নিউরাল সার্কিট শক্তিশালী হয়। একইভাবে, প্রতিদিন উদ্বেগে থাকলে ‘ভয়ের’ সার্কিটগুলো মজবুত হয়।
🔬 নিষ্কর্ষ:
আপনার চিন্তার অভ্যাসই আপনার মস্তিষ্কের ডিজাইন ঠিক করে।
✅ ২. “আপনি যা ভাবেন, আপনি সেটিই হন” – Habitual Thinking এবং Neural Loop
প্রতিদিনের অভ্যাসগত চিন্তা নিউরাল লুপ তৈরি করে। প্রতিবার যখন আপনি একই ধরনের কিছু ভাবেন (ভয়, আশা, দোয়া), তখন মস্তিষ্কে নির্দিষ্ট এক রাস্তা তৈরি হয়। এটাকে বলে Hebbian Theory: “Neurons that fire together, wire together.”
📌 উদাহরণ:
বারবার ভাবছেন “আমি ব্যর্থ”, ব্রেইন সে অনুযায়ী ‘ব্যর্থতার’ রাস্তা তৈরি করবে।
✅ ৩. প্রার্থনার সময় মস্তিষ্কে কী ঘটে?
fMRI গবেষণায় দেখা গেছে, প্রার্থনার সময় কিছু নির্দিষ্ট অংশ সক্রিয় হয়:
Prefrontal Cortex: মনোযোগ, আত্মনিয়ন্ত্রণ।
Amygdala: ভয় নিয়ন্ত্রণ, উদ্বেগ হ্রাস।
Default Mode Network: আত্মচিন্তা, আত্মচেতনার কেন্দ্র।
📊 Newberg দেখিয়েছেন:
নিয়মিত প্রার্থনা Prefrontal Cortex-এ Grey Matter বাড়ায়।
✅ ৪. Mindfulness, Prayer, এবং Gratitude- তাদের স্নায়ুবৈজ্ঞানিক মিল–অমিল
তিনটি অভ্যাসেই মূল লক্ষ্য: মনোসংযোগ, ধৈর্য ও ধ্যান।
Mindfulness: বর্তমান মুহূর্তে মনোযোগ রাখা।
Prayer: বিশ্বাস ও আত্মসমর্পণের মাধ্যমে আত্মনিয়ন্ত্রণ।
Gratitude: ইতিবাচক অনুভব ও সচেতন স্বীকৃতি।
তিনটিই ব্রেইনের একই অঞ্চলকে সক্রিয় করে- Prefrontal Cortex, Insula, Anterior Cingulate Cortex।
✅ ৫. Inner Speech: “আমি একা নই”– নিজের সঙ্গে কথা বলা ও ব্রেইনের প্রতিক্রিয়া
নিজের সঙ্গে কথা বলা (Inner Dialogue) মানুষের একটা স্বাভাবিক মানসিক প্রক্রিয়া। যদি সেটা সচেতন, ইতিবাচক হয় (যেমন: “আল্লাহ আছেন”, “আমি পারবো”), তা আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। Inner Speech সক্রিয় করে Broca’s Area, যা স্পিচ প্রসেসিং-এর কেন্দ্র।
💡 গবেষণায় দেখা যায়:
“Self-talk” anxiety কমাতে সাহায্য করে।
✅ ৬. অসংখ্য “সেম হাবিচুয়াল থট” (Repeated Prayer or Affirmation) মস্তিষ্কে কী পরিবর্তন আনে?
দিনে দিনে এক কথা বারবার বলা (যেমন “আসতাগফিরুল্লাহ” বা “ধন্য আমি”)—মস্তিষ্কে ‘অটোপাইলট বিশ্বাস’ গড়ে তোলে। এটি ব্রেইনে Automation Loop তৈরি করে- যা আচরণ বদলায় কষ্ট ছাড়াই।
📌 নিউরোসায়েন্স বলে:
Habitual thoughts → Habitual wiring → Habitual emotions।
✅ ৭. নিয়মিত কৃতজ্ঞতা চর্চা বনাম উদ্বেগে ডুবে থাকা– দুই চিন্তার নিউরোসায়েন্সিক রেস
কৃতজ্ঞতামূলক চিন্তা বাড়ায় Dopamine ও Serotonin, যা সুখ এবং মেজাজ উন্নত করে। উদ্বেগ বা Rumination বাড়ায় Cortisol, যা দেহে চাপ সৃষ্টি করে।
📊 এক গবেষণায় দেখা গেছে:
Gratitude journaling করলে ২১ দিনের মধ্যে Amygdala কম উত্তেজিত হয়।
✅ ৮. Faith vs. Fear – আপনার বিশ্বাস কি ভয়কে দমন করে?
ভয় হলো আদিম এক প্রতিক্রিয়া (Amygdala origin), যা বিপদের সময় সক্রিয় হয়। কিন্তু বিশ্বাস (Faith) যদি সত্যিকার অনুভব হয়, তাহলে সেটা Prefrontal Cortex দিয়ে ভয়কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
যারা বিশ্বাসের ভিত্তিতে সমস্যা মোকাবিলা করে, তারা সংকটে বেশি স্থির থাকে (Harvard Study 2021)।
✅ ৯. Oxytocin ও Trust Circuit: প্রার্থনার মাধ্যমে আত্মবিশ্বাস ও সম্পর্ক তৈরি
প্রার্থনা বা ধ্যান সময় Oxytocin নিঃসরণ হয়-এই হরমোন ‘Trust Hormone’ নামে পরিচিত। এটি শুধু ঈশ্বরে বিশ্বাস না, অন্য মানুষের সঙ্গেও আন্তরিকতা বাড়ায়।
Anterior Cingulate ও Insula তাতে জড়িত-এগুলো social bonding এবং empathy এর কেন্দ্র।
✅ ১০. Neurotheology: যখন নিউরোসায়েন্স ও ধর্ম একসঙ্গে হাঁটে
Neurotheology হলো এমন একটি শাখা, যেখানে বিজ্ঞানীরা বিশ্লেষণ করেন ধর্মীয় অভিজ্ঞতার স্নায়ুবৈজ্ঞানিক ভিত্তি।
Dr. Andrew Newberg দেখিয়েছেন, প্রার্থনা করলে মস্তিষ্কের সামনে ও পেছনের অংশের মধ্যে কানেকশন বাড়ে।
এমনকি নিরামিষ ভোজন, নিরবতা এবং প্রার্থনা একত্রে “Spiritual Brain Network” গঠন করে।
✅ ১১. দীর্ঘমেয়াদি প্রার্থনার অভ্যাস কি মস্তিষ্ককে রক্ষা করে ডিমেনশিয়া থেকে?
দীর্ঘদিন নিয়মিত নামাজ বা মেডিটেশন করা মানুষদের মাঝে Cognitive Decline-এর হার কম।
কারণ: একাগ্রতা, স্মরণ ও মনোযোগের চর্চা Neurodegeneration প্রতিরোধে সহায়ক।
একটি longitudinal study (2020) জানায়, নিয়মিত প্রার্থনাকারীরা Alzheimer’s এ কম আক্রান্ত হয়।
✅ ১২. Negative vs. Positive Thought Habits: ব্রেইনের কেমিক্যাল ভারসাম্য কেমন হয়?
Negative Thought = Cortisol ↑, Adrenaline ↑, Amygdala overactivity
Positive/Repetitive Prayer = Serotonin ↑, Dopamine ↑, Prefrontal control ↑
তাই শুধু ভাবনার ধরনেই মস্তিষ্কের কেমিস্ট্রি বদলে যায়।
🔚 আমার কথা:
প্রতিদিন আপনি যা ভাবেন, আপনি তাতেই পরিণত হন। নিউরোসায়েন্স আজ তা প্রমাণ করতে পারছে-মানুষের মস্তিষ্ক শুধু তথ্যের ধারক নয়, এটি চিন্তার প্রতিচ্ছবি। সতর্ক ও সচেতন চিন্তা অভ্যাস আপনার ভবিষ্যতের ব্রেইন তৈরি করতে পারে।
(References) —
1. Doidge, N. (2007). The Brain That Changes Itself: Stories of Personal Triumph from the Frontiers of Brain Science. Viking Penguin. – নিউরোপ্লাস্টিসিটির ব্যাপক আলোচনা।
2. Hebb, D. O. (1949). The Organization of Behavior: A Neuropsychological Theory. Wiley. – Hebbian theory: “Neurons that fire together wire together.”
3. Newberg, A. B., & Waldman, M. R. (2006). Why We Believe What We Believe: Uncovering Our Biological Need for Meaning, Spirituality, and Truth. Free Press. – Neurotheology ও প্রার্থনার সময় মস্তিষ্কের পরিবর্তন।
4. Newberg, A. B., d’Aquili, E. G., & Rause, V. (2001). Why God Won’t Go Away: Brain Science and the Biology of Belief. Ballantine Books. – ধর্মীয় অভিজ্ঞতা ও মস্তিষ্কের কার্যক্রম।
5. Davidson, R. J., & Lutz, A. (2008). Buddha’s Brain: Neuroplasticity and Meditation. IEEE Signal Processing Magazine, 25(1), 176-179. – মেডিটেশন ও মনোযোগের স্নায়ুবৈজ্ঞানিক প্রভাব।
6. Emmons, R. A., & McCullough, M. E. (2003). Counting blessings versus burdens: An experimental investigation of gratitude and subjective well-being in daily life. Journal of Personality and Social Psychology, 84(2), 377-389. – কৃতজ্ঞতার প্রভাব ও স্নায়ুবিজ্ঞানের দিক।
7. Sapolsky, R. M. (1998). Why Zebras Don’t Get Ulcers. W.H. Freeman and Company. – স্ট্রেস, কর্টিসল এবং ব্রেইনের রসায়ন।
8. Harvard Medical School (2021). Study on faith and resilience in stress management. – Faith and its role in reducing anxiety and stress.
9. Kosfeld, M., Heinrichs, M., Zak, P. J., Fischbacher, U., & Fehr, E. (2005). Oxytocin increases trust in humans. Nature, 435(7042), 673-676. – অক্সিটোসিনের মাধ্যমে বিশ্বাস ও সামাজিক বন্ধন।
10. Masters, K. S., & Spielmans, G. I. (2007). Prayer and health: Review, meta-analysis, and research agenda. Journal of Behavioral Medicine, 30(4), 329-338. – প্রার্থনা ও স্বাস্থ্য সম্পর্কিত গবেষণা।
11. Larson, D. B., Swyers, J. P., & McCullough, M. E. (1998). Scientific research on spirituality and health: A consensus report. Journal of Behavioral Medicine, 21(6), 555-560. – আধ্যাত্মিকতা ও মানসিক স্বাস্থ্য।
12. Prakash, R., & Kumar, A. (2020). Meditation and cognitive decline prevention in aging: A review. Frontiers in Psychology, 11, 1352. – মেডিটেশন ও আলঝেইমার রোগের ঝুঁকি হ্রাস।
13. Siegel, D. J. (2012). The Developing Mind: How Relationships and the Brain Interact to Shape Who We Are. Guilford Press. – ব্রেইনের বিকাশ ও সম্পর্কের স্নায়ুবৈজ্ঞানিক ভিত্তি।
14. MacLean, P. D. (1990). The triune brain in evolution: Role in paleocerebral functions. Plenum Press. – ব্রেইনের অংশগুলোর কার্যকরী বিবরণ।
মো. ইফতেখার হোসেন
চিকিৎসা শিক্ষার্থী, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ | নিউরোসায়েন্স, অভ্যাস গঠন ও মানুষের মস্তিষ্কের আচরণগত পরিবর্তন নিয়ে আগ্রহী।
Leave a comment