কোয়ান্টাম কম্পিউটিংপ্রযুক্তি বিষয়ক খবর

স্টক এক্সচেঞ্জে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং দুঃস্বপ্নের জন্য প্রস্তুতি: কিউ-ডে (Q-Day) কী?

Share
Share

ভাবুন, আপনি সকালে উঠে খবর পেলেন, কোয়ান্টাম কম্পিউটার রাতারাতি আধুনিক সব এনক্রিপশন ভেঙে ফেলেছে। আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ছে বিশৃঙ্খলা, কারণ ব্যাংক, সরকার ও কোম্পানিগুলো নিজেদের তথ্য রক্ষায় হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। স্টক মার্কেট ধসে পড়ছে – Apple (AAPL), Amazon (AMZN), Nvidia (NVDA), এবং JPMorgan Chase (JPM)-এর মতো জায়ান্ট কোম্পানির শেয়ারের দাম হুমড়ি খেয়ে পড়ছে নিরাপত্তা ভঙ্গ ও বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতার কারণে। হাই-ফ্রিকোয়েন্সি ট্রেডিং সিস্টেম হ্যাক হচ্ছে, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খালি হয়ে যাচ্ছে, আর এনক্রিপ্ট করা আর্থিক নথিপত্র ফাঁস হয়ে পড়ছে। পুরো বৈশ্বিক অর্থনীতি ধ্বংসের কিনারায় এসে দাঁড়াচ্ছে, কারণ সবাই ক্ষয়ক্ষতির নিয়ন্ত্রণে মরিয়া হয়ে পড়েছে।

এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি আপাতত কেবল একটি তাত্ত্বিক আশঙ্কা, কিন্তু এটি সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের রাতের ঘুম কেড়ে নিচ্ছে। কিউ-ডে বা Q-Day, যে দিন কোয়ান্টাম কম্পিউটার বর্তমান এনক্রিপশন ভেঙে ফেলতে পারবে, সে দিনের আশঙ্কা ক্রমেই ঘনিয়ে আসছে, অথচ বিশ্ব এখনো এর জন্য প্রস্তুত নয়। সাইবার নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান QD5-এর বিশেষজ্ঞ টিলো কুনজ ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগকে সতর্ক করেছিলেন যে, ২০২৫ সালের মধ্যেই কোয়ান্টাম কম্পিউটার এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে যে তারা অধিকাংশ ডিজিটাল যোগাযোগের নিরাপত্তা ভেঙে ফেলতে সক্ষম হবে। এতে সামরিক গোপন তথ্য, চিকিৎসা সংক্রান্ত রেকর্ড, আর্থিক তথ্য এবং অন্যান্য সংবেদনশীল ডেটা হুমকির মুখে পড়তে পারে। এটি কোনো Y2K-এর মতো কল্পনাভিত্তিক ভয়ের বিষয় নয়; বরং এটি একটি অনেক বেশি বাস্তবধর্মী আশঙ্কা, যা বিশ্ব যদি প্রস্তুত না থাকে, তাহলে বাস্তবেই ঘটতে পারে।

Q-Day কী?

Q-Day হলো সেই মুহূর্ত, যখন কোয়ান্টাম কম্পিউটার এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠবে যে তারা আধুনিক এনক্রিপশন ভেঙে ফেলতে পারবে, যেই এনক্রিপশন আর্থিক লেনদেন, ডিজিটাল পরিচয় এবং সংবেদনশীল যোগাযোগের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। এই সংকটের মূল কেন্দ্রে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার গোপন কোয়ান্টাম প্রতিযোগিতা – দুই দেশই জাতীয় নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক আধিপত্য নিশ্চিত করতে কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ে বিপুল বিনিয়োগ করছে। সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা অনেকদিন ধরেই আলোচনা করে আসছেন যে, এই দুই দেশ ইতোমধ্যেই এনক্রিপ্ট করা ডেটা সংগ্রহ করছে ভবিষ্যতে তা ডিক্রিপ্ট করার উদ্দেশ্যে তারা একে বলেন “এখন সংগ্রহ করো, পরে ডিকোড করো” (Harvest now, decode later)।

চলুন সংক্ষেপে Q-Day-এর তিনটি সম্ভাব্য পরিস্থিতি দেখে নিই:

সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি (The Worst-Case Scenario)
এই পরিস্থিতিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সময়মতো খাপ খাওয়াতে ব্যর্থ হয়। এনক্রিপশন-ভিত্তিক নিরাপত্তা ভেঙে পড়ায় সাইবার অপরাধ বেড়ে যায়, ব্যাপক আর্থিক প্রতারণা ঘটে এবং ট্রিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও, ডিজিটাল লেনদেনের ওপর থেকে মানুষের আস্থা ভেঙে যায়, এবং বাজার এক দীর্ঘমেয়াদি মন্দার মধ্যে পড়ে। ক্রিপ্টোকারেন্সি ও ডিজিটাল অ্যাসেট রাতারাতি মূল্যহীন হয়ে পড়ে, কারণ এগুলোর নিরাপত্তার ভিত্তি ধ্বংস হয়ে যায়।

সবচেয়ে আশাব্যঞ্জক পরিস্থিতি (The Best-Case Scenario)
সরকার এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কিউ-ডে আসার আগেই সফলভাবে কোয়ান্টাম-প্রতিরোধী এনক্রিপশন বাস্তবায়ন করে। রূপান্তর প্রক্রিয়া মসৃণভাবে সম্পন্ন হয়—যদিও কিছুটা বাজার অস্থিরতা দেখা যায়, তবুও দ্রুতই স্থিতিশীলতা ফিরে আসে। কোয়ান্টাম নিরাপত্তা প্রযুক্তি বিকাশকারী কোম্পানিগুলো ব্যাপক উন্নতি লাভ করে এবং বিনিয়োগকারীরা কোয়ান্টাম-সহনশীল অ্যাসেটের দিকে ঝুঁকে পড়ে। কোয়ান্টাম বিপ্লব প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ও নতুন অর্থনৈতিক সুযোগের দ্বার খুলে দেয়।

মধ্যমপন্থী পরিস্থিতি (The Middle-Ground Scenario)
কিছু প্রতিষ্ঠান সফলভাবে অভিযোজিত হয়, অন্যগুলো হোঁচট খায়। বাজারে চরম অস্থিরতা দেখা যায় এবং সাইবার হামলার কারণে কিছু ক্ষেত্রে আর্থিক প্রতিষ্ঠান ধসে পড়ে। সরকারগুলো প্রণোদনা ও নিয়ন্ত্রক পদক্ষেপ নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে। শেষপর্যন্ত একটি নতুন কোয়ান্টাম-নিরাপদ অর্থনীতি গড়ে ওঠে, তবে এর জন্য উল্লেখযোগ্য আর্থিক ক্ষতি ও অর্থনৈতিক পুনর্গঠন দরকার হয়।

সরকার কীভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে


ভবিষ্যতের সম্ভাব্য সংকট এড়াতে সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো পোস্ট-কোয়ান্টাম ক্রিপ্টোগ্রাফি (PQC)-তে গুরুত্ব দিচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেকনোলজি (NIST) কোয়ান্টাম-প্রতিরোধী অ্যালগরিদমের মান নির্ধারণে কাজ করছে। একই সময়ে, বিশ্বব্যাপী আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাকআপ পরিকল্পনা গ্রহণ করছে এবং বিভিন্ন দেশ কোয়ান্টাম গবেষণাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে যেন ভবিষ্যতের হুমকির আগে এগিয়ে থাকা যায়। আন্তর্জাতিকভাবে সহযোগিতা ও দ্রুত নীতিমালা বাস্তবায়ন জরুরি, যাতে Q-Day একটি অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে পরিণত না হয়।

কোয়ান্টাম যোগাযোগ এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে চীন বিপুল অর্থ ব্যয় করছে। এই প্রযুক্তি এমন সম্ভাবনা সৃষ্টি করছে যে, Q-Day-এ যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য প্রতিদ্বন্দ্বীরা আগে পৌঁছালেও, বেইজিং নিজেদের ডেটা নেটওয়ার্ক নিরাপদ রাখতে পারবে।

রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং (Xi Jinping) ২০২০ সালের এক ভাষণে শীর্ষ চীনা নেতাদের সামনে কোয়ান্টাম প্রযুক্তির “কৌশলগত গুরুত্ব” তুলে ধরেন – যা সরকারি সংবাদ সংস্থা সিনহুয়া জানিয়েছে। শির অধীনে, চীন কোয়ান্টাম বিজ্ঞানে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য সুস্পষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। কিছু অনুমান অনুযায়ী, কোয়ান্টাম গবেষণায় চীনই বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ অর্থ ব্যয় করছে। এপ্রিল মাসে প্রকাশিত McKinsey & Company-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, চীন কোয়ান্টাম গবেষণার জন্য মোট $১৫.৩ বিলিয়ন অর্থ বরাদ্দের ঘোষণা দিয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের $৩.৭ বিলিয়নের তুলনায় চার গুণেরও বেশি।

চীনের কোয়ান্টাম প্রযুক্তি অভিযানের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হচ্ছেন পদার্থবিদ পান জিয়ানওয়ে (Pan Jianwei), যিনি চীনে একপ্রকার সেলিব্রেটি হিসেবে বিবেচিত এবং চীনা কমিউনিস্ট পার্টির প্রশংসা ও সমর্থন অর্জন করেছেন।

Q-Day সম্পর্কে শেষ কথা
Q-Day আর্থিক বাজারের জন্য একটি গুরুতর হুমকি, তবে আগাম প্রস্তুতির মাধ্যমে এর প্রভাব অনেকটাই কমানো সম্ভব। যদিও সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি দুঃস্বপ্নের মতো, কোয়ান্টাম নিরাপত্তা ও কৌশলগত পরিকল্পনার অগ্রগতি আমাদের একটি স্থিতিশীল রূপান্তরের আশাও দেখায়। বিনিয়োগকারী ও সরকারগুলোকে সতর্ক থাকতে হবে এবং কোয়ান্টাম যুগ আসার আগেই নিজেদের অভিযোজিত করতে হবে।

References:

  • https://www.reuters.com/investigates/special-report/us-china-tech-quantum/
  • https://markets.businessinsider.com/news/stocks/preparing-for-a-quantum-computing-nightmare-on-the-stock-exchange-what-is-q-day-1034348488

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

Related Articles
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাপ্রযুক্তি বিষয়ক খবর

ছয় বছর বয়সেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শিক্ষা: চীনের যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত

ছয় বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য চীন কীভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শিক্ষা চালু...

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাপ্রযুক্তি বিষয়ক খবর

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার হাত থেকে সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎ: কী হারাচ্ছে সংবাদ মাধ্যম?

সাংবাদিকতার উপর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাব কীভাবে পড়ছে? চ্যাটবটগুলি ওয়েবসাইটের ট্র্যাফিক এবং বিজ্ঞাপনের...

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাপ্রযুক্তি বিষয়ক খবর

শিখনযন্ত্রের মহাকাব্য: রিইনফোর্সমেন্ট লার্নিং-এর পথিকৃৎদের টিউরিং পুরস্কার প্রাপ্তি

রিইনফোর্সমেন্ট লার্নিং কীভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় বিপ্লব এনেছিল এবং অগ্রণী অ্যান্ড্রু বার্তো এবং...

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাপ্রযুক্তি বিষয়ক খবর

একটি নতুন ভোরের গল্প: AI-এ সুযোগ, মানবিকবিদ্যার চাহিদা বৃদ্ধি

রাতে হলুদ আলোয় ভেসে যাওয়া একতলা বাড়ির বারান্দায় বসে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছিলেন...

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাপ্রযুক্তি বিষয়ক খবর

OpenAI আর মাইক্রোসোফটের প্রমিতি: একটি অবশ্যর সম্পর্কা না নতুন?

মাইক্রোসফট এবং ওপেনএআই-এর অংশীদারিত্ব বদলে যাচ্ছে। এটি কি এআই উদ্ভাবনের শেষ নাকি...

Three Columns Layout

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact

biggani.org❤️gmail.com

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

বিজ্ঞানী অর্গ (biggani.org) বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে গবেষণা ও বিজ্ঞান নিয়ে বাংলা ভাষায় তথ্য ও সাক্ষাৎকার প্রচার করে – নবীনদের গবেষণা ও উচ্চশিক্ষায় প্রেরণা দেয়া হয়।

যোগাযোগ:

biggani.org@জিমেইল.com

biggani.org, a community of Bangladeshi scientists, shares interviews and information about researchers and scientists in Bengali to inspire young people in research and higher education.