মানব কঙ্কাল, শুনলেই গা ছমছমে একটা অনুভূতি হয়। কত গল্প, কত কিংবদন্তি, কত সিনেমা আর ভৌতিক ধারাবাহিকে বারবার ফিরে আসে মানুষের কঙ্কালের কথা। কল্পনা আর বাস্তবতার মিশেলে তৈরি এক অদ্ভুত জগৎ যেন মানব কঙ্কাল। আধুনিক বিজ্ঞানের এই যুগেও মানুষের কৌতূহল আর রহস্যের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়ে গেছে এই হাড়গোড়ের শরীর। কিছু রহস্যের যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা মিললেও, কিছু আজও অজানা, ব্যাখ্যাতীত, তাই মানব কঙ্কাল নিয়ে মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। কিন্তু আসলেই কি মানব কঙ্কাল রহস্যময়? চলুন, বিজ্ঞানের আলোয় যাচাই করে দেখা যাক।
মানুষের দেহের শেষ ঠিকানা
মানুষ মারা গেলে তার দেহ পচে মিশে যায় মাটির সঙ্গে, বাকি থাকে শুধু হাড়গোড়। সেই হাড়গোড়ই একসময় হয়ে ওঠে রহস্য, ভয় আর ইতিহাসের সাক্ষী। মিশর থেকে শুরু করে মেক্সিকো, প্রাচীন সভ্যতায় কঙ্কাল নিয়ে কত রকমের রীতি! কখনো সমাধির নিচে, কখনো গোপন গুহায়, অজানা অন্ধকারে লুকিয়ে থাকে শত শত বছর পুরোনো হাড়গোড়।
মানব কঙ্কাল: শুধু ভয় নাকি বিজ্ঞান?
রহস্যময় এই কঙ্কালের পেছনে সাড়া জাগানো অনেক ঘটনা আছে। কখনো প্রাচীন কবরস্থান খুঁড়ে বের হয় শত শত বছর আগের মানুষের হাড়। কখনো ভগ্নদেহ উদ্ধার হয় কোনো পরিত্যক্ত বাড়ি থেকে, মানুষের মনে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক। এ নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়েছে পুলিশ, প্রত্নতত্ত্ববিদ আর ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা।
কিন্তু আসলেই কি সব কঙ্কাল রহস্যময়? এর উত্তর অস্বীকার করার কিছু নেই। ইতিহাসে দেখা গেছে, প্রাচীন মমি থেকে শুরু করে যুদ্ধক্ষেত্রের গণকবর, বহু অজানা কঙ্কাল মানুষ খুঁজে পেয়েছে। ১৯২২ সালে তুতানখামেনের সমাধি আবিষ্কারের পর মানুষের কঙ্কাল আর সমাধি নিয়ে নতুন রহস্য শুরু হয়। ১৯৯১ সালে ইউরোপে পাওয়া গেল আইসম্যান নামের প্রায় ৫৩০০ বছর পুরোনো মানবদেহ, মানুষের জিজ্ঞাসা আরও গভীর হলো, কীভাবে এত বছর হাড়গোড় অক্ষত থাকে?
হাড়ের রহস্য খুঁজছে বিজ্ঞান
মানব কঙ্কাল নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা চালাচ্ছে বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা। ইউরোপ, মিশর, ল্যাটিন আমেরিকা, এমনকি হিমালয়ের বরফ ঢাকা অঞ্চলেও পাওয়া গেছে রহস্যময় কঙ্কাল। ‘ডিসকভারি চ্যানেল’ বা ‘ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক’-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলো মানব কঙ্কাল নিয়ে বিস্তর ডকুমেন্টারি তৈরি করেছে।
ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এ রহস্যের পেছনে থাকে প্রাকৃতিক নিয়ম, আবহাওয়া আর মানুষের কৃতকর্ম। বহু গোপন মৃত্যু আর হারিয়ে যাওয়া মানুষের গল্প কঙ্কাল হয়েই মাটির নিচে টিকে থাকে।
হাড়ের জট খুলছে প্রযুক্তি
বিজ্ঞানের হাত ধরে এখন মানব কঙ্কালের রহস্য অনেকটাই উন্মোচিত। ডিএনএ পরীক্ষা, ফসিল ডেটিং, বায়োকেমিক্যাল অ্যানালাইসিস, কতভাবে বিজ্ঞানীরা খুঁজে বের করছেন কঙ্কালের বয়স, পরিচয় আর মৃত্যুর রহস্য। আধুনিক প্রযুক্তি আর ল্যাব টেস্টে কোনো এক অজানা কঙ্কালও এখন হয়ে উঠছে ইতিহাসের মুখপত্র।
রহস্যের চেয়ে বেশি ইতিহাস
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানব কঙ্কাল নিয়ে যত ভয়-ভীতি আর গল্প, তার বেশির ভাগই মানুষের কল্পনার সৃষ্টি। রহস্যের চেয়ে এরা বেশি ইতিহাসের জ্যান্ত দলিল। কঙ্কাল শুধু মৃতদেহ নয়, একেকটা হাড় যেন একেকটা যুগের সাক্ষী। সেই সাক্ষী হাত ধরে মানুষ খুঁজে পায় নিজের শেকড়, নিজের অতীত।
তাই মানব কঙ্কাল আর আগের মতো গা ছমছমে রহস্য নয়, বরং বিজ্ঞানের ল্যাব আর জাদুঘরের আলোয় দাঁড়িয়ে থাকা এক জীবন্ত ইতিহাস।
মানবদেহের গঠন বুঝতে হলে কঙ্কাল এর চেয়ে বড় শিক্ষক আর নেই। হাড়গোড় না দেখলে, না ছুঁলে, না কাটলে চিকিৎসাবিজ্ঞান শেখা প্রায় অসম্ভব। তাই মানব কঙ্কাল মেডিকেল সাইন্সের অবিচ্ছেদ্য অংশ, আর এই কঙ্কাল জোগাড়ের ইতিহাস ঘিরেই আছে গোপন রহস্য, মজার গল্প আর অজানা অধ্যায়।
বাংলাদেশ তখন ব্রিটিশ ভারতের অংশ। কলকাতা মেডিকেল কলেজ ছিল উপমহাদেশের প্রথম আধুনিক মেডিকেল কলেজ (১৮৩৫)। তখন চিকিৎসা শিখতে ছাত্রদের লাশ কাটতে হতো, এটাকে বলা হতো Dissection। লাশ জোগাড় হতো মূলত অজানা পরিচয়ের মৃতদেহ থেকে।
ধীরে ধীরে ঢাকায় মেডিকেল স্কুল শুরু হলো, প্রথমে Mitford Hospital (বর্তমান স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ) কেন্দ্র করে। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ (১৯৪৬)। লাশ আর হাড়ের অভাব তখনও বিরাট সমস্যা।
পাকিস্তান আমলেও মেডিকেল কলেজগুলোতে লাশ বা কঙ্কাল আসতো মূলত অজানা মৃতদেহ থেকে। গ্রামাঞ্চলে কেউ মারা গেলে যার কোনো পরিচয় নেই, পুলিশ মর্গে পাঠাতো। কিছু অংশ শিক্ষার্থীদের Dissection টেবিলে যেতো, বাকি হাড় শুকিয়ে রাখা হতো শিক্ষণীয় কাজে।
একই সময়ে দেশের অনেকেই ভারত ও কলকাতা থেকে গোপনে কঙ্কাল আনার সাথে যুক্ত ছিল। সেসময় গঙ্গার তীরে বহু অজানা লাশ পাওয়া যেত, সেগুলো ধুয়ে-মুছে কঙ্কাল বানিয়ে মেডিকেল কলেজগুলোতে বিক্রি হতো। এজন্য গোপনে ‘কঙ্কাল চোরাচালান চক্র’ও গড়ে উঠেছিল।
স্বাধীনতার পর দেশে মেডিকেল কলেজের সংখ্যা বাড়তে থাকলো , ১৯৭১-৮০ এর মধ্যে কুমিল্লা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহে নতুন কলেজ স্থাপন হলো। হাড় আর লাশের চাহিদা কয়েকগুণ হয়ে গেলো। তখন স্থানীয় কিছু গ্রুপ শ্মশান ও কবরস্থান থেকে রাতের আঁধারে কঙ্কাল তুলতো, এসব কঙ্কাল বাইরে বা দেশের বিভিন্ন মেডিকেলে বিক্রি হতো।
আশির দশকে পত্রপত্রিকায় প্রায়ই খবর ছাপা হতো, ‘মৃতদেহ গায়েব’, ‘কবর খুঁড়ে কঙ্কাল চুরি’। সরকারও একসময় হাড় রপ্তানিকে নিষিদ্ধ করে। এর আগে বাংলাদেশের অনেক কঙ্কাল জাপান, ইউরোপ এমনকি আমেরিকায় পর্যন্ত রফতানি হতো, শিক্ষা ও মেডিকেল গবেষণার জন্য।
দেশের মেডিকেল শিক্ষার্থীদের Anatomy শিখতে লাশ ও হাড় অপরিহার্য। একসময়ে “Bone Set” নামে পুরো হাড়ের সেট পাওয়া যেত পুরান ঢাকার গলিতে গলিতে গোপনে।
এখনও দেশের অনেক Anatomy Department নিজেরাই হাড় তৈরি করে — অজানা পরিচয়ের লাশ কেমিক্যাল পদ্ধতিতে শুকিয়ে Skeleton বানানো হয়। তবে মানবাধিকার, আইন ও ধর্মীয় সংবেদনশীলতার কারণে বিষয়টি নিয়ন্ত্রিত ও সীমিত।
বর্তমানে অনেক মেডিকেল কলেজে প্লাস্টিক মডেল Skeleton, 3D Virtual Dissection Table, Digital Cadaver Lab ব্যবহার হচ্ছে। তবুও বাস্তব লাশ আর হাড়ের বিকল্প এখনো শতভাগ আসেনি। তাই চুপচাপ সেই ‘কঙ্কাল জোগাড়ের রহস্য’ আড়ালে এখনও কিছুটা বেঁচে আছে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানে মানব কঙ্কাল খুঁড়ে শেখার প্রথা আজকের বিষয় নয়, শত বছর ধরে চিকিৎসা শিখতে মানবদেহ ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে সময়ের সাথে সাথে গোপনতা আর রহস্য কিছুটা কমেছে, এসেছে নিয়মনীতি, ইথিক্স আর প্রযুক্তি।
মানুষের অজানা গল্প, সমাজের অন্ধকার আর বিজ্ঞানের আলো মিলে মানব কঙ্কাল আজও দেশের মেডিকেল সাইন্সে এক অদ্ভুত ‘রহস্যের শিক্ষক’ হয়ে আছে।
ধর্মীয় গ্রন্থে এর ভয়াবহতা ও নিষেধ
ইসলাম:
ইসলামে মৃতদেহের মর্যাদা জীবিত মানুষের মতোই। নবী মুহাম্মদ (স) স্পষ্টভাবে বলেছেন:
“ভেঙে ফেলা মৃতের হাড়, আর জীবিত মানুষের হাড় ভেঙে ফেলার পাপ সমান।” (আবু দাউদ, তিরমিজি)
সরাসরি কোনো মৃতদেহের অমর্যাদা, হাড় বিক্রি বা খনন করা ইসলামে কঠোরভাবে নাজায়েজ। তাই মুসলিম দেশে গোপনে কবর খুঁড়ে হাড় বিক্রির যে ইতিহাস আছে, তা ইসলামী দৃষ্টিতে ভয়াবহ গুনাহ।
হিন্দুধর্ম:
হিন্দু ধর্মে দেহ দাহের পর পবিত্রভাবে চিতাভস্ম গঙ্গায় ভাসানো হয়। শব চুরি বা দাহে ব্যাঘাত ধর্মীয় গুরুপাপ হিসেবে বিবেচিত। এই বিশ্বাস ভাঙলে সমাজিকভাবে পরিবারও লাঞ্ছিত হয়।
খ্রিস্টধর্ম:
খ্রিস্টধর্মে মৃতদেহকে সমাহিত করার পর তা আর খোঁড়ার অনুমতি নেই, যতটা সম্ভব মর্যাদার সঙ্গে কবর রক্ষা করতে হয়। তাই মেডিকেল শিক্ষায় হাড়গোড় ব্যবহারে অনেকে বডি ডোনেশন করেন, কিন্তু জোরপূর্বক নয়।
বৌদ্ধধর্ম:
বৌদ্ধধর্মে শবদেহ পবিত্র, পুনর্জন্মের ধারণার সাথে জড়িত। মৃতদেহের সঙ্গে হস্তক্ষেপ ভয়াবহ পাপ হিসেবে ধরা হয়, যদিও তিব্বত বা থাই বৌদ্ধ সংস্কৃতিতে আংশিক ব্যতিক্রম আছে।
কেন বিকল্প জরুরি?
1. নৈতিকতা:
জীবিত মানুষের দেহের মতোই মৃতদেহের অধিকার আছে, এই বোধ শিক্ষার্থীদের মধ্যে গড়ে তুলতে হবে।
2. আইনগত বাধা:
আধুনিক সময়ে কবর খোঁড়া বা হাড় পাচার আন্তর্জাতিক অপরাধ। বিদেশে Skeleton Export একসময় বৈধ থাকলেও এখন তা নিষিদ্ধ।
3. সমাজে বিভ্রান্তি:
কবর খোঁড়ার গুজব সমাজে ভয় আর অনাস্থা ছড়ায়। এ ধরনের গোপন কাজ চিকিৎসাবিদ্যায় আস্থা নষ্ট করে।
4. বিজ্ঞানের জন্যই ক্ষতি:
যখন লাশ বা কঙ্কাল আড়াল থেকে জোগাড় হয়, তখন মান নিয়ন্ত্রণ হয় না, শিক্ষার্থীরা অনেক সময় ত্রুটিপূর্ণ কাঠামো নিয়ে পড়ে। এতে ভুল শেখা হয়।
যা করতে হবে, তা এখনই করতে হবে
১। প্রতিটি মেডিকেলে সিন্থেটিক কঙ্কাল বাধ্যতামূলক করা
২। ভার্চুয়াল ল্যাব আর বডি ডোনেশন বিষয়ে গাইডলাইন তৈরি
৩। ধর্মীয় নেতাদের নিয়ে জনসচেতনতা
৪। অবৈধ Skeleton ব্যবসা বন্ধে কড়া আইন প্রয়োগ
৫। ছাত্রছাত্রীদের নৈতিকতা ক্লাসে ‘ক্যাডাভার এথিকস’ পড়ানো
৬। শিক্ষার্থীদের হাতে আঁকা হাড়ের চার্ট ও লেবেলড স্কেচ বেশি ব্যবহার করা।
৭। সিনিয়র শিক্ষার্থীর হাড়ের সেট জুনিয়রদের মাঝে শেয়ার করে পড়ানো।
৮। কলেজে থাকা কঙ্কাল যত্নে রাখা ও পুনঃব্যবহার নিশ্চিত করা।
৯। অ্যানাটমি ক্লাসে ভিডিও লেকচার ও ইউটিউব 3D মডেল বেশি দেখানো।
১০। ছোট গ্রুপে মডেল নিয়ে যৌথভাবে স্টাডি গ্রুপ চালু করা।
১১। প্রয়োজনে এক সেট হাড় একসাথে ৪-৫ জন ব্যবহার করে শেখা।
১২। মেডিকেল বইয়ের ডায়াগ্রাম বেশি আঁকতে শেখানো।
১৩। সরকারি মেডিকেলে একেকটি অ্যানাটমি রুম শেয়ারড রিসোর্স হিসেবে ব্যবহার করা।
১৪। অ্যানাটমি টিচারদের নিজস্ব হ্যান্ডমেড মডেল বা চার্ট বেশি শেয়ার করা।
১৫। হাড় নিয়ে অবৈধ বাণিজ্যের পরিবর্তে সচেতনতা মূলক সেমিনার আয়োজন করা।
মানব কঙ্কাল চিকিৎসাবিজ্ঞানের অপরিহার্য শিক্ষক, তবে গোপনে শবচুরি আর হাড়গোড়ের বাণিজ্য ভয়াবহ অনৈতিক ও ধর্মবিরোধী। আধুনিক বিজ্ঞান, প্রযুক্তি আর মানুষের নৈতিক সচেতনতা মিলিয়ে আমাদের ‘Skeleton Mystery’ কে ইতিহাসে পাঠিয়ে দিতে হবে ; বাস্তবে নয়!
মো. ইফতেখার হোসেন
চিকিৎসা শিক্ষার্থী, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ | নিউরোসায়েন্স, অভ্যাস গঠন ও মানুষের মস্তিষ্কের আচরণগত পরিবর্তন নিয়ে আগ্রহী।
Leave a comment