বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ, যেখানে দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০% কৃষির উপর নির্ভরশীল। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষিতে বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। ২০২০ সালে, দেশের মোট ফসলের উৎপাদন খরার কারণে প্রায় ১৫-২০% কমে যায়। আর্গিভোল্টেইক প্রযুক্তি ব্যবহার করে, সৌর প্যানেলের ছায়া ফসলকে তাপমাত্রা ও অতিরিক্ত রোদ থেকে রক্ষা করতে পারে, যা কৃষকদের ফসলের উৎপাদন বাড়াতে সাহায্য করবে। নতুন এই আর্গিভোল্টেইক বা Agrivoltaics প্রযুক্তি এর অপর নাম সৌরকৃষি। বিজ্ঞানীরা আশাবাদী যে নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে এই সংকট কিছুটা হলেও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
কী এই সৌরকৃষি?
সৌর কৃষি হলো এক ধরনের প্রযুক্তি যেখানে কৃষি ও সৌর শক্তিকে একসাথে ব্যবহার করা হয়। সহজ ভাষায় বললে, কৃষি জমির উপর সৌর প্যানেল স্থাপন করে একই সাথে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও ফসল উৎপাদন করা হয়। আর্গিভোল্টেইক কৌশলে সূর্যের আলো ফসল এবং সৌর প্যানেল উভয়ের জন্যই ব্যবহার করা হয়, ফলে জমির উৎপাদনশীলতা বাড়ে এবং কৃষকরা অতিরিক্ত আয় করতে পারেন।
কীভাবে সৌর কৃষি কাজ করে?
আর্গিভোল্টেইক পদ্ধতিতে, সৌর প্যানেলগুলো কৃষি জমির উপরে কিছুটা উঁচু করে স্থাপন করা হয়। প্যানেলগুলো সূর্যের আলো থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে, আর প্যানেলের ছায়া ফসলের উপর পড়ে, যা অতিরিক্ত তাপ থেকে ফসলকে রক্ষা করে। এই পদ্ধতিতে ফসলের বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় সূর্যালোক এবং ছায়ার মধ্যে ভারসাম্য রাখা হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, ফসলের গুণগত মান বজায় রেখে সৌর প্যানেল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। এমনকি, কিছু ক্ষেত্রে ফসলের উৎপাদন ক্ষমতাও বেড়ে গেছে। বিশেষ করে শুষ্ক অঞ্চলে যেখানে তাপমাত্রা বেশি, সেখানে ফসলের জন্য এই ছায়া খুবই উপকারী।
সৌর কৃষির সুবিধা
১. বিদ্যুৎ উৎপাদন ও ফসল চাষ একসাথে: আর্গিভোল্টেইক ব্যবস্থায় কৃষকরা বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে, যা তাদের অতিরিক্ত আয়ের সুযোগ দেয়।
২. জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়ানো: প্রচণ্ড গরমে ফসল নষ্ট হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব, কারণ সৌর প্যানেলগুলো থেকে ছায়া ফসলকে অতিরিক্ত তাপ থেকে রক্ষা করে।
৩. পানি সাশ্রয়: সৌর প্যানেল থেকে ছায়া পড়ার কারণে মাটিতে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ কমে যায়, ফলে পানির প্রয়োজনীয়তাও কম হয়।
৪. কার্বন নিঃসরণ কমানো: সৌর শক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব, যা কার্বন নিঃসরণ কমাতে সহায়ক।
বর্তমান অবস্থা
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে (জুলাই ২০২৪ অনুযায়ী) প্রায় ৫৩০টি আর্গিভোল্টেইক সাইট রয়েছে। এর প্রায় অর্ধেকই পলিনেটর আবাসস্থল এবং বাকি অর্ধেক সাইটে সৌর চারণভূমির ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া জার্মানী, ফ্রান্স, জাপান, এবং চীনে এই সংক্রান্ত বেশ কাজ হচ্ছে এবং তারাও এই প্রযুক্তিটি প্রয়োগ নিয়ে আশাবাদি।
বাংলাদেশের সম্ভাবনা
বাংলাদেশে সৌর কৃষি পদ্ধতি সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে এটি দেশের কৃষি ও বিদ্যুৎ উভয় ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে।
১. কৃষকের আয় বৃদ্ধি: কৃষকরা একই সাথে ফসল উৎপাদন ও সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারবে, যা তাদের আয় বাড়াতে সাহায্য করবে।
২. জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা: সৌর প্যানেলের ছায়ায় ফসল তাপমাত্রার অতিরিক্ত চাপ থেকে রক্ষা পাবে, ফলে খরা এবং অন্যান্য জলবায়ু সংকট থেকে কৃষকরা রক্ষা পাবে।
চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
যদিও সৌর কৃষির অনেক সুবিধা রয়েছে, এর কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। যেমন, সৌর প্যানেল স্থাপনের খরচ অনেক বেশি, যা অনেক ছোট কৃষকের জন্য সাধ্যের বাইরে। এছাড়াও, সৌর প্যানেল স্থাপনের জন্য কিছু পরিমাণ জমি ব্যবহার করা লাগে, যা ফসলের জমি থেকে কমানো হতে পারে। তবে, বিজ্ঞানীরা এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করছেন এবং বিভিন্ন সরকারী উদ্যোগের মাধ্যমে এই প্রযুক্তির প্রচার ও প্রসার করা হচ্ছে।
উপসংহার
আর্গিভোল্টেইক বা সৌর কৃষি একটি নতুন সম্ভাবনাময় পদ্ধতি, যা কৃষি ও শক্তি উৎপাদনে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে পারে। এটির সঠিক বাস্তবায়নের মাধ্যমে কৃষকরা ফসলের পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করে দ্বিগুণ লাভ করতে পারবেন। জলবায়ু পরিবর্তনের এই সময়ে, সৌর কৃষি এক নতুন দিগন্ত খুলে দিচ্ছে, যা আমাদের পৃথিবীকে আরও টেকসই ও পরিবেশবান্ধব করতে পারে।
তথ্যসূত্র: https://www.sciencenews.org/article/solar-agriculture-farming-argivoltaic
Leave a comment