আপনি যদি গুগল বা কোনো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চ্যাটবটকে জিজ্ঞাসা করেন, “এই গ্রহে এখন পর্যন্ত মোট কতজন মানুষ জন্মেছে?”—তবে খুব দ্রুতই একটি উত্তর পেয়ে যাবেন। সংখ্যাটি হলো প্রায় ১১৭ বিলিয়ন। কিন্তু এই সংখ্যাটি কি আপনার কাছে একটু কম মনে হচ্ছে না? ভাবুন তো, বর্তমানে পৃথিবীর জনসংখ্যা প্রায় ৮.২ বিলিয়ন। এর মানে হলো, মানব ইতিহাসের সকল মানুষের প্রায় ৭ শতাংশই আজ আমাদের সাথে জীবিত!
এই ১১৭ বিলিয়ন সংখ্যাটি সেই সমস্ত মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করে যারা পৃথিবীর আলো দেখেছিল, এমনকি যারা শিশুকালেই মারা গিয়েছিল। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে বিশ্বজুড়ে মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। ফলে জনসংখ্যা নিয়ে আরও কিছু অদ্ভুত প্রশ্ন সামনে আসে। যেমন, ২০১৪ সালে ‘দি ইকোনমিস্ট’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে দাবি করা হয়েছিল যে, মানব ইতিহাসে যত মানুষ ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়স পার করেছেন, তাদের অর্ধেকই নাকি আজও জীবিত! এটা কি আসলেই সত্যি হতে পারে? আর এই ধরনের হিসাবই বা কীভাবে করা হয়?
আসুন, জনসংখ্যাতত্ত্বের এই চমকপ্রদ গণিতের পেছনের গল্পটা জেনে নেওয়া যাক।
কেন এই গণনা এত কঠিন?
কয়েক দশক ধরেই জনসংখ্যাবিদরা এই ধরনের প্রশ্ন নিয়ে কাজ করছেন। তাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো নির্ভরযোগ্য তথ্যের অভাব। কোনো নির্দিষ্ট সময়ে কত মানুষ বেঁচে ছিল এবং তাদের গড় আয়ু বা জন্মহার কত ছিল, তা জানা প্রয়োজন। বর্তমানে আদমশুমারির (Census) কল্যাণে এসব তথ্য পাওয়া গেলেও, কয়েক শতাব্দী আগের পৃথিবীর জন্য তা প্রায় অসম্ভব। তখন তো আর নিয়মিত পরিসংখ্যান সংগ্রহ বা আদমশুমারি হতো না! তাই জনসংখ্যাবিদদের মূলত অনুমানের উপর নির্ভর করতে হয়।
এই অনুমানের ভিত্তি কী? পুরোনো দিনের শহরের আয়তন, জনসংখ্যার ঘনত্ব এবং প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে পাওয়া সূত্র ব্যবহার করে তাঁরা একটি আনুমানিক সংখ্যা দাঁড় করান। তবে এই অনুমান বিভিন্ন গবেষণায় বিভিন্ন রকম হতে পারে। যেমন, ১ খ্রিস্টাব্দে পৃথিবীর জনসংখ্যা কোথাও ১৭০ মিলিয়ন বলা হয়েছে, আবার অন্য কোনো গবেষণায় তা ৩০০ মিলিয়ন, যা প্রায় দ্বিগুণ।
এর সাথে আরও একটি মৌলিক প্রশ্ন জড়িত—”মানুষ” বলতে আমরা ঠিক কাদের বোঝাব? কেবল আমাদের প্রজাতি, অর্থাৎ হোমো সেপিয়েন্স (Homo sapiens), নাকি হোমো (Homo) গণের সকল সদস্য, যারা লক্ষ লক্ষ বছর ধরে এই গ্রহে হেঁটে বেড়িয়েছে?
এতসব চ্যালেঞ্জ থাকার পরেও যে আমরা ১১৭ বিলিয়নের মতো একটি নির্দিষ্ট সংখ্যা পাই, তা বেশ অবাক করার মতো। তবে বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এটি একটি নির্ভুল সংখ্যা না হলেও এর ‘মাত্রা’ (order of magnitude) বেশ গ্রহণযোগ্য। অর্থাৎ, আসল সংখ্যাটি এর কাছাকাছিই হওয়ার কথা।
জনসংখ্যার মডেলিং: মানবতার গণিত
পৃথিবীর জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার সব সময় একরকম ছিল না। প্রাচীনকালে জনসংখ্যা বাড়ত খুব ধীর গতিতে, কিন্তু সাম্প্রতিক শতাব্দীগুলোতে এই বৃদ্ধি হয়েছে বিস্ময়করভাবে দ্রুত। এর কারণ হলো, জন্মহার কমলেও মৃত্যুহার কমেছে তার চেয়েও অনেক বেশি।
এই পরিবর্তনশীল বৃদ্ধির হারকে গণিতের মডেলের মাধ্যমে প্রকাশ করা বেশ জটিল। তাই জনসংখ্যাবিদরা একটি কৌশল ব্যবহার করেন। তাঁরা পুরো সময়কালকে কয়েকটি ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে নেন। যেমন, খ্রিস্টপূর্ব ৫০,০০০ অব্দ থেকে শুরু করে ২০২২ সাল পর্যন্ত সময়কে কয়েকটি পর্বে ভাগ করা হয়। প্রতিটি পর্বে জনসংখ্যার বৃদ্ধির হারকে মোটামুটি স্থির ধরে নেওয়া হয়।
কোনো নির্দিষ্ট সময়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারকে একটি সূচকীয় ফাংশন (exponential function) দিয়ে প্রকাশ করা যায়, যা অনেকটা ব্যাংকের চক্রবৃদ্ধি সুদের মতো কাজ করে। শুরুতে অল্প কিছু মানুষ থাকলেও সময়ের সাথে সাথে তা দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকে।
এখন প্রশ্ন হলো, মোট কতজন মানুষ জন্মেছে তা কীভাবে বের করা হবে? এর জন্য প্রতিটি নির্দিষ্ট সময়ে জীবিত মানুষের সংখ্যাকে যোগ করতে হবে। গণিতের ভাষায় একে ইন্টিগ্রেশন (Integration) বলা হয়। তবে একটি সমস্যা আছে। আপনি যদি এই প্রবন্ধটি পড়েন, তবে আপনি বর্তমানে জীবিত আছেন। দশ বছর আগেও আপনি জীবিত ছিলেন এবং তখনও আপনি বিশ্ব জনসংখ্যার অংশ ছিলেন। এভাবে যোগ করলে একই মানুষকে বারবার গণনা করা হবে।
এই সমস্যার সমাধান হলো, প্রতিটি সময়কালের মোট জনসংখ্যাকে সেই সময়ের মানুষের গড় আয়ু দিয়ে ভাগ করে দেওয়া। সবশেষে, প্রতিটি পর্বের ফলাফল যোগ করলেই পাওয়া যাবে সেই জাদুকরী সংখ্যাটি!
একটি সহজ পদ্ধতি ও তার ফলাফল
গণিতটা কি একটু জটিল মনে হচ্ছে? জার্মান গণিত শিক্ষক ব্রুনো শেজা তার শিক্ষার্থীদের জন্য একটি সহজ পদ্ধতির কথা বলেছেন। তার ছাত্রছাত্রীরা ইন্টিগ্রেশনের মতো জটিল পদ্ধতি জানত না। তাই তারা একটি সাধারণ কৌশল ব্যবহার করে।
তারা নির্দিষ্ট দুটি সময়ের জনসংখ্যার গড় বের করে। যেমন, ১৯০০ সালে জনসংখ্যা ছিল ১.৬ বিলিয়ন এবং ১৯৪৫ সালে তা ছিল ২.৫ বিলিয়ন। তারা এই ৪৫ বছরের জন্য গড় জনসংখ্যা ধরল ২.০৫ বিলিয়ন। এরপর এই গড় জনসংখ্যাকে সময়কাল (৪৫ বছর) দিয়ে গুণ করে সেই সময়ের গড় আয়ু দিয়ে ভাগ করে দিল। এভাবে প্রতিটি পর্বের জন্য হিসাব করে তারা একটি মোট সংখ্যা বের করল, যা বেশ চমকপ্রদ।
জনসংখ্যাবিদ কার্ল হাউব-এর ব্যবহৃত তথ্য দিয়ে দুটি পদ্ধতিরই তুলনা করা যাক। তিনি ধরেছিলেন, মানবজাতির শুরু হয়েছিল ৫০,০০০ বছর আগে মাত্র দুজন মানুষ দিয়ে। তার তথ্য ব্যবহার করে জটিল গাণিতিক পদ্ধতিতে ফলাফল আসে প্রায় ৯৩ বিলিয়ন। আর বর্তমানে যে ১১৭ বিলিয়ন সংখ্যাটি প্রচলিত, সেটি আরও আধুনিক তথ্যের উপর ভিত্তি করে তৈরি, যেখানে মানবজাতির সূচনা ধরা হয়েছে ২,০০,০০০ বছর আগে।
অন্যদিকে, জার্মান শিক্ষার্থীদের সেই সহজ পদ্ধতি ব্যবহার করলে ফলাফল আসে ১৪০ বিলিয়নেরও বেশি! দুটি ফলাফলের মধ্যে পার্থক্য বেশ বড় মনে হলেও, দুটি সংখ্যাই কিন্তু একই ‘মাত্রার’ (১০ বিলিয়ন থেকে ১০০ বিলিয়নের মধ্যে)। এটি প্রমাণ করে যে, একটি সাধারণ ধারণা থেকেও কতটা কাছাকাছি পৌঁছানো সম্ভব।
৬৫ বছর বয়সীদের সেই রহস্যের সমাধান
এবার ফেরা যাক সেই অবাক করা দাবিতে—মানব ইতিহাসে যত মানুষ ৬৫ বছর বয়স পার করেছেন, তাদের অর্ধেকই নাকি আজও জীবিত! ২০১৭ সালে একদল জনসংখ্যাবিদ এই দাবিটি পরীক্ষা করে দেখেন।
তাদের গবেষণা শেষে দেখা যায়, দাবিটি সঠিক ছিল না। তাদের হিসাব অনুযায়ী, ইতিহাসে যত মানুষ ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সে পৌঁছেছেন, তাদের মধ্যে মাত্র ৫.৫ থেকে ৯.৫ শতাংশ মানুষ বর্তমানে জীবিত।
যদিও এটি মূল দাবির চেয়ে অনেক কম, সংখ্যাটি কি আপনাকে অবাক করছে না? একবার ভাবুন, যদি একটি লটারির মাধ্যমে ঠিক করা হতো যে আপনি মানব ইতিহাসের কোন সময়ে জন্মাবেন, আর আপনি যদি ৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত বাঁচতেন, তবে আজকের এই সময়ে আপনার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা থাকত প্রায় ১০ জনে ১ জন! লক্ষ লক্ষ বছরের মানব ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে এটি সত্যিই একটি অসাধারণ ব্যাপার।
শেষ পর্যন্ত, এই সংখ্যাগুলো নিছক কোনো পরিসংখ্যান নয়। এগুলো আমাদের মানব ইতিহাসের বিশালতার এক ঝলক দেখায় এবং সময়ের স্রোতে আমাদের নিজেদের অবস্থানকে নতুন করে ভাবতে শেখায়।
Leave a comment