সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের তথ্য পাওয়ার নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছে। প্রতিদিন আমরা হাজারো পোস্ট, ভিডিও এবং মন্তব্য দেখি—যার অনেকগুলোই সত্যিকার অর্থে আমাদের চিন্তাভাবনায় প্রভাব ফেলে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই তথ্যগুলোর কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য? আমরা কি সত্যিই একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাচ্ছি, নাকি শুধু এক টুকরো স্ন্যাপশট?
ধরুন, আপনি একটি মন্তব্য দেখলেন—একজনের কণ্ঠস্বর, একটি ক্লিপ, একটি স্ট্যাটাস। এটি হয়তো গুরুত্বহীন কারও কল্পনাপ্রসূত মতামত, কিন্তু ভাইরাল হয়ে যাওয়ার কারণে সেটি হয়ে উঠছে ‘গুরুত্বপূর্ণ’। সোশ্যাল মিডিয়ার এই ‘ভাইরাল’ সংস্কৃতি এমন এক দিক নির্দেশ করে, যেখানে কে কতটা সাড়া ফেলতে পারছে সেটাই হয়ে দাঁড়ায় গুরুত্বের মাপকাঠি। অথচ একজন বিশেষজ্ঞের মূল্যবান বিশ্লেষণ হয়তো হারিয়ে যাচ্ছে ভিউ বা লাইক কম হওয়ার কারণে। এতে করে আমরা একটি বিভ্রান্তিকর বাস্তবতায় বাস করছি।
এখানেই সোশ্যাল মিডিয়ার বড় সীমাবদ্ধতা—এখানে তথ্যের মান নির্ধারিত হয় লাইক, শেয়ার, ও কমেন্টের ভিত্তিতে; বিশ্বাসযোগ্যতা বা পেশাগত দক্ষতার ভিত্তিতে নয়। এতে তথ্যের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয় এবং সমাজের ভেতরে ভুল তথ্য ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বাড়ে। অনেক ক্ষেত্রেই ভুল বা বিভ্রান্তিকর তথ্য মানুষের আচরণ, মতামত এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে।
সাংবাদিকতার প্রচলিত রীতিতে একজন পেশাদার সাংবাদিক কোনো একটি বিষয়ে রিপোর্ট করতে গেলে, তিনি শুধু একটি বক্তব্য তুলে ধরেন না। বরং তিনি ঘটনার প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করেন, বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেন এবং সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতামত নেন। একজন সাংবাদিক অনুসন্ধান করেন, যাচাই করেন, এবং এমন একটি কাঠামোর মধ্যে কাজ করেন যেখানে সত্যতা যাচাই একটি মৌলিক নীতি। এর ফলে আমরা পাই একটি তুলনামূলকভাবে গভীর ও নির্ভরযোগ্য চিত্র। হ্যাঁ, সাংবাদিকদেরও পক্ষপাত থাকতে পারে, কিন্তু তাদের পেশাগত নৈতিকতা এবং তথ্য যাচাইয়ের প্রক্রিয়া একটি কাঠামোর মধ্যে চলে, যা সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রায় অনুপস্থিত।
সোশ্যাল মিডিয়ার আরেকটি বিপজ্জনক দিক হলো এর অ্যালগরিদম। এটি এমনভাবে তৈরি, যা কেবল আপনার পছন্দ, আগ্রহ, এবং সার্চ হিস্টোরির ওপর ভিত্তি করে কনটেন্ট দেখায়। এর ফলে আপনি একটি ‘ইকো চেম্বারে’ আটকে পড়েন—যেখানে কেবল আপনার মতো মতামতই প্রতিধ্বনিত হয়। আপনাকে যেটা জানার দরকার, সেটি হয়তো আপনি দেখতে পাচ্ছেন না বা আপনাকে দেখানোই হচ্ছে না।
ধরা যাক, আপনি কোনো একটি রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আগ্রহী। আপনি সেই বিষয়ের একপাক্ষিক কিছু পোস্ট দেখছেন এবং লাইক দিচ্ছেন। এর ফলে অ্যালগরিদম আরও সেই ধরনের পোস্ট দেখাতে শুরু করে, অন্য দৃষ্টিভঙ্গিগুলোকে বাদ দিয়ে। এতে করে আপনি একটি সংকীর্ণ বৃত্তে আটকে পড়েন এবং চিন্তার পরিসর সংকুচিত হয়ে যায়।
আর সবচেয়ে বিপজ্জনক দিকটি হলো—আপনি ভাবতে পারেন যে আপনাকে কেউ প্রভাবিত করতে পারবে না। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। অ্যালগরিদম এতটাই চতুরভাবে কাজ করে যে আপনি বুঝতেই পারবেন না, কখন আপনার চিন্তা, মতামত এমনকি অনুভূতিগুলোর দিক পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। মানুষ হিসেবে আমরা সবসময় যুক্তির ওপর নির্ভর করি না, বরং আবেগ এবং সামাজিক প্রভাব অনেক সময় আমাদের সিদ্ধান্তে বড় ভূমিকা রাখে। সোশ্যাল মিডিয়া এই দুর্বল জায়গাগুলোকে নিখুঁতভাবে কাজে লাগাতে জানে।
এই কারণে সোশ্যাল মিডিয়াকে শুধুমাত্র বিনোদন বা দ্রুত তথ্য পাওয়ার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করলেই ভালো হয়, কিন্তু এটি যদি একমাত্র বা প্রধান তথ্য উৎস হয়, তাহলে আমরা একটি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকি।
শেষ কথায়: সোশ্যাল মিডিয়া একটি শক্তিশালী মাধ্যম, কিন্তু একে একমাত্র তথ্যের উৎস হিসেবে নির্ভর করা বিপজ্জনক। সত্যিকারের গভীর ও বিশ্বাসযোগ্য তথ্য জানতে হলে প্রচলিত সংবাদমাধ্যম, সাংবাদিকতার মানদণ্ড এবং পেশাদার বিশ্লেষকদের দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভর করাই শ্রেয়। নয়তো আমরা তথ্যের নয়, বিভ্রান্তির জগতে বাস করবো। আমরা যদি সত্যিই সচেতন নাগরিক হতে চাই, তাহলে আমাদের জানা প্রয়োজন কোন তথ্য কতটা বিশ্বাসযোগ্য এবং কে সেটা বলছে। সেই সাথে আমাদের উচিত বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি শুনে, যাচাই করে এবং বিশ্লেষণ করে নিজের মত গঠন করা। সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের সেই সুযোগ দিতে পারে, যদি আমরা তা ব্যবহারে সচেতন হই।
Leave a comment