চিকিৎসা বিদ্যাবিজ্ঞানীদের খবর

নতুন প্রজন্মের জন্য প্রেরণার উৎস: ২০২৫ সালের কানাডা গার্ডনার পুরস্কারজয়ী বিজ্ঞানীদের অবদান

Share
Share

একটি কোষ কিভাবে অন্য কোষের সঙ্গে যোগাযোগ করে? শরীরের হাজারো কার্যক্রম কীভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়? আবার, একটি মারাত্মক রোগ যেমন ক্যান্সার কীভাবে কোষের ভুল সংকেতের ফলে ছড়িয়ে পড়ে? — এই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে যুগান্তকারী অবদান রেখেছেন কিছু বিজ্ঞানী, যাঁরা ২০২৫ সালের কানাডা গার্ডনার পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।

এই সম্মানজনক পুরস্কারটি প্রতি বছর বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষকদের স্বীকৃতি দিতে প্রদান করা হয়। চলুন জেনে নেই এবারের বিজয়ীদের কিছু চমকপ্রদ গবেষণা ও তাঁদের অবদান।

১. কোষের কথোপকথনের রহস্য উদ্ঘাটন: নচ সিগনালিং পাথওয়ে

বিজয়ীরা:

  • ড. স্পাইরোস আর্টাভানিস-টসাকোনাস (হার্ভার্ড)
  • ড. আইভা গ্রিনওয়াল্ড (কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়)
  • ড. গ্যারি স্ট্রুল (কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়)

তাঁরা তিনজন মিলে উন্মোচন করেছেন Notch signaling pathway নামক এক বিশেষ কোষীয় যোগাযোগ পদ্ধতি, যা প্রাণীর বিকাশ ও অঙ্গ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কোষ কিভাবে আশেপাশের কোষের সংকেত বুঝে সিদ্ধান্ত নেয়— সেই রহস্যই এই গবেষণার মূল। এই পদ্ধতির গোলযোগের ফলেই জন্ম নিতে পারে ক্যান্সারসহ নানা জটিল রোগ।

ড. আর্টাভানিস-টসাকোনাস প্রথমবারের মতো Drosophila নামক মাছির Notch জিন ক্লোন করে দেখান এটি কোষের ঝিল্লির সঙ্গে যুক্ত একটি রিসেপ্টর। ড. গ্রিনওয়াল্ড দেখান কিভাবে একটি প্রোটিন (Presenilin) এই রিসেপ্টরকে ভেঙে সংকেত পাঠায়। আর ড. স্ট্রুল প্রমাণ করেন এই রিসেপ্টরের সাইটোপ্লাজমিক অংশ নিউক্লিয়াসে গিয়ে জিন নিয়ন্ত্রণ করে।

তাঁদের গবেষণা কোষীয় সংলাপ নিয়ে আমাদের ধারণার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।

২. সিস্টিক ফাইব্রোসিসের চিকিৎসায় বিপ্লব

বিজয়ীরা:

  • ড. মাইকেল জে. ওয়েলশ (ইউনিভার্সিটি অফ আইওয়া)
  • ড. পল নেগুলেস্কু (ভার্টেক্স ফার্মাসিউটিক্যালস)

এই দুই বিজ্ঞানী এমন এক রোগের বিরুদ্ধে লড়েছেন যা একসময় ছিল মৃত্যুদণ্ডের শামিল— Cystic Fibrosis। ১৯৮৯ সালে CFTR নামক একটি প্রোটিনকে সনাক্ত করার পর, ড. ওয়েলশ দেখান কিভাবে এই প্রোটিন ক্লোরাইড আয়ন পরিবহন করে এবং সেটি ভুলভাবে কাজ করলে কীভাবে এই রোগ হয়।

পরে ড. নেগুলেস্কু তাঁর কোম্পানিতে এমন ওষুধ তৈরি করেন যা এই ত্রুটিপূর্ণ প্রোটিনকে ঠিকঠাকভাবে কোষের পৃষ্ঠে পৌঁছে দেয় এবং সঠিকভাবে কাজ করায় সহায়তা করে। TRIKAFTA নামের এই ওষুধ এখন সিস্টিক ফাইব্রোসিসে আক্রান্ত ৯০ শতাংশ রোগীর জন্য কার্যকর, এবং তাদের গড় আয়ু এখন ৬১ বছর পর্যন্ত পৌঁছেছে।

৩. শিশুখাদের জীবন রক্ষাকারী পুষ্টিকর খাদ্য: RUTF

বিজয়ী:

  • ড. আন্দ্রে ব্রিয়ান (ফ্রান্স ও ফিনল্যান্ড)

বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশে শিশুদের অপুষ্টির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অন্যতম নায়ক ড. ব্রিয়ান। তিনি তৈরি করেন Ready-to-Use Therapeutic Food (RUTF) — এমন একটি পুষ্টিকর খাবার যা হাসপাতালে না গিয়ে ঘরে বসেই মারাত্মক অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুরা গ্রহণ করতে পারে। এটি এমনভাবে তৈরি যা ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে পারে না এবং সহজে পরিবহনযোগ্য।

চকলেট স্প্রেডের অনুপ্রেরণায় তৈরি এই খাবার আজ WHO ও UNICEF-এর স্বীকৃত একটি সমাধান।

৪. শিশুদের দীর্ঘমেয়াদি ব্যথা ব্যবস্থাপনায় ডিজিটাল চিকিৎসা

বিজয়ী:

  • ড. জেনিফার স্টিনসন (কানাডা)

শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের দীর্ঘমেয়াদি ব্যথা যেমন আর্থ্রাইটিস, ক্যান্সার বা সিকল সেল রোগে কষ্ট কমানোর জন্য iCanCope অ্যাপ তৈরি করেছেন তিনি। এতে থাকে ব্যথার রিপোর্ট, ব্যক্তিগত লক্ষ্য নির্ধারণ, এবং ভার্চুয়াল সহায়তা। তাঁর দল তৈরি করেছে iPeer2Peer নামের একটি প্ল্যাটফর্মও যেখানে অভিজ্ঞ কিশোররা নতুনদের সহায়তা করে।

এই উদ্ভাবনগুলো অনেক শিশুর জীবনে পরিবর্তন এনে দিয়েছে।

৫. ক্যান্সার কোষকে আত্মবিনাশে বাধ্য করা

বিজয়ী:

  • ড. ড্যানিয়েল ডে কারভালহো (ইউনিভার্সিটি হেলথ নেটওয়ার্ক, কানাডা)

ক্যান্সার কোষকে নিজেকে ধ্বংস করতে বাধ্য করার এক নতুন কৌশল আবিষ্কার করেছেন ড. ডে কারভালহো। তিনি এমন একটি চিকিৎসা পদ্ধতি তৈরি করেছেন যা ক্যান্সার কোষের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা ভাইরাসের মতো জিনকে সক্রিয় করে তোলে, ফলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা সেই কোষগুলোকে আক্রমণ করে ধ্বংস করতে পারে। এই আবিষ্কার ক্যান্সার চিকিৎসায় এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে।

🔍 উপসংহার

প্রিয় শিক্ষার্থীরা, এই বিজ্ঞানীরা আমাদের দেখিয়ে দিয়েছেন কিভাবে গবেষণা কেবল গবেষণাগারে সীমাবদ্ধ না থেকে বাস্তব জীবনে মানুষের জীবন রক্ষা করতে পারে। তাঁদের পথচলা, সংকল্প, আর গবেষণার প্রতি ভালোবাসা তোমাদেরও বিজ্ঞানচর্চায় অনুপ্রাণিত করুক।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার এই সময়টাই তোমাদের জন্য শ্রেষ্ঠ সুযোগ— নিজেকে গড়ে তোলার, প্রশ্ন করার, গবেষণার পথে হাঁটার। আজ যারা গার্ডনার পুরস্কার পাচ্ছেন, একদিন তাঁদের পথেই হাঁটতে পারো তুমিও। এখন থেকেই শুরু করো।

তোমার যাত্রা এখান থেকে শুরু হোক — বিজ্ঞানকে নিজের ভিতর ধারণ করো।
– বিজ্ঞানী অর্গ টিম

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

Related Articles
চিকিৎসা বিদ্যাসাধারণ বিজ্ঞান

🧠 নিয়মিত চিন্তা বা প্রার্থনা কি ব্রেইনের গঠন বদলায়?

নিয়মিত প্রার্থনা এবং মনোযোগী চিন্তাভাবনা কীভাবে নিউরোপ্লাস্টিসির মাধ্যমে মস্তিষ্ককে শারীরিকভাবে পুনর্গঠিত করে...

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাচিকিৎসা বিদ্যা

 ডিজিটাল বুদ্ধিমত্তার ওষুধ

জেনেরেটিভএক্স কীভাবে জেনারেটিভ এআই ব্যবহার করে ওষুধ শিল্পে বিপ্লব ঘটাচ্ছে তা আবিষ্কার...

চিকিৎসা বিদ্যাস্বাস্থ্য ও পরিবেশ

বিশ্বজনীন ভ্যাকসিন নিয়ে নতুন আশা 

মার্কিন স্বাস্থ্য বিভাগের একটি নতুন উদ্যোগের লক্ষ্য হল ফ্লু এবং কোভিড উভয়ের...

চিকিৎসা বিদ্যারসায়নবিদ্যা

ব্যথানাশক অণুর অণুকথা

অ্যাসপিরিনের পেছনের আকর্ষণীয় ইতিহাস আবিষ্কার করুন — উইলো বাকল থেকে ল্যাব-তৈরি অলৌকিক...

কলামচিকিৎসা বিদ্যা

কলাম: গাট-ব্রেইনঅ্যাক্সিস: অন্ত্রেরব্যাকটেরিয়াকীভাবেআমাদেরমস্তিষ্কনিয়ন্ত্রণকরে?

আপনার অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া কীভাবে আপনার মেজাজ, স্মৃতিশক্তি এবং মানসিক স্বচ্ছতাকে প্রভাবিত করে...

Three Columns Layout

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact

biggani.org❤️gmail.com

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

বিজ্ঞানী অর্গ (biggani.org) বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে গবেষণা ও বিজ্ঞান নিয়ে বাংলা ভাষায় তথ্য ও সাক্ষাৎকার প্রচার করে – নবীনদের গবেষণা ও উচ্চশিক্ষায় প্রেরণা দেয়া হয়।

যোগাযোগ:

biggani.org@জিমেইল.com

biggani.org, a community of Bangladeshi scientists, shares interviews and information about researchers and scientists in Bengali to inspire young people in research and higher education.