আমাদের শরীরের প্রতিটি ক্ষুদ্র কোষে যে উপাদানটি জীবনের মানচিত্র ধারণ করে, তা হলো ডিএনএ বা ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড। ডিএনএ কেবল জিনগত তথ্য বহন করে না, এটি আমাদের অস্তিত্ব, গঠন ও বিকাশের মূল চাবিকাঠি।
ডিএনএ কতটা বিশাল?
একজন মানুষের শরীরে প্রায় ৩৭ ট্রিলিয়ন কোষ থাকে। প্রতিটি কোষে যদি ডিএনএর দৈর্ঘ্য ২ মিটার ধরা হয়, তাহলে সব ডিএনএ মিলে মোট দৈর্ঘ্য দাঁড়ায় প্রায় ৭৪ ট্রিলিয়ন মিটার! এই দৈর্ঘ্য দিয়ে পৃথিবী থেকে প্লুটো পর্যন্ত ১৭ বার যাওয়া-আসা করা সম্ভব। এমন একটি বিশাল তথ্যভাণ্ডার কীভাবে আমাদের ক্ষুদ্র কোষের নিউক্লিয়াসে গুটিয়ে থাকে, সেটাই বিজ্ঞানের এক বিস্ময়।
কে আবিষ্কার করেছিলেন ডিএনএ?
ডিএনএ প্রথম আবিষ্কারের কৃতিত্ব দেওয়া হয় সুইস জীববিজ্ঞানী ফ্রেডরিখ মিশার-কে। ১৮৬৯ সালে তিনি ডিএনএ শনাক্ত করেন “নিউক্লিন” নাম দিয়ে। তবে ডিএনএ যে আমাদের জিনগত উপাদান বহন করে, তা প্রমাণ করেন বিজ্ঞানী জেমস ওয়াটসন এবং ফ্রান্সিস ক্রিক ১৯৫৩ সালে। তারা ডিএনএর বিখ্যাত ডাবল হেলিক্স (Double Helix) গঠন প্রকাশ করেন, যার ভিত্তি ছিল রোজালিন্ড ফ্র্যাঙ্কলিনের এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফি চিত্র। এই আবিষ্কার জীববিজ্ঞানে এক যুগান্তকারী মাইলফলক তৈরি করে।
ডিএনএ কেন গুরুত্বপূর্ণ?
১. জিনগত তথ্য বহনকারী: ডিএনএ আমাদের গায়ের রং, চোখের রঙ, উচ্চতা, এমনকি রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতারও দিক নির্দেশনা দেয়।
২. আধুনিক চিকিৎসা ও রোগ নির্ণয়ে বিপ্লব: ডিএনএ বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা জেনেটিক রোগ শনাক্ত করতে পারেন, যেমন থ্যালাসেমিয়া, সিস্টিক ফাইব্রোসিস, এমনকি কিছু ক্যান্সার।
৩. ফরেনসিক বিজ্ঞানে ব্যবহার: অপরাধ তদন্তে ডিএনএ প্রোফাইলিং অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। একটি মাত্র চুল কিংবা রক্তবিন্দু থেকেও অপরাধী শনাক্ত করা যায়।
৪. উন্নত কৃষি ও প্রাণিসম্পদ: জিন প্রযুক্তির মাধ্যমে এখন উন্নত জাতের ফসল ও প্রাণি তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে।
ভবিষ্যৎ কী বলছে?
জিনোম এডিটিং, বিশেষ করে CRISPR-Cas9 প্রযুক্তির মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা এখন ডিএনএর নির্দিষ্ট অংশ কেটে বা বদলে দিয়ে জেনেটিক রোগ নিরাময়ের সম্ভাবনা তৈরি করছেন। ব্যক্তিগত জিনতত্ত্ব (personal genomics) এবং প্রিসিশন মেডিসিন (precision medicine) এর মাধ্যমে ভবিষ্যতের চিকিৎসা হবে আরো নির্ভুল, লক্ষ্যভিত্তিক এবং ব্যক্তি অনুযায়ী মানিয়ে নেওয়ার উপযোগী।
ডিএনএ বিশ্লেষণের মাধ্যমে পূর্বপুরুষের ইতিহাস, রোগের সম্ভাবনা, এমনকি খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কেও পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হচ্ছে।
শেষ কথা:
একটি মাত্র কোষের নিউক্লিয়াসে এত বিশাল তথ্য যেভাবে সংরক্ষিত থাকে, তা কেবল প্রকৃতির অসাধারণ সৃষ্টি নয়, বরং আমাদের জন্য একটি জ্ঞানের ভাণ্ডার। ডিএনএকে জানলেই আমরা নিজেরাই আরও ভালোভাবে জানতে পারবো — কে আমরা, কীভাবে গঠিত হয়েছি, এবং ভবিষ্যতে কী হতে পারি।
আপনি কি জানতে চান কীভাবে ডিএনএ টেস্ট করা হয় বা কিভাবে নিজের পূর্বপুরুষের ইতিহাস জানা যায় ডিএনএর মাধ্যমে? মন্তব্যে জানাতে ভুলবেন না।
Leave a comment