✍️ নিউজ ডেস্ক, বিজ্ঞানী অর্গ |
📧 [email protected]
🔥 সূর্যের শক্তি পৃথিবীতে আনতে চাইছে বিজ্ঞানীরা
কল্পনা করুন, এমন একটি শক্তির উৎস যা প্রায় অনন্তকাল টিকে থাকতে পারে, যার জ্বালানি তৈরি হয় সাধারণ সমুদ্রের পানি থেকে, এবং যার প্রক্রিয়ায় ক্ষতিকর কার্বন নিঃসরণ বা পারমাণবিক বর্জ্য থাকে না। এমন শক্তি উৎপাদন সম্ভব হলে পৃথিবীর জ্বালানি সংকটের যুগান্তকারী সমাধান হতে পারে। এই স্বপ্নের নাম “নিয়ন্ত্রিত নিউক্লিয়ার ফিউশন”।
সম্প্রতি ইউরোপের দুটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান—জার্মানির Wendelstein 7-X ও ব্রিটেনের Joint European Torus (JET)—নিয়ন্ত্রিত ফিউশন রিয়্যাকশনে নতুন রেকর্ড স্থাপন করেছে। অনেক বিজ্ঞানীর মতে, এই সাফল্য আমাদের বহু প্রতীক্ষিত ফিউশন পাওয়ার প্ল্যান্টের আরও কাছাকাছি নিয়ে এসেছে।
☀️ ফিউশন কী?
সাধারণভাবে বললে, ফিউশন হলো সেই প্রক্রিয়া যেখানে দুটি হালকা পরমাণু (যেমন: ডিউটেরিয়াম ও ট্রাইটিয়াম) একত্র হয়ে একটি ভারী পরমাণু তৈরি করে এবং সেই সময় প্রচুর পরিমাণে শক্তি উৎপন্ন হয়। এটি ঠিক সূর্যের ভেতরে যেভাবে শক্তি তৈরি হয়, সেই রকম।
তবে এই প্রক্রিয়াটি পৃথিবীতে কৃত্রিমভাবে তৈরি করা ভীষণ কঠিন, কারণ ফিউশনের জন্য অত্যন্ত উচ্চ তাপমাত্রা ও চাপে হাইড্রোজেন গ্যাসকে ‘প্লাজমা’ অবস্থায় রাখতে হয়। প্লাজমা মানে হলো, এমন একটি অবস্থা যেখানে গ্যাসের পরমাণু গলে গিয়ে ইলেকট্রন ও নিউক্লিয়াস আলাদা হয়ে যায়।
🌐 কেন ফিউশন গুরুত্বপূর্ণ?
ফিউশন শক্তির ভবিষ্যৎ প্রভাব বিশাল:
- জ্বালানির প্রাচুর্য: সমুদ্রের পানিতে থাকা হাইড্রোজেন ফিউশনের জন্য যথেষ্ট।
- পরিবেশবান্ধব: এতে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হয় না।
- পারমাণবিক বর্জ্য নেই: ফিউশন শক্তির কোনো দীর্ঘমেয়াদি বিষাক্ত পারমাণবিক বর্জ্য তৈরি হয় না।
- নিরাপদ: ফিউশনের প্রক্রিয়ায় ‘নিউক্লিয়ার মেল্টডাউন’ হওয়ার আশঙ্কা নেই।
🧪 দুই প্রতিযোগী: Wendelstein বনাম JET
জার্মানির Wendelstein 7-X একটি “স্টেলারেটর” ধরনের ফিউশন রিয়্যাক্টর, যা প্লাজমাকে শক্তিশালী চুম্বকীয় বল দিয়ে ঘিরে রাখে। এই রিয়্যাক্টর সম্প্রতি ৪৩ সেকেন্ড ধরে প্লাজমা ধরে রাখতে পেরেছে—এটি একটি নতুন রেকর্ড।
অন্যদিকে, ব্রিটেনের JET রিয়্যাক্টর, যা “টোকামাক” ধরনের, ৬০ সেকেন্ড ধরে প্লাজমা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। যদিও JET তিন গুণ বড়, কিন্তু তবুও দুই গবেষণা কেন্দ্রই এই প্রযুক্তির দৌড়ে প্রায় সমান তালে এগিয়ে চলছে।
🌀 স্টেলারেটর বনাম টোকামাক: পার্থক্য কী?
টোকামাক:
- রাশিয়ায় উদ্ভাবিত
- আকারে ডোনাটের মতো
- প্লাজমার ভিতরে ইলেকট্রিক কারেন্ট প্রবাহিত করে স্থিতিশীলতা আনে
- নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে তুলনামূলক সহজ
স্টেলারেটর:
- জটিল চুম্বকীয় নকশা ব্যবহার করে
- প্লাজমার ভিতরে কোনো কারেন্ট প্রবাহিত করে না
- দীর্ঘ সময় ধরে প্লাজমা স্থির রাখার ক্ষেত্রে এগিয়ে
জার্মান প্রকল্পটির প্রধান বিজ্ঞানী ড. থমাস ক্লিনগার বলেন, “আমরা এখন এমন এক অবস্থায় পৌঁছেছি, যেখানে আমরা আধা ঘণ্টার বেশি সময় ধরে প্লাজমা চালাতে পারার সম্ভাবনা দেখছি।”
💡 অন্য পদ্ধতি: লেজার ভিত্তিক ফিউশন (Inertial Confinement)
যুক্তরাষ্ট্রের National Ignition Facility (NIF) ২০২২ সালে একটি অসাধারণ অর্জন করে—লেজার দিয়ে একটি ছোট ডিউটেরিয়াম-ট্রাইটিয়াম গোলককে উত্তপ্ত করে এমন ফিউশন ঘটানো যায়, যাতে ইনপুটের চেয়ে বেশি শক্তি উৎপন্ন হয়।
তবে সমস্যা হলো—একটি সফল এক্সপেরিমেন্টের জন্য ১৯২টি লেজার ব্যবহার করে ১২ ঘণ্টা চার্জ করতে হয়, যা অনেক বেশি শক্তি খরচ করে। দীর্ঘমেয়াদি বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রতি সেকেন্ডে ১০টি প্যালেট ফিউশন ঘটাতে হবে—এটি বিশাল এক প্রকৌশল চ্যালেঞ্জ।
🚀 প্রাইভেট কোম্পানিগুলোর প্রতিযোগিতা
এখন শুধু সরকারি গবেষণাগার নয়, অনেক প্রাইভেট কোম্পানিও এই দৌড়ে শামিল হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ:
- General Fusion (কানাডা): ম্যাগনেটাইজড টার্গেট ফিউশন (MTF) ব্যবহার করছে—যা ডিজেল ইঞ্জিনের মতো সহজ ও টেকসই।
- Commonwealth Fusion Systems (MIT): ভার্জিনিয়াতে ARC নামের একটি কমপ্যাক্ট টোকামাক রিয়্যাক্টর তৈরি করছে, যা ২০৩০ সালের শুরুর দিকেই ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারবে বলে আশা।
🧲 সুপারকন্ডাক্টিং ম্যাগনেট: গেম চেঞ্জার?
এই নতুন ধরনের চুম্বক ঠান্ডা হেলিয়ামের সাহায্যে শূন্য ডিগ্রির কাছাকাছি ঠান্ডা করে বিদ্যুৎ প্রতিরোধ শূন্য করা হয়। এর ফলে তৈরি হয় অত্যন্ত শক্তিশালী চুম্বকীয় বল, যা প্লাজমাকে কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখে।
ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ার টনি রুলস্টোন মনে করেন, “এই সুপারকন্ডাক্টিং চুম্বকই আমাদের ফিউশন শক্তির বাস্তবায়নের কাছাকাছি নিয়ে আসছে।”
⚖️ ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা
বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিত নন, টোকামাক না স্টেলারেটর—কোন প্রযুক্তি শেষ পর্যন্ত সফল হবে। হয়তো ভবিষ্যতের রিয়্যাক্টরগুলো এই দুই প্রযুক্তির সমন্বয়ে তৈরি হবে। তবে একথা নিশ্চিত, নিয়ন্ত্রিত নিউক্লিয়ার ফিউশনের পথে আমরা আগের চেয়ে অনেক দূর এগিয়ে এসেছি।
নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ার জর্জ টাইন্যানের ভাষায়, “ফিউশন প্রযুক্তি এখনো বহু বছর গবেষণার পথ পেরোতে হবে, কিন্তু সম্ভবত দুটো পদ্ধতিই শেষ পর্যন্ত কাজ করবে।”
📚 পাঠকদের জন্য পরামর্শ
ফিউশন প্রযুক্তি নিয়ে আরও জানতে চাইলে পড়তে পারেন:
- The Future of Fusion Energy – Jason Parisi & Justin Ball
- Sun in a Bottle – Charles Seife
- Introduction to Plasma Physics – Francis F. Chen
- Physics of Solar Energy – C. Julian Chen
- Plasma Physics and Fusion Energy – Jeffrey Freidberg
- Energy, Environment, and Climate – Richard Wolfson
- The Physics of Inertial Fusion – Stefano Atzeni & Jurgen Meyer-ter-Vehn
- Nuclear Fusion: Half a Century of Magnetic Confinement Fusion Research – C.M. Braams
- Making Starshine on Earth – Daniel Clery
- Fusion: Science, Politics, and the Invention of a New Energy Source – Garry McCracken
✨ উপসংহার
আজকের ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক ও সাধারণ পাঠকের কাছে ফিউশন শুধু বিজ্ঞানের এক কল্পনা নয়—এটি এক সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ। যখন আমাদের সামনে জ্বালানি সংকট, জলবায়ু পরিবর্তন ও জীবাশ্ম জ্বালানির সীমাবদ্ধতা ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে, তখন ফিউশন শক্তি হতে পারে সেই ‘সূর্য’, যা আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য আলোকবর্তিকা হয়ে দাঁড়াবে।
বিজ্ঞানী অর্গের পক্ষ থেকে আপনাদের প্রতি আহ্বান—জানুন, বোঝুন, এবং বিজ্ঞানের আশার আলোয় পথ চলুন। 🌍⚛️
📩 আপনার মতামত ও প্রশ্ন পাঠান: [email protected]
Leave a comment