নিউজ ডেস্ক, বিজ্ঞানী অর্গ
এক সেকেন্ডকে যদি আপনি “এক-হাজার এক… দুই-হাজার দুই…” করে গুনে অনুভব করার চেষ্টা করেন, তবে ভাবুন তো—এক সেকেন্ডকে যদি ভাগ করা হয় এক বিলিয়ন বিলিয়ন ভাগে? সেটিই হলো একটি অ্যাটোসেকেন্ড—অর্থাৎ ০.০০০০০০০০০০০০০০০০০১ সেকেন্ড। এতো ছোট সময় যে মানুষের পক্ষে তা কল্পনাও কঠিন। কিন্তু ইলেকট্রন, পরমাণু ও অণুর জন্য এই সময়টুকুই যথেষ্ট একেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদার্থগত বা রাসায়নিক ঘটনা ঘটাতে।
অ্যাটোসেকেন্ড: সময়ের অতল গহ্বর
বর্তমান পৃথিবীতে সবচেয়ে দ্রুতগামী বিজ্ঞানচর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে এই অ্যাটোসেকেন্ড ফিজিক্স। বিজ্ঞানীরা এখন এমন লেজার প্রযুক্তির সাহায্যে এই অতি-ক্ষুদ্র সময়ের ঘটনাগুলো ধরতে পারছেন, যেখানে একেকটি ইলেকট্রন তার অবস্থান বদলাচ্ছে, অণুর বন্ধন গঠিত বা ভাঙছে, কিংবা আলো-ইলেকট্রনের মিথস্ক্রিয়ায় পরিবর্তিত হচ্ছে শক্তি।
ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলে-র পদার্থ-রাসায়নবিদ স্টিফেন লিওনে বলেন—এই অত্যন্ত ক্ষুদ্র সময়ের ছবি দেখা গেলে অনেক গোপন রাসায়নিক কার্যক্রমকে বোঝা সম্ভব, যা আগে শুধু তত্ত্বে সীমাবদ্ধ ছিল।
কেন অ্যাটোসেকেন্ড বিজ্ঞান এত গুরুত্বপূর্ণ?
ইলেকট্রন যখন পরমাণুর চারপাশে ঘোরে, তার একটি “অরবিটাল” সম্পূর্ণ করতে সময় লাগে মাত্র ১ থেকে ১,০০০ অ্যাটোসেকেন্ড। এই সময়েই সে হয়ত একটি বন্ধন তৈরি করছে বা ভাঙছে, কিংবা অণুর গঠন বদলে দিচ্ছে।
এই সময়পর্যায়ে যা ঘটে তা হলো:
- ফোটনের আঘাতে ইলেকট্রন উত্তেজিত হয়ে উচ্চ শক্তির স্তরে যায়
- ইলেকট্রন অন্য অণুর সঙ্গে বন্ধনে আবদ্ধ হয় অথবা আলাদা হয়ে আয়ন তৈরি করে
- ফোটন নির্গত হয় যা বিজ্ঞানীদের কাছে স্পেকট্রোস্কোপিক সিগন্যাল দিয়ে দেয় ঘটনাটির ব্যাখ্যা
এই সব ঘটনাই অত্যন্ত দ্রুত এবং সূক্ষ্ম। অ্যাটোসেকেন্ড পর্যবেক্ষণ না থাকলে এগুলো একরকম অদৃশ্যই থেকে যেত।
কীভাবে হয় এই গবেষণা?
এই গবেষণার পেছনে রয়েছে হাই হারমোনিক জেনারেশন (HHG) নামক একটি প্রযুক্তি—যার বিকাশকারীরা ২০২৩ সালের নোবেল পুরস্কার পান। এই পদ্ধতিতে:
- একটি ফেমটোসেকেন্ড লেজার (১০^-১৫ সেকেন্ড) দিয়ে একটি গ্যাসে ইলেকট্রনের কম্পন ঘটানো হয়
- ইলেকট্রন আবার শক্তি দিয়ে নতুন আলো তৈরি করে, যা আরও ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের (UV বা X-ray)
- এই আলোকে ব্যবহার করে “পাম্প-প্রোব” স্টাডি চালানো হয়—যার মাধ্যমে একেকটি ইলেকট্রনের আচরণ রেকর্ড করা সম্ভব হয়
স্পেকট্রোস্কোপি ও জীববিজ্ঞানের সংযোগ
ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট-এর ড্যানিয়েল কিফার জানাচ্ছেন—এই প্রযুক্তি এখন এমন জৈব অণু যেমন DNA বা RNA নিয়ে গবেষণায় ব্যবহৃত হচ্ছে। সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি আমাদের DNA ভেঙে দিতে পারে, কিন্তু এই অণুগুলো সেই শক্তি খুব দ্রুতভাবে নির্গত করে আবার নিচু শক্তির স্তরে ফিরে যায়। এই প্রতিরক্ষামূলক প্রতিক্রিয়া এতই দ্রুত ঘটে যে DNA-তে ক্ষতি হবার সম্ভাবনা অনেক কমে যায়।
অ্যাটোসেকেন্ড পর্যবেক্ষণ প্রযুক্তি দিয়ে এখন এই প্রতিক্রিয়া পর্যালোচনা করে দেখা সম্ভব—যা ভবিষ্যতে ক্যানসার, জেনেটিক ডিজঅর্ডার ইত্যাদি গবেষণায় সহায়ক হতে পারে।
অজানা জগৎ: ডার্ক ম্যাটার ও কোয়ান্টাম ভ্যাকুয়াম
জে ইউন, যুক্তরাষ্ট্রের JILA গবেষণা কেন্দ্র থেকে অ্যাটোসেকেন্ড ফিজিক্স ব্যবহার করে এমন কিছু অনুসন্ধান চালাচ্ছেন যার লক্ষ্য—ডার্ক ম্যাটার শনাক্ত করা। তাঁর পরিকল্পনা একটি নতুন ধরনের ঘড়ি—নিউক্লিয়ার ক্লক তৈরি করা, যা পরমাণুর নিউট্রন ও প্রোটন পর্যবেক্ষণ করে এমন শক্তির সূক্ষ্মতম পরিবর্তন ধরতে পারবে—যা হয়ত ডার্ক ম্যাটারের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে।
অন্যদিকে, গবেষক গিলাসপি বলছেন—যদি আমরা আরও শক্তিশালী লেজার তৈরি করতে পারি, তবে হয়ত আমরা কোয়ান্টাম ভ্যাকুয়ামে থাকা ভার্চুয়াল কণাকে বাস্তব কণায় পরিণত করতে পারব। আজ পর্যন্ত এই কণা শুধু তত্ত্বে ছিল; কিন্তু অ্যাটোসেকেন্ড পর্যবেক্ষণ আমাদের সেই ‘শূন্যতা’র মাঝেও পদার্থ খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা দেখাচ্ছে।
গবেষণাগারের রহস্যময়তা
এই গবেষণাগুলো হয় একান্ত নীরব, কম্পনহীন পরীক্ষাগারে—যেখানে অত্যন্ত জটিল লেন্স, ক্রিস্টাল, লেজার বিভাজক, টাইম ডিলেই সেটআপ ইত্যাদি সঠিকভাবে সাজানো থাকে। ভ্যাকুয়াম চেম্বারে পরীক্ষা চলে যাতে বাতাস বা দূষিত কণা লেজার রশ্মির তথ্য নষ্ট করতে না পারে।
একজন গবেষক একে বলেছিলেন—“এই জটিল যন্ত্রপাতিগুলো মূলত বিশ্বের সবচেয়ে ছোট ‘ঘটনাগুলো’ ক্যামেরায় ধরার চেষ্টা।”
উপসংহার: ভবিষ্যতের পথ
যখন বিজ্ঞানীরা এই ধরনের গবেষণায় মগ্ন হন, তখন তারা জানেন না কোথায় গিয়ে পৌঁছাবেন। একসময় নিউক্লিয়ার ফিজিক্স থেকে বের হয়েছিল MRI, এক্স-রে, রেডিওথেরাপি। তেমনি অ্যাটোসেকেন্ড বিজ্ঞান হয়ত আমাদের নিয়ে যাবে ক্যানসার শনাক্তকরণ, জিন মেরামত, নতুন রাসায়নিক আবিষ্কার কিংবা মহাবিশ্বের অজানা পদার্থ (ডার্ক ম্যাটার) বোঝার এক নতুন যুগে।
অ্যাটোসেকেন্ড সময়ের মাঝে ঘটে যাওয়া এই ঘটনা আমাদের বোঝায়—বৃহৎ পরিবর্তন অনেক সময় ক্ষুদ্রতম মুহূর্তেই শুরু হয়।
✍️ লেখাটি প্রস্তুত করেছেন নিউজ ডেস্ক, বিজ্ঞানী অর্গ
📬 যোগাযোগ: [email protected]
Leave a comment