কিভাবে কাজ করে?পরিবেশ ও পৃথিবী

সোলার সেল বা সৌরকোষ কীভাবে কাজ করে?

Share
Share

পরিচিতি

সোলার সেল বা সৌরকোষের এর অপর একটি নাম হল, ফটোভোলটাইক সেল। এটি সূর্যের আলোক শক্তিকে সরাসরি বিদ্যুতে রূপান্তরিত করতে পারে। বর্তমান বিশ্বে, পরিবেশবান্ধব শক্তির উৎসগুলির মধ্যে সোলার সেল একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বায়ু দূষণ এবং গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে এই প্রযুক্তির ব্যবহার দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই প্রবন্ধে, আমরা সোলার সেলের প্রযুক্তিগত ধারণা, কিভাবে কাজ করে, বর্তমান অবস্থা, এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনার উপর আলোকপাত করব।

ইতিহাস ও বিবর্তন

সোলার সেলের ধারণা মূলত ১৯ শতকের শেষের দিকে উদ্ভাবিত হয়। ১৮৩৯ সালে, ফরাসি বিজ্ঞানী অ্যাডমন্ড বেকেরেল প্রথমবারের মতো ফটোভোলটাইক ইফেক্ট আবিষ্কার করেন, যা সূর্যালোকের উপস্থিতিতে বিদ্যুতের উৎপত্তি নির্দেশ করে। তবে, ১৯৫৪ সালে বেল ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানীরা প্রথম কার্যকরী সিলিকন সোলার সেল তৈরি করেন। এই উদ্ভাবনটি সৌরশক্তির ব্যবহারকে গণমুখী করতে একটি বড় পদক্ষেপ ছিল।

উল্লেখযোগ্য বিজ্ঞানীদের অবদান

সোলার সেলের বিকাশে বেশ কিছু বিজ্ঞানীর অবদান রয়েছে। উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে রয়েছেন:

  • অ্যাডমন্ড বেকেরেল: প্রথম ফটোভোলটাইক ইফেক্ট আবিষ্কার করেন।
  • রাসেল ওহল: আধুনিক সোলার সেলের মূল ভিত্তি স্থাপনকারী বিজ্ঞানী।
  • গার্ডনার এবং পিয়ারসন: বেল ল্যাবরেটরিতে প্রথম কার্যকরী সিলিকন সোলার সেল তৈরি করেন।

সোলার সেল কিভাবে কাজ করে?

সোলার সেল কীভাবে কাজ করে তা বুঝতে গেলে প্রথমে জানতে হবে ফটোভোলটাইক ইফেক্ট সম্পর্কে। সোলার সেল মূলত সেমিকন্ডাক্টর পদার্থ দিয়ে তৈরি, যার মধ্যে সিলিকন সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। যখন সূর্যের আলো সোলার সেলের উপর পড়ে, তখন সেই আলো ফোটন নামে পরিচিত ক্ষুদ্র শক্তি কণা তৈরি করে। এই ফোটনগুলো সোলার সেলের সেমিকন্ডাক্টর পদার্থের ইলেকট্রনগুলোকে উত্তেজিত করে। এই উত্তেজিত ইলেকট্রনগুলো তাদের মূল অবস্থান থেকে সরে যায় এবং সেমিকন্ডাক্টরের মধ্যে একটি বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র তৈরি হয়। এই বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রের কারণে ইলেকট্রনগুলো একটি নির্দিষ্ট দিকে প্রবাহিত হয়, যার ফলস্বরূপ বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। এইভাবে, সোলার সেল সূর্যের আলোকে সরাসরি বিদ্যুতে রূপান্তরিত করে এবং এই বিদ্যুৎ আমরা বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ডিভাইসে ব্যবহার করতে পারি।

সোলার সেলের কাজ করার প্রক্রিয়াটি আরও বিস্তারিতভাবে বোঝার জন্য, আমাদের সোলার সেলের গঠন এবং ফটোভোলটাইক প্রক্রিয়ার বিশদ বিবরণে যেতে হবে।

প্রথমে, সোলার সেল সাধারণত দুটি স্তর নিয়ে গঠিত থাকে: একটি পজিটিভ (p-type) এবং একটি নেগেটিভ (n-type) সেমিকন্ডাক্টর স্তর। এই দুটি স্তরের সংযোগস্থলে, একটি পিএন (p-n) জাংশন তৈরি হয়। যখন সূর্যালোক সোলার সেলের উপর পড়ে, তখন সূর্যালোকের ফোটনগুলো n-type স্তরের ইলেকট্রনগুলোকে উত্তেজিত করে। এই উত্তেজনার ফলে ইলেকট্রনগুলো তাদের আসল অবস্থান থেকে সরে যায় এবং p-type স্তরের দিকে চলে যাওয়ার চেষ্টা করে।

এই প্রবাহিত ইলেকট্রনগুলো একটি সার্কিটের মাধ্যমে সংযুক্ত হলে, ইলেকট্রনগুলো n-type স্তর থেকে p-type স্তরে প্রবাহিত হয় এবং এই প্রক্রিয়ায় বৈদ্যুতিক ধারা (current) তৈরি হয়। এটি সরাসরি ডিসি (Direct Current) বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে, যা সোলার সেলের প্রাথমিক আউটপুট।

এই বিদ্যুৎ তারপর ইনভার্টারের মাধ্যমে এসি (Alternating Current) বিদ্যুতে রূপান্তরিত হয়, যা আমাদের বাড়ি বা অফিসের বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ডিভাইসে ব্যবহার করা হয়। এই পুরো প্রক্রিয়া সূর্যালোকের শক্তিকে বিদ্যুতে রূপান্তরিত করার একটি পরিবেশবান্ধব এবং টেকসই উপায় হিসেবে বিবেচিত হয়।

ফটোভোলটাইক প্রক্রিয়া এবং সেমিকন্ডাক্টর পদার্থের এই বৈশিষ্ট্যই সোলার সেলের কার্যকারিতার মূল ভিত্তি। ইলেকট্রনের এই চলাচল এবং পিএন জাংশনের কারণে সোলার সেল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত শক্তির চাহিদা পূরণে সহায়ক হয়।

সোলার সেলের বর্তমান অবস্থা ও প্রয়োগ

বর্তমানে, সোলার সেল প্রযুক্তি বিশ্বজুড়ে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাড়ি, অফিস, এবং বড় বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলিতে সোলার সেল ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। সোলার প্যানেলগুলোকে একত্রিত করে বড় স্কেলে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে, যা নির্ভরযোগ্য এবং টেকসই শক্তির উৎস হিসেবে পরিচিত। বিভিন্ন দেশে সরকার সৌরশক্তির ব্যবহারকে উৎসাহিত করছে এবং সোলার সেল ব্যবহারে বিশেষ প্রণোদনা প্রদান করছে।

ভবিষ্যতের সম্ভাবনা ও বিকাশ

সোলার সেল প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ অত্যন্ত উজ্জ্বল। গবেষকরা বর্তমানে এমন উপকরণ এবং ডিজাইন নিয়ে কাজ করছেন যা সোলার সেলের কার্যকারিতা আরও বাড়িয়ে তুলবে এবং খরচ কমাবে। ন্যানো প্রযুক্তি এবং অর্গানিক সোলার সেলের মতো নতুন উদ্ভাবনগুলি সৌরশক্তির ব্যবহারকে আরও বিস্তৃত করবে। ভবিষ্যতে, এমনকি সূর্যালোকের কম উপস্থিতিতেও সোলার সেল কার্যকরভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম হবে।

শিক্ষার্থীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ

সোলার সেল সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন শিক্ষার্থীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, এটি তাদের পরিবেশবান্ধব শক্তির প্রতি সচেতন করে তুলবে এবং তারা টেকসই উন্নয়নের ধারণাকে আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারবে। দ্বিতীয়ত, এই প্রযুক্তির ক্ষেত্রটি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা তাদের ভবিষ্যতের ক্যারিয়ারের জন্য নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দেবে। অবশেষে, সোলার সেল প্রযুক্তি তাদের বিজ্ঞান ও প্রকৌশল সম্পর্কিত জ্ঞানকে আরও সমৃদ্ধ করবে, যা বর্তমান সময়ে অত্যন্ত মূল্যবান।

সম্পূরক ওয়েবসাইট, অনলাইন রিসোর্স এবং বই

সোলার সেল সম্পর্কে আরও জানতে, নিম্নলিখিত ওয়েবসাইট এবং বইগুলি সহায়ক হতে পারে:

  • ওয়েবসাইট:
  • বই:
    • “Solar Cells: Operating Principles, Technology, and System Applications” by Martin A. Green
    • “Photovoltaics: Design and Installation Manual” by Solar Energy International
    • “Fundamentals of Photovoltaic Modules and Their Applications” by G. N. Tiwari and Swapnil Dubey
Share
Written by
নিউজডেস্ক -

আমরা বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবরাখবর ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাতকার প্রকাশ করি। আপনারা কোন লেখা প্রকাশিত করতে চাইলে যোগাযোগ করুন: [email protected], [email protected]

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

Related Articles
জেনেটিকসপরিবেশ ও পৃথিবীবায়োটেকনলজিসাক্ষাৎকার

প্রোফেসর ড. আবিদুর রহমান: উদ্ভিদ বিজ্ঞান এবং পরিবেশবান্ধব গবেষণার পথিকৃৎ

অধ্যাপক আবিদুর রহমান বর্তমানে জাপানের ইওয়াতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদে উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের...

কৃষিনতুন প্রযুক্তিপরিবেশ ও পৃথিবী

সৌরকৃষি: কৃষিক্ষেত্রে নতুন বিপ্লব

সৌরকৃষি প্রযুক্তিতে কৃষি ও সৌর শক্তিকে একসাথে ব্যবহার করা হয়। কৃষকের আয়...

GenZপরিবেশ ও পৃথিবীসাক্ষাৎকারস্বাস্থ্য ও পরিবেশ

ই-বর্জ্য এর গবেষক হৃদয় রায়

ই-বর্জ এর গবেষক হৃদয় রায়। বাংলাদেশের মধ্যে ই-বর্জ নিয়ে কাজ করছে এমন...

পরিবেশ ও পৃথিবী

জলবায়ু পরিবর্তন ও টেকসই প্রযুক্তি: ভবিষ্যৎ রক্ষায় বিজ্ঞান

প্রকৃতির রুদ্ররোষ থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করতে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য...

পরিবেশ ও পৃথিবী

পৃথিবীর কোরের বিপরীতমুখী গতি: কী হতে পারে এর প্রভাব?

প্রকৃতির বিস্ময়কর ঘটনাগুলির মধ্যে পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ কোরের (অভ্যন্তরকেন্দ্র) ঘূর্ণন একটি রহস্যময় বিষয়।...

Three Columns Layout

বাংলাদেশি গবেষকদের কমিউনিটি বিজ্ঞানী অর্গ (biggani.org), যা বাংলা ভাষায় গবেষণা সংক্রান্ত তথ্য ও সাক্ষাৎকার শেয়ার করে নতুনদের গবেষণায় প্রেরণা দেয়।

যোগাযোগ

[email protected]

biggani.org, a community of Bangladeshi scientists, shares interviews and information about researchers and scientists in Bengali to inspire young people in research and higher education.

বিজ্ঞানী অর্গ (biggani.org) বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে গবেষণা ও বিজ্ঞান নিয়ে বাংলা ভাষায় তথ্য ও সাক্ষাৎকার প্রচার করে – নবীনদের গবেষণা ও উচ্চশিক্ষায় প্রেরণা দেয়া হয়।

যোগাযোগ:

biggani.org@জিমেইল.com

biggani.org, a community of Bangladeshi scientists, shares interviews and information about researchers and scientists in Bengali to inspire young people in research and higher education.